হকিতে বিশ্বকাপ, সর্বকনিষ্ঠ আইএম, সাগরের অলিম্পিক
বেশিরভাগ সময় দেশের ফুটবল–ক্রিকেটই বছরজুড়ে আলোচনায় থাকে। এই দুই প্রধান খেলার বাইরে অন্য খেলাগুলোতেও থাকে অর্জন ও ব্যর্থতার গল্প। ২০২৪ সালে অন্য খেলা ও ফেডারেশনগুলোর নানা ঘটনা তুলে ধরেছেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের।
সরাসরি অলিম্পিকে আরচ্যার সাগরের
অলিম্পিক গেমসে পদক জয় বাংলাদেশের জন্য এখনও অলীক ভাবনাই। বাংলাদেশ বিশ্বের সর্ববৃহৎ ক্রীড়া আসরে অংশগ্রহণ করে ওয়াইল্ড কার্ডে। ২০১৬ সালে রিও অলিম্পিক থেকে একজন করে ক্রীড়াবিদ নিজ যোগ্যতায় অলিম্পিকে খেলছেন। গলফার সিদ্দিকের পর ২০২০ সালে সরাসরি অলিম্পিক খেলেন আরচ্যার রোমান সানা। এবার তুরস্কের আনাতোলিয়ায় প্যারিস অলিম্পিকের শেষ কোটা প্লেস টুর্নামেন্টে আরচ্যার সাগর ইসলাম নিজ যোগ্যতায় অলিম্পিক খেলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। সাগর এখনও বিকেএসপির শিক্ষার্থী। সিদ্দিক ও রোমানের চেয়ে কম বয়সে সরাসরি অলিম্পিক খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছেন তিনি। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বা সাফল্যে এটা তেমন বড় কোনো বিষয় না হলেও, বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ।
অলিম্পিকে অংশগ্রহণই ‘সান্ত্বনার’
বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ হলেও বাংলাদেশ এখনও অলিম্পিকে পদক জিততে পারেনি। ১৯৮৪ সাল থেকে এখনও যেন অংশগ্রহণই শেষ কথা! ২০২৪ প্যারিস অলিম্পিকে শ্যুটিং ও অ্যাথলেটিক্সে জাতীয় টাইমিং করতে পারেননি বাংলাদেশের অ্যাথলেটরা। উল্টো বাংলাদেশের দ্রুততম মানব তার দৌড় শেষে ইনজুরি নিয়েই অংশগ্রহণ এবং তিনি অংশ নিতে চাননি এমন বিস্ফোরক মন্তব্যও করেন। অলিম্পিকে একটি পদক সারাবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বদলে দিতে পারে। এজন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ। বাংলাদেশের ক্রীড়া নীতিনির্ধারক এ নিয়ে তেমন ভাবেন না!
সর্বকনিষ্ঠ আন্তর্জাতিক মাস্টার নীড়
বাংলাদেশের দাবায় সম্ভাবনাময় নাম মনন রেজা নীড়। হাঙ্গেরিতে তিনি আন্তর্জাতিক মাস্টার (আইএম) নর্ম পূরণ করেছেন। মাত্র ১৪ বছর ৫ মাস বয়সে তিনি এই খেতাব পান। যা বাংলাদেশি দাবাড়ুদের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুততম। নিয়াজ মোর্শেদের সর্বকনিষ্ঠ আন্তর্জাতিক মাস্টার হওয়ার ৪৩ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভেঙে দেন নীড়। আন্তর্জাতিক মাস্টারের পাশাপাশি এই বছর নীড় জাতীয় চ্যাম্পিয়নও হয়েছেন। তবে সেখানে অবশ্য সর্বকনিষ্ঠ হতে পারেননি তিনি। এই রেকর্ড এখনও নিয়াজেরই দখলে।
আন্তর্জাতিক মাস্টার ফাহাদ রহমান এই বছর একটি গ্র্যান্ডমাস্টার নর্ম পেয়েছেন। দীর্ঘদিন চেষ্টার পর এই বছর একটি নর্ম অর্জন করেছেন তিনি। আরও দুটি নর্ম ও ২৫০০ রেটিং স্পর্শ করলে ফাহাদ গ্র্যান্ডমাস্টার হতে পারবেন।
খেলতে খেলতে চলে গেলেন জিয়া
বাংলাদেশের দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান জাতীয় দাবায় খেলতে খেলতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন গত ৫ জুলাই। দাবা ফেডারেশন থেকে মাত্র ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে জিয়াকে হাসপাতালে নেওয়া হলেও তাকে বাঁচানো যায়নি। জিয়ার মৃত্যু বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে বড় ধাক্কা। মৃত্যুর আগেই অবশ্য জিয়া দাবা অলিম্পিয়াড নিশ্চিত করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর সেই স্থানে যান ছেলে তাহসিন তাজওয়ার জিয়া। জিয়ার অকালে চলে যাওয়া দাবাঙ্গনের জন্য বড় শূন্যতা।
স্থানীয় ক্রীড়া কমিটির বিলুপ্তি, ৪২ ফেডারেশনের সভাপতি অপসারণ
৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ক্রীড়াঙ্গনে ব্যাপক রদবদল হয়েছে। ফুটবল-ক্রিকেট ছাড়া বাকি সব ফেডারেশনের সভাপতি সরকার মনোনীত। খেলাধুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকা অনেকেই রাজনৈতিক ও নানা প্রভাবে বিভিন্ন ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। তাই সংস্কারের লক্ষ্যে ৫ আগস্ট যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ একযোগে ৪২ ফেডারেশনের সভাপতিকে অব্যাহতি দেয়। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে একযোগে এত সভাপতি বাদ দেওয়ার ঘটনা রেকর্ডগড়া পদক্ষেপ। সভাপতি বাদ দেওয়ার পাশাপাশি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) তাদের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারিকেও ফেডারেশনগুলো কমিটি থেকে বাদ দিয়েছে। এনএসসি কর্মকর্তাদের কারও বদলি, কেউবা সাময়িক বরখাস্তও হয়েছেন।
পরবর্তীতে ২১ আগস্ট যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জেলা-বিভাগীয় ও উপজেলা ক্রীড়া সংস্থাও বিলুপ্ত করে। ফেডারেশন সভাপতিদের মতো স্থানীয় ক্রীড়া প্রশাসনেও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা দায়িত্বে ছিলেন। সেই ভাবনায় ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সকল জেলা-বিভাগের কমিটি বিলুপ্ত করে দেয়। চার মাস পেরিয়ে গেলেও সেই কমিটি এখনও গঠন হয়নি। ফলে ক্রীড়াঙ্গনের তৃণমূল পর্যায়ে চলছে স্থবিরতা।
আরও পড়ুন
সংস্কারে সার্চ কমিটি
ক্রীড়া মন্ত্রণালয় গত ২৯ আগস্ট ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারের লক্ষ্যে সার্চ কমিটি গঠন করে। ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির আহ্বায়ক জোবায়েদুর রহমান রানাকে নিয়ে শুরুর দিকে কিছুটা সমালোচনা হয়েছিল। পরবর্তীতে কমিটির সদস্য মহিউদ্দিন বুলবুল বাফুফের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করায় ক্রীড়া মন্ত্রণালয় তাকে শোকজ করে এবং পরবর্তীতে অব্যাহতি প্রদান করে বিকেএসপির ডিজিকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করে। প্রায় চার মাসের বেশি সময় কাজ করছে ওই কমিটি। কিন্তু এখনও দৃশ্যমান সংস্কার দেখা যায়নি। ১৪ নভেম্বর নয়টি ফেডারেশনে অ্যাডহক কমিটি প্রকাশ পেয়েছে। আরও কয়েকটি কমিটির সুপারিশ তারা করলেও সেটি এখনও প্রকাশিত হয়নি। এ ছাড়া ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারের লক্ষ্যে গঠনতন্ত্র পর্যালোচনা করছে এই কমিটি।
ইনডোর অ্যাথলেটিক্সে সাফল্য
২০২৩ সালে অ্যাথলেটিক্সে এশিয়ান পর্যায়ে প্রথম সাফল্য এনেছিলেন বাংলাদেশের দ্রুততম মানব ইমরানুর রহমান। এই বছর এশিয়ান ইনডোর অ্যাথলেটিক্সে ইমরান সফল হননি। তিনি না পারলেও ইরান থেকে দুটি পদক এসেছে বাংলাদেশের। স্প্রিন্টার জহির রৌপ্য ও হাই-জাম্পার মাহফুজ ব্রোঞ্জ জেতেন। এর আগে স্বর্ণ জেতায় ফেডারেশন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক পুরস্কার পেয়েছিলেন ইমরান। সেই তুলনায় জহির ও মাহফুজ তেমন পুরস্কার পাননি।
হকিতে যুব বিশ্বকাপ
বছরের শেষ মাসে এসে হকির ইতিহাসে সেরা সুখবর এসেছে। ওমানে অনূর্ধ্ব-২১ এশিয়া কাপ হকিতে বাংলাদেশ পঞ্চম স্থান অর্জন করে। এতে আগামী বছর ডিসেম্বরে ভারতে অনুষ্ঠিতব্য যুব বিশ্বকাপ নিশ্চিত হয় বাংলাদেশের। দেশের হকির ইতিহাসে কোনো পর্যায়ে এটাই প্রথম বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ। হকি খেলোয়াড়রা নানা সীমাবদ্ধতায় থাকেন। মাত্র ৪০০ টাকা দৈনিক ভাতা পেয়ে অনুশীলন করা খেলোয়াড়রা বিশ্বকাপে বাংলাদেশের নাম লিখিয়েছেন।
ব্যাডমিন্টনে অলিম্পিয়ান শাটলার
৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ফুটবল-ক্রিকেট ছাড়া অন্য কোনো ফেডারেশন দেশে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করেনি। ব্যাডমিন্টন ফেডারেশন আয়োজিত আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টনে ১৫টিরও বেশি দেশের শাটলাররা অংশগ্রহণ করেছে। এতে অংশ নিয়েছেন প্যারিস অলিম্পিকে খেলা ইউক্রেনিয়ান শাটলার পলিনা। তিনি মহিলা এককে চ্যাম্পিয়নও হয়েছেন।
শ্যুটিংয়ে আতিক ও সাদিয়ার চলে যাওয়া
চলতি বছর শ্যুটিংয়ের জন্য অনেক বেদনার। কমনওয়েলথ গেমসে স্বর্ণজয়ী শ্যুটার আতিকুর রহমান জুলাই মাসে মৃত্যুবরণ করেন। অবশ্য দীর্ঘদিন ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। বছরের শেষ দিকে এসএ গেমসে স্বর্ণপদক প্রাপ্ত শ্যুটার সাদিয়া সুলতানাও মৃত্যুবরণ করেন। তিনি অবশ্য অবসাদ ও নানা কারণে শ্যুটিং থেকে দূরে ছিলেন এক দশকেরও বেশি সময়।
এজেড/এএইচএস