ভারত-নিউজিল্যান্ডের ‘শাপমোচন’, ‘রিয়েল চোকার্স’ আফ্রিকা
২০২৪ পেরিয়ে নতুন বছরের সূর্য দেখার অপেক্ষায় পুরো বিশ্ব। ক্রিকেটাঙ্গনও পার করতে চলেছে ঘটনাবহুল একটি বছর। যে সময়ে ক্রীড়ামোদীরা সাক্ষী হয়েছে ছেলে-মেয়েদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে একচ্ছত্র আধিপত্যে ছেদ ঘটার মতো ঘটনার। দীর্ঘ শিরোপাখরা কাটিয়েছে ভারত ও নিউজিল্যান্ড। বিপরীতে দুটো টুর্নামেন্টেই ‘চোকার’খ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকা ফের কপাল পুড়েছে।
২০২৩ সালের ধারাবাহিকতায় গত হতে চলা বছরেও চরম নাটকীয়তার জন্ম দিয়েছে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারত-পাকিস্তান। বছরের বাউন্ডারি লাইনে (ডিসেম্বর) দাঁড়িয়ে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি নিয়ে সেই দোলাচল কেটেছে। এ ছাড়া বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালের দৌড়ে রোমাঞ্চকর লড়াই এবং পাকিস্তান ক্রিকেটে কোচ ও অধিনায়ক বদলের নাটকীয়তায় ব্যস্ত ছিল পুরো বছর।
বিশ্ব ক্রিকেটে গত এক বছরের আলোচিত সব ঘটনা একনজরে দেখে নেওয়া যাক ঢাকা পোস্টের সালতামামি আয়োজনে—
ভারত-নিউজিল্যান্ডের ‘শাপমোচন’
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দিয়ে চলতি বছরের জুনে দীর্ঘ ১৩ বছর শিরোপা জিততে না পারার ‘শাপমোচন’ করেছে ভারত। অথচ মাত্র সাত মাস আগেও উৎসবের সব আয়োজন প্রস্তুত রেখে হতাশার সাগরে ডুবেছিল ভারত। আহমেদাবাদে লাখো দর্শককে স্তব্ধ করে ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে তাদের স্বপ্নভঙ্গ করে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া। ১৪ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্বে রোহিত-কোহলিদের সেই স্বপ্ন পূরণ হয় আটলান্টিক মহাসাগর তীরবর্তী ক্যারিবীয় দ্বীপ বার্বাডোজে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে কেনসিংটন ওভালে উৎসবের মঞ্চ আগেই সাজিয়ে রেখেছিল ভারত। শিরোপানির্ধারণী ম্যাচটিতে তারা বিরাট কোহলির ৭৬, অক্ষর প্যাটেলের ৪৭ ও শিভাম দুবের ২৭ রানের ক্যামিওতে ভর করে ১৭৬ রানের শক্ত সংগ্রহ তারা দাঁড় করায়। বল হাতেও ভারতের শুরুটা ছিল চ্যাম্পিয়নদের মতোই। মাঝে কুইন্টন ডি কক আর হেনরিখ ক্লাসেন দেয়াল হয়ে দাঁড়ালেও জাসপ্রিত বুমরাহ ও আর্শদ্বীপ সিংরা ডেথ ওভারে দুর্দান্ত বোলিংয়ে ৭ রানে জয় ছিনিয়ে নেন। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম আসরের চ্যাম্পিনরা ১৩ বছর পর ফরম্যাটটিতে আরও একবার বিশ্বসেরার তকমা পেল।
এরপর ফরম্যাটটিতে মেয়েদের বৈশ্বিক আসর বসার কথা ছিল বাংলাদেশে। কিন্তু রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর নিরাপত্তা শঙ্কায় টুর্নামেন্টটি সরিয়ে নেওয়া হয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে। দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত ফাইনালের আগে নারী-পুরুষ উভয় ক্রিকেটেই কিউইদের সম্বল ছিল বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২১ এবং ২০০ সালে অনুষ্ঠিত আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শিরোপা। অর্থাৎ, সীমিত ওভারের বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড কখনোই ফাইনালের বাধা পেরোতে পারেনি।
কিউইদের সেই আক্ষেপ বা ‘শাপ’ ঘুচেছে দুবাইয়ে। ২০১৫ ও ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে পরপর স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল কেইন উইলিয়ামসনদের। অন্যদিকে, কিউই মেয়েরা ২০০৯ এবং ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পরপর দুবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুযোগ হারায়। তাদের বিশ্বসেরা হওয়ার দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হয়েছে প্রোটিয়া মেয়েদের হারিয়ে। ফাইনালের মহারণে অ্যামেলিয়া কার ৪৩, ব্রুক হ্যালিডে ৩৮ এবং সুজি বেটস ৩২ রান করলে কিউইরা ১৫৮ রানের চ্যালেঞ্জিং পুঁজি পায়। পরে লক্ষ্য তাড়া করা আফ্রিকান মেয়েদের মাত্র ১২৬ রানে গুটিয়ে ৩২ রানের ইতিহাসগড়া জয় পায় নিউজিল্যান্ড।
‘রিয়েল চোকার্স’ দক্ষিণ আফ্রিকা
ভারতের পুরুষ এবং নিউজিল্যান্ড নারী দলের দুই উৎসবেরই বিপরীত প্রান্তে ছিল একটি দল— দক্ষিণ আফ্রিকা। যাদের গায়ে আগে থেকেই ‘চোকার’ তকমাটি লেগে আছে। সাম্প্রতিক কালের প্রায় প্রতিটি বিশ্বকাপে যাদের দৌড় বলতে গেলে সেমিফাইনাল পর্যন্ত। সেই দক্ষিণ আফ্রিকার পুরুষ জাতীয় দল এবার প্রথমবার কোনো আইসিসি টুর্নামেন্টের ফাইনালে ওঠে অপরাজিত থেকে। অবশ্য রোহিত-বুমরাহ’র ভারতও কোনো হার না দেখেই ফাইনাল খেলতে নেমেছিল। টুর্নামেন্ট শেষেও তারাই অপরাজিত।
আরও পড়ুন
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টির সর্বোচ্চ এই প্রতিযোগিতায় দক্ষিণ আফ্রিকা দলের স্লোগান ছিল ‘দশে মিলে করি কাজ’ ঘরানার। বোলিং-ব্যাটিংয়ে ভারসাম্য রেখে তারা ফাইনালে ওঠে। কিন্তু চূড়ান্ত মহারণে সেটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে ভারত। শেষ ২৪ বলে মাত্র ২৬ রানের সমীকরণ মেলাতে পারেননি ডেভিড মিলাররা। আর্শদ্বীপ–বুমরাহ’র একের পর এক ডট ডেলিভারি আর হার্দিক পান্ডিয়ার নাটকীয় চূড়ান্ত ওভার। স্নায়ুচাপের লড়াইয়ে জয় হলো ভারতেরই।
একইভাবে মাস খানেকের ব্যবধানে হতাশার আগুনে পুড়েছে প্রোটিয়া মেয়েরাও। ২০২৩ আসরেও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছিল লরা উলভার্টের দলটি। সেখানে অস্ট্রেলিয়া এবং এবার তাদের ঘাতক নিউজিল্যান্ড। আফ্রিকানরা সেবার ঘরের মাঠ এবং ২০২৪ বিশ্বকাপে দুবাইয়েও একই তিক্ত স্বাদ আস্বাদন করলেন তাজমিন ব্রিটস, নাদিনে ডি ক্লার্ক ও ম্যারিজান ক্যাপরা।
বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই
চলছে ২০২৩-২৫ বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। সাদা পোশাকের বৈশ্বিক এই প্রতিযোগিতার প্রথম দুই আসরে ফাইনাল খেললেও শিরোপা জেতা হয়নি ভারতের। এবার তৃতীয় আসরেও তারা হট ক্যান্ডিডেটই ছিল। কিন্তু তারা হোঁচট খেয়েছে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাঠে ৩ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয়ে। একই সময়ে বাংলাদেশের মাটিতে টেস্ট সিরিজ জিতে দৃশ্যপটে চলে আসে দক্ষিণ আফ্রিকাও। সবমিলিয়ে ফাইনালের লড়াইয়ে আছে ৪ দল, এর মধ্যে এগিয়ে অস্ট্রেলিয়া ও প্রোটিয়ারা।
ফাইনালে উঠতে দলগুলোর সামনে যে সমীকরণ—
দক্ষিণ আফ্রিকা : ৬৩.৩৩ শতাংশ পয়েন্ট নিয়ে এখন পর্যন্ত টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের টেবিলে চূড়ায় রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। তারা বর্তমানে পাকিস্তানের বিপক্ষে ২ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলছে। যার মধ্যে একটিতে জিতলেই তাদের ফাইনাল নিশ্চিত।
অস্ট্রেলিয়া : ৫৮.৮৯ শতাংশ পয়েন্ট নিয়ে তাদের অবস্থান দুইয়ে। ভারতের বিপক্ষে বোর্ডার-গাভাস্কার সিরিজের প্রথম ৩ ম্যাচ শেষে দুই দল এই মুহূর্তে ১-১ সমতায় রয়েছে। সিরিজের বাকি দুটি টেস্ট জিতলে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল নিশ্চিত হবে অস্ট্রেলিয়ার। আর সিরিজটি ২-২ ব্যবধানে ড্র হলে নতুন বছরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে অন্তত ১টি ম্যাচ জিততে হবে অস্ট্রেলিয়ার।
ভারত : ৫ ম্যাচের এই চলমান সিরিজে রোহিত শর্মার দলকে পরবর্তী ২টি টেস্টই জিততে হবে। সিরিজ যদি ২-২ ব্যবধানে ড্র হয়, সেক্ষেত্রে অন্য দলের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে ভারতকে। সংশয় ছাড়াই ফাইনালে যেতে ভারতের হলে বোর্ডার–গাভাস্কার ট্রফি জিততে হবে ৩-১ ব্যবধানে। বর্তমানে ভারতের পয়েন্ট ৫৫.৮৯ শতাংশ।
শ্রীলঙ্কা : লঙ্কানদের ফাইনাল খেলার সম্ভাবনা খুবই কম। যেহেতু তারা চারে অবস্থান করছে বড় ব্যবধানে (৪৮.২১ শতাংশ) পিছিয়ে থেকে। টেস্ট চ্যাম্পিয়শিপ চক্রে তারা সর্বশেষ সিরিজ খেলবে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। যেখানে লঙ্কানদের ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জয় ছাড়া অন্য দলের দিকেও তাকিয়ে থাকতে হবে।
ভারত-পাকিস্তানের ‘হাইব্রিড’ নাটক
রাজনৈতিক বৈরিতার কারণে ২০০৮ সালের পর পাকিস্তানে খেলতে যায়নি ভারত। ২০১২ সালে একেবারে বন্ধ হয়ে যায় দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশের দ্বিপাক্ষিক সিরিজও। অথচ তাদের মুখোমুখি ম্যাচ দেখতে উন্মাদনায় ফেটে পড়েন ক্রিকেটভক্তরা। নতুন করে তাদের সেই বিরোধ মাথাছাড়া দেয় ২০২৩ এশিয়া কাপে। পাকিস্তান টুর্নামেন্টটির একক আয়োজক হলেও, ভারত সেখানে খেলতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে হাইব্রিড মডেলে টুর্নামেন্ট যৌথভাবে গড়ায় শ্রীলঙ্কায়।
এবার আসন্ন ২০২৫ আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। ৮ দলের টুর্নামেন্ট হলেও, বছরজুড়ে ভারত-পাকিস্তানের বিরোধে নীরব দর্শক হতে হয়েছে বাকি ৬ দেশকে। পাকিস্তানে টুর্নামেন্টটি হবে নাকি ভারতের চাওয়ায় সেটি নিরপেক্ষ ভেন্যুতে সরে যাবে— এমন নাটকীয়তা শেষে দুই দল এক মেরুতে পৌঁছেছে সম্প্রতি। ২০২৭ সাল পর্যন্ত আগামী তিন বছর দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশ নিজেদের মাটিতে হতে যাওয়া সব বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট ‘হাইব্রিড’ মডেলে আয়োজনে ঐক্যমত দিয়েছে।
পাকিস্তান ক্রিকেটে চেয়ার বদলের হিড়িক
পাকিস্তানের ক্রিকেট যেন অনিশ্চয়তা ও ড্রামা সিরিয়ালের মতো ক্ষণে ক্ষণে মোড় নেওয়া কোনো নতুন পর্ব। নেতৃত্ব, কোচ এবং পিসিবির দায়িত্ব বারবার বদলে তারা খবরের শিরোনাম হয়েছে। বিশ্বকাপে ব্যর্থতায় বাবর আজমের নেতৃত্ব থেকে পদত্যাগ, এক সিরিজ শেষেই শাহিন আফ্রিদির অধিনায়কত্ব কেড়ে নেওয়া, বাবরকে আবারও নেতৃত্বে ফেরানো এবং বছরের শেষদিকে সাদা বলের দুই ফরম্যাটে মোহাম্মদ রিজওয়ানের কাঁধে দায়িত্ব– সবমিলিয়ে পেন্ডুলামের মতো পরিস্থিতি পাল্টেছে।
এ ছাড়া এই বছর বেশ কয়েকজন কোচ বদলেছে পাকিস্তান। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর নিউজিল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার গ্র্যান্ট ব্রাডবার্নের কোচিংয়ে ইতি টানে পিসিবি। এরপর দুই বছরের চুক্তিতে সাবেক দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটার গ্যারি কার্স্টেন পাকিস্তানের ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির প্রধান কোচের পদে বসানো হয়। মাত্র ছয় মাসের মাথায় ভারতকে বিশ্বকাপ জেতানো এই কোচও নিজ থেকে দায়িত্ব ছেড়েছেন। টেস্ট দলের দায়িত্বে থাকা জেসন গিলেস্পিও তার ‘দায়িত্ব কমে যাওয়ার’ যুক্তি দেখিয়ে পদত্যাগ করেন চলতি মাসে।
এএইচএস