টি-টোয়েন্টির উত্থানের বছরে ওয়ানডেতে পতন
২০২৪ এ দ্য ইকোনোমিস্টের বর্ষসেরা দেশ হয়েছে বাংলাদেশ। মূলত জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারমুক্ত হওয়ায় এ মূল্যায়ন করা হয় বাংলাদেশকে। এ বছর দেশের রাজনীতিতে আন্দোলন-সংগ্রাম আর বিজয়ের উচ্ছ্বাসের মতোই রোলার-কোস্টার যাত্রা ছিল ক্রিকেটেও।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) শীর্ষ নেতৃত্বে পরিবর্তনের সঙ্গে বড় রদবদল এসেছে বিসিবির পরিচালনা পর্ষদেও। বোর্ডের এমন পরিবর্তনের হাওয়া মাঠের ক্রিকেটেও লেগেছে। বছরের শেষ অর্ধে টাইগাররা টেস্টে হোয়াইটওয়াশ করেছে পাকিস্তানকে, আর টি-টোয়েন্টিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। তাছাড়া বছরজুড়ে মাঠের বাইরের নানা কাণ্ডেও আলোচনায় ছিল দেশের ক্রিকেট। স্মৃতির পাতা থেকে ২২ গজে ২৪ এর আলোচিত সব ঘটনা ফিরে দেখেছে ঢাকা পোস্ট।
আরও পড়ুন
সাদা পোশাকে পাকিস্তান জয়
২০০১ সাল থেকেই পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট খেলছে বাংলাদেশ। তবে ২০২৪ এর আগে কখনো জয়ের দেখা পায়নি। আরাধ্য সেই জয় এবার রাওয়ালপিন্ডিতে ধরা দেয়। শুধুই কি জয়? সিরিজের প্রথম টেস্টে ১০ উইকেটের জয় পায় বাংলাদেশ। বড় জয় থেকে পাওয়া সেই আত্মবিশ্বাস টাইগাররা টেনে নিয়ে যায় শেষ টেস্টেও। এবার ৬ উইকেটের জয়। তাতে এই সিরিজে প্রথমবার পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট জয়, সিরিজ জয় ও হোয়াইটওয়াশ করার স্বাদ পায় বাংলাদেশ। যা দেশের ক্রিকেটের জন্য বড় অর্জন। এমন কীর্তিতে ক্রিকেটারদের ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা পুরস্কার দেয় বিসিবি।
পাকিস্তান সিরিজের পরপরই ভারতের বিপক্ষে ব্যর্থ ছিল টাইগাররা। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে বাজে শুরুর পরও ঘুরে দাড়ায় বাংলাদেশ। শেষ টেস্টে নতুন ব্রান্ডের ক্রিকেট খেলে চমক দেয় মেহেদি হাসান মিরাজের দল। কাউন্টার অ্যাটাকে ক্যারিবিয়ানদের জাত চেনান টাইগার পেসাররা।
২০২৪ সালে সবমিলিয়ে বাংলাদেশ টেস্ট খেলেছে ১০টি। যা কোনো পঞ্জিকা বর্ষে সর্বোচ্চ টেস্ট খেলার রেকর্ড টাইগারদের। এবছর বাংলাদেশ জয় পেয়েছে তিনটি। যা এক পঞ্জিকাবর্ষে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি টেস্ট জয়ের যৌথ রেকর্ড। আর তিন জয়ের সবকটিই দেশের বাইরে, এটা প্রথমবার ঘটেছে।
ক্যারিবিয়ানদের টি-টোয়েন্টি রাজ্যে বাঘের হানা
তিন সংস্করণের ক্রিকেটে বাংলাদেশ সবচেয়ে পিছিয়ে টি-টোয়েন্টিতে। পরিসংখ্যান অন্তত সেই কথাই বলে। টাইগারদের টি-টোয়েন্টি র্যাংকিং এখনও ৯। অন্যদিকে এই ফরম্যাটের অন্যতম সেরা দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তাদের বর্তমান র্যাংকিং চার। দুইবারের বিশ্বকাপজয়ী ক্যারিবিয়ানদের তাদের ঘরের মাঠে গিয়ে হোয়াইটওয়াশ করেছে বাংলাদেশ। সেটাও তাদের পছন্দের ফরম্যাট টি-টোয়েন্টিতে! লিটন দাসের নেতৃত্বে টি-টোয়েন্টিতে এমন উত্থান সংক্ষিপ্ত সংস্করণের ক্রিকেটে টাইগারদের নতুন এক যাত্রা।
বছরের শেষে এসে টি-টোয়েন্টিতে এমন সাফল্য আসলেও এ বছরই বিব্রতকর হারের লজ্জাও পেয়েছে টাইগাররা। বিশ্বকাপের আগে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে সিরিজ হার ছিল অপ্রত্যাশিতই। আর বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে শেষ দিকে এসে সেমির সমীকরণ না মেলাতে পারাটা কষ্টেরই ছিল!
কাগজে-কলমে এই সংস্করণে বাংলাদেশের সফলতম বছর ছিল ২০২৪। এই বছর ২৪ ম্যাচ জয় এসেছে ১২টি। ২০২১ সালে ১১ জয় এসেছিল ২৭ ম্যাচে।
চেনা ওয়ানডেতেই অচেনা বাংলাদেশ
বাকি দুই ফরম্যাটের তুলনাকয় ওয়ানডের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব বেশি গাঢ়। এই সংস্করণের ক্রিকেটে টাইগারদের উন্নতির গ্রাফও গত কয়েক বছরে উর্ধ্বমুখী ছিল। তবে ২৪ এ সেটা মুখ থুবড়ে পড়েছে! উন্নতির গ্রাফের রেখাটা ইউটার্ন করে এখন নিম্নমুখী!
এ বছর তিনটি দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলেছে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দেশের মাঠে সিরিজ জিততে পারলেও আফগানিস্তানের কাছে হেরেছে টাইগাররা। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে বাংলাদেশ।
বিদায় পাপন অ্যান্ড গং
২০১২ সালে সভাপতি মনোনয়ন এবং ২০১৩ সালের নির্বাচনের পর থেকে বিসিবির সভাপতির পদে ছিলেন নাজমুল হাসান পাপন। দীর্ঘ এক যুগ পর বিসিবির সভাপতির পদ ছেড়েছেন তিনি। অবশ্য তার বিদায়টা স্বাভাবিক ছিল না। ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পালিয়ে দেশ ছাড়ার পর আড়ালে চলে যান পাপনও। আওয়ামী লীগ মনোনীত সংসদ সদস্য ও ক্রীড়া মন্ত্রী ছিলেন তিনি। তাই গণ অভ্যুত্থানের মুখে নিরাপত্তা শঙ্কায় পড়ে আর বিসিবিতে আসেননি। শেষ পর্যন্ত অনলাইনে বিসিবির মিটিংয়ে যোগ দিয়ে পদত্যাগ করেন তিনি।
২০১৩ সালের পর ২০১৭ ও ২১ সালে টানা তিনবার নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন পাপন। ২০১৩ সালে নাজমুল হাসান পাপন এনএসসি কোটায় পরিচালক হয়েছিলেন। পরবর্তীতে পরিচালকরা তাকে সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করেন। গত দুই নির্বাচনে তিনি ঢাকা আবাহনীর কাউন্সিলর হিসেবে পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন। পরবর্তীতে একই প্রক্রিয়ায় সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন পাপন।
পাপন ছাড়াও আরো আওয়ামীপন্থী যার বিসিবির পরিচালক পদে ছিলেন তারাও ৫ আগস্টের পর আড়ালে চলে যান। তাছাড়া পাপনের আস্থাভাজন একাধিক বিসিবি পরিচালক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
ড্রাইভার থেকে হেল্পার সাকিব
'আমি যতদিন ক্রিকেটে থাকবো ড্রাইভার হিসেবেই থাকবো, যখন মনে হবে যে আমাকে দিয়ে আর হচ্ছে না। বা আমি আর ড্রাইভার না, তখন নিজে থেকেই সরে যাবো।'-এটা সাকিব আল হাসান নিজেই বলেছিলেন। কথাটা কতটুকু রাখতে পেরেছেন সাকিব তা হিসেবের সময় বোধহয় এখনই!
৫ আগস্টের পর আর দেশে ফেরেননি এই অলরাউন্ডার। আওয়ামী লীগ মনোতিত সংসদ সদস্য হওয়ায় এবং জুলাই গণহত্যায় নিরব ভূমিকা পালন করায় সাকিবের ওপর ক্ষিপ্ত দেশের ক্রিকেট ভক্তদের একাংশ। একই সঙ্গে তার নামে হত্যা মামলাও হয়েছে ঢাকায়। সবমিলিয়ে নিরাপত্তা শঙ্কায় দেশে ফিরতে পারছনে না তিনি। এরই মধ্যে ভারত সিরিজে খেলার সুযোগ পেয়ে টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। একই সময় জানান, দেশের মাটিতে টেস্ট খেলে অবসরে যেতে চান। তবে সেটা আর পারেননি। বা সাকিবের সেই আবদার পূরণ করতে পারেনি বিসিবিও।
এরপর সাকিব নিজে থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে ওয়ানডে খেলার আগ্রহ দেখান। তবে বিসিবি তাকে দলে ডাকেনি। লম্বা সময় জাতীয় দলের বাইরে থাকায় তাকে দলে নির্বাচনের জন্য বিবেচনা করেনি বিসিবি। এক সময় দলের প্রাণভোমরা থাকা সাকিবই হয়েছেন এই সিরিজে অবহেলার পাত্র! তার ভাষায় অবশ্য বলাই যায়, ড্রাইভার থেকে সাকিব এখন হেল্পার!
যুব এশিয়াকাপে শিরোপার সঙ্গে প্রাপ্তি আজিজুল তামিম
টানা দ্বিতীয়বার যুব এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত ফাইনালে টস জিতে বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানায় ভারত। বাংলাদেশ ৪৯.১ ওভারে ১৯৮ রানে অলআউট হয়। জবাবে বাংলাদেশের বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের কোণঠাসা হয়ে যায় ভারত। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ৩৫.২ ওভারে ১৩৯ রানে ভারত অলআউট হয় তারা।
২০২৩ সালে এই স্টেডিয়ামেই স্বাগতিক আরব আমিরাতকে হারিয়ে যুব এশিয়া কাপ ক্রিকেটে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলদেশ।
এবারের আসরে টাইগারদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন আজিজুল হাকিম তামিম। নেতৃত্ব, পরিকল্পনা কিংবা মাঠের পারফরম্যান্স সবজায়গায় লেটার মার্ক তুলেছেন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক। মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের এই লড়াইয়ে ব্যাট হাতেও আসরের অন্যতম সেরা পারফর্মার তামিম। যশোরের এই তরুণ ৫ ম্যাচে ২৪০ রান করেছেন। এক সেঞ্চুরির সঙ্গে তার নামের পাশে আছে দুই ফিফটি। পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছেন ৪ উইকেট। এই টুর্নামেন্ট থেকে ট্রফির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রাপ্তি জুনিয়র তামিম!
চড় কাণ্ডে হাথুরুর পতন
সর্বশেষ ভারত বিশ্বকাপে বিতর্কিত এক কাণ্ডে নাম জড়ায় চন্ডিকা হাথুরুসিংহের। এক ক্রিকেটারের গায়ে হাত তোলার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। বিশ্বকাপ শেষে সেই ঘটনা নিয়ে বিসিবি তেমন কিছু করেনি। তবে বিসিবির শীর্ষ নেতৃত্বে পরিবর্তন আসার পর এই কাণ্ডে চাকরি হারান হাথুরু। অবশ্য তার বিরুদ্ধে স্বেচ্চাচারিতারও অভিযোগ ছিল আগে থেকেই। সবমিলিয়ে বাংলাদেশে দ্বিতীয় অধ্যায় শেষ হয় এই লঙ্কান মাস্টার মাইন্ডের।
পেসারদের উত্থান
২০২৪ সালটা ছিল পেসারদের উত্থানের বছর। দেশের ক্রিকেটে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল স্পিনারদের। তাদের ঘিরেই সাজানো হত মূল পরিকল্পনা। গত কয়েক বছরে সেই ধারা থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসার চেষ্টায় ছিল বাংলাদেশ। ২০২৪ এ এসে টেস্টে স্পিনারদের ছাড়িয়ে গেলেন পেসাররা।
টেস্টে এক পঞ্জিকাবর্ষে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার রেকর্ডও গড়ে ফেলেছেন তাসকিন আহমেদ-হাসান মাহমুদরা। সবমিলিয়ে এ বছর টেস্টে বাংলাদেশি পেসারদের শিকার ৮২ উইকেট। আর স্পিনারদের ৬৯ উইকেট। ২০২৪ সালের আগে বাংলাদেশের পেসাররা টেস্টে স্পিনারদের চেয়ে বেশি উইকেট পেয়েছিলেন ২০০৭ সালে।
অবশেষে ধরা দিলো ‘সোণার হরিণ’
একসময় বাংলাদেশ দলে বিশেষজ্ঞ লেগ স্পিনার ছিল স্বপ্নের মতো ব্যাপার। একজন লেগি চেয়ে রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়েছে বিসিবি, কিন্তু হ্যারিকেন দিয়ে খুঁজেও যেন পাওয়া যাচ্ছিলো না। মাঝেমধ্যে দু–একজন এলেও কেউ থিতু হতে পারেননি। অবশেষে 'সোণার হরিণ' হয়ে ধরা দেন রিশাদ হোসেন। গত বছর মার্চে তার দলে আসার পর এই অল্প সময়ের মধ্যে পাল্টাতে শুরু করেছে দৃশ্যপট। সংক্ষিপ্ত সংস্করণে রিশাদ এখন নির্ভরতার বড় নাম।
রিশাদই টি–টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি এ বছর। টি–টোয়েন্টিতে দলের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেট নিয়েই বছর শেষ করলেন রিশাদ। ২৪ ম্যাচে ২৪ ইনিংসে বোলিং করে তার শিকার ৩৫ উইকেট।
নিরাপত্তা ইস্যুতে সরে যায় নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ
সর্বশেষ নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশের মাটিতে। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতায় তা আর হয়নি। নিরাপত্তা শঙ্কার কারণে বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে এই আসর নেওয়া হয় সংযুক্ত আরব আমিরাতে। যদি এই আসরের আয়োজক স্বত্ত্ব ছিল বাংলাদেশের কাছেই।
দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ খেলতে না পারার কষ্ট ভুলে আসরে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই জয় পেয়েছিল বাংলাদেশের মেয়েরা। স্কটল্যান্ডকে ১৬ রানে হারিয়ে সময়ের হিসাবে ১০ বছর, ম্যাচের হিসাবে ১৬ আর টুর্নামেন্টের হিসাবে ৪টি বিশ্বকাপের পর জয়ের দেখা পায় বাংলাদেশ।
এইচজেএস