ক্রীড়াঙ্গনে আর্থিক অসমতা: ক্রিকেটই সর্বেসর্বা, বাকিদের দৈন্যদশা

‘মাত্র ২০ লাখ টাকার জন্য মেয়েরা যেতে পারলো না। এর চেয়ে দুঃখের কিছু হতে পারে না।’—অলিম্পিক বাছাইপর্ব খেলতে বাংলাদেশ নারী দলের মিয়ানমার সফরে যেতে না পারার প্রতিক্রিয়ায় এভাবেই মন্তব্য করেছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সাবেক সভাপতি নাজমুল হোসেন পাপন।
বিজ্ঞাপন
বাফুফের সাবেক সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের সঙ্গে সেসময় কিছুটা কথার যুদ্ধেই জড়িয়েছিলেন পাপন। কথা প্রসঙ্গে এভাবেই উঠে এসেছিল ফুটবলের আর্থিক দৈন্যদশার কথা। সময়ের আবর্তনে আর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের খেলায় কাজী সালাউদ্দিন এবং নাজমুল হোসেন পাপন দুজনেই এখন অতীত। খবরের শিরোনাম কিংবা কাজের জায়গায় নেই তারা। তবু বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে আর্থিক চালচিত্রের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সেই পুরোনো কথাটাই টানতে হচ্ছে। আর্থিক অবস্থানের দিক থেকে ফুটবল ও ক্রিকেটের যোজন যোজন ব্যবধানের একটা প্রতীকই হয়ে থাকবে পাপনের এই একটা বাক্য।
অথচ, গেল মাসেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক এবং দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ক্রিকেট তারকা তামিম ইকবাল স্বীকার করেছেন, এখনো দেশে ফুটবলই সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। দেশের জনপ্রিয়তম খেলা ফুটবলের আর্থিক অবস্থার এই চিত্রটাই চাইলে বলে দিতে পারে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের আর্থিক অবস্থা ঠিক কতখানি ভগ্নদশায় আছে।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের আর্থিক চালচিত্র এবং বৈষম্যের হালচাল নিয়ে ঢাকা পোস্টের জুবায়ের আহাম্মেদের তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব...
বিজ্ঞাপন
আর্থিক সক্ষমতায় ক্রিকেট বোর্ডই সবার ওপরে
শুধু নিজের দেশেই না, ক্রিকেট বিশ্বেই বাংলাদশ ক্রিকেট বোর্ড অনেক শক্তিশালী দেশের চেয়ে এগিয়ে থাকছে। বিসিবির আর্থিক সক্ষমতার সঙ্গে বাকিদের ব্যবধান কতটা বেশি সেটার একটা ক্ষুদ্র উদাহরণ হতে পারে স্পন্সরশিপ রাইটস। ২০২৪ সালের ৩১ মার্চ ক্রিকেট বোর্ডের সবশেষ বার্ষিক সাধারণ সভা থেকে জানা যায়, বিসিবি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে স্পন্সরশিপ রাইটস থেকে পেয়েছে ৩৮ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন
এক বছর আগেও বিসিবির সম্পদের পরিমাণ ছিল ৯৭২ কোটি টাকা। এক লাফে সেই সম্পদ পাঁচ হাজার কোটি ঢাকায় পৌঁছে গেছে। পূর্বাচলে রাজউকের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে ৩৭৩৬ শতাংশ জমি পেয়েছিল বিসিবি। বর্তমান বাজার মূল্যে যার পরিমাণ ৩৫৪৯ কোটি টাকা।
বিপরীতে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল বলতে গেলে প্রায় এক দশক পার করছে কোনো প্রকার স্পন্সর ছাড়াই। ২০১৬ সালে সবশেষ বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে স্পন্সর পেয়েছিল বাংলাদেশ ফুটবল। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ‘লোটো’ সেবার শুধুমাত্র কিট স্পন্সর ছিল। অথচ একটা সময় নোকিয়া এবং গ্রামীণফোনের মতো কোম্পানি ছিল স্পন্সর। সিটিসেলের স্পন্সরশিপ নিয়ে ২০০৯ সালে মাঠে গড়িয়েছিল কোটি টাকার সুপার কাপ। কিন্তু ফুটবলের জৌলুশের মতো আর্থিক এসব হিসেবও এখন অতীত।
শুধু ফুটবলেই যখন এমন দশা, তখন দেশের অন্যান্য ক্রীড়াখাতে স্পন্সরের অবস্থা কেমন তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। নিকট অতীতে বিগ বাজেটের মাঝে কেবল ২০২২ সালে ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক হকি লিগের খোঁজ পাওয়া যায়। এর বাইরে স্পন্সর থাকলেও সেটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে। দেশের হয়ে একাধিক পদকজয়ী রোমান সানা ব্যক্তিগত পর্যায়ে স্পন্সর পেয়েও অবশ্য কাজে লাগাতে পারেননি সেটা।
ফুটবলে বসুন্ধরাই সব, বাকি খেলায় ক্রীড়া পরিষদই ভরসা
বাংলা বাগধারা পড়ে থাকলে ‘সবেধন নীলমণি’ শব্দের সঙ্গে পরিচয় থাকার কথা। যাকে বলা হয় একমাত্র অবলম্বন। বাংলাদেশের ফুটবলে এমন অবস্থা বসুন্ধরা গ্রুপের সঙ্গে। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ, ফেডারেশন কাপ, স্বাধীনতা কাপসহ প্রায় সব পর্যায়ের ফুটবলে তারাই বাফুফের একমাত্র ভরসা। বিপিএলের চ্যাম্পিয়ন দল বসুন্ধরা কিংসটাও তাদেরই। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র ও শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের সব দায়িত্বটাও ছিল তাদের।
এমনকি দেশের একমাত্র ক্লাব মালিকানাধীন ফুটবল স্টেডিয়ামও তাদেরই। ফুটবলের আঁতুড়ঘর বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম যখন সংস্কারের জন্য পুরোদমে ব্যস্ত, তখন জাতীয় দলের ক্যাম্প আর খেলাও হচ্ছে বসুন্ধরা গ্রুপের অর্থায়নে গড়ে ওঠা কিংস অ্যারেনায়। তবে ক্রমাগত ব্যর্থতার জাল বুনতে থাকা জাতীয় ফুটবল দলের স্পন্সর হিসেবে নেই বসুন্ধরা। এমনকি ঢাকা ব্যাংক ও ইউনিসেফ নারী ফুটবলে কাজ করলেও পুরুষ ফুটবলে আগ্রহী না তারা।
আয়-ব্যয়ের হিসেব চুকিয়ে বিসিবির নিট আয় ৩৯ কোটি টাকা। বিসিবির মূল ডিপোজিট ৬৮৫ কোটি টাকা। বিপরীতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ প্রশিক্ষণ ও আয়োজন বাবদ ৫৯ ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনকে ১৭ কোটি ৫৯ লাখ ৩৯ হাজার টাকা বরাদ্দ করেছে।
ফুটবলের এমন চিত্রটা অবশ্য অনেকটা ভালো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। দেশের অন্য কোনো ফেডারেশনে নেই এমন স্পন্সর বা আয়ের উৎস। এক্ষেত্রে তারা পুরোপুরি নির্ভরশীল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ওপর। ২০২৪ সালের ১০ জুলাই চলতি অর্থবছরের জন্য ফেডারেশনগুলোকে বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। সব ফেডারেশন মিলিয়ে যেখানে বরাদ্দ মোটে ১৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। অথচ ক্রিকেটে শুধু ফ্র্যাঞ্চাইজি আসর বিপিএলের জন্য ফিক্সড ডিপোজিট আছে ৮৭ কোটি টাকা।
ফেডারেশন প্রতি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বাজেটের দিকে তাকালে শুরু করতে হবে হতাশার উপন্যাসের নতুন আরেকটা অধ্যায়। দেখা যাক সেই দিকটা।
কোন ফেডারেশনের জন্য কত বরাদ্দ?
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ১ বছরে আয় ৫০৭ কোটি টাকা। বিদায়ী বোর্ড সভাপতি নাজমুল হোসেন পাপনের সংবাদ সম্মেলন অনুযায়ী, আয়-ব্যয়ের হিসেব চুকিয়ে বিসিবির নিট আয় ৩৯ কোটি টাকা। বিসিবির মূল ডিপোজিট ৬৮৫ কোটি টাকা। এতকিছুর পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বাজেটের প্রতি নির্ভর করছে না।
বাকি ফেডারেশনের দিকে এবারে নজর ফেরানো যাক। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ প্রশিক্ষণ ও আয়োজন বাবদ ৫৯ ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনকে ১৭ কোটি ৫৯ লাখ ৩৯ হাজার টাকা বরাদ্দ করেছে। এর মধ্যে প্রশিক্ষণ খাতে ৮ কোটি ৭৭ লাখ ৩৯ হাজার আর প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এই দুই খাত মিলিয়ে একমাত্র আরচ্যারি ফেডারেশনের বরাদ্দ এক কোটি ২ লাখ টাকা। বাকি সব ফেডারেশনে বাজেট কোটি টাকার নিচে।
আরচ্যারির পরে বরাদ্দের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থান বাংলাদেশ রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের। প্রশিক্ষণে ৫৭ আর আয়োজনে ৩৮ লাখ মিলিয়ে মোট বরাদ্দ ৯৬ লাখ। তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিনিধিত্ব করা অনেক ফেডারেশনে বাজেট এরচেয়ে ঢের কম। দাবার কথাই এখানে বলা যেতে পারে। কদিন আগেই ৮২ বছরে হাঙ্গেরিতে বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে খেলতে গিয়ে হইচই ফেলেছিলেন রানী হামিদ। অথচ, বিদেশে সুনাম কুড়ানো দাবার জন্য বরাদ্দ মোটে ১০ লাখ টাকা।
হকি ফেডারেশনের জন্য প্রশিক্ষণ খাতে বরাদ্দ মাত্র ১১ লাখ। অন্যদিকে ব্রিজে প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ ১৭ লাখ। উশু-রোলার স্কেটিংয়ের মতো অজনপ্রিয় খেলার জন্য ৪২ ও ৫৭ লাখ বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। যেখানে অ্যাথলেটিক্স ও সাঁতারের মতো বৈশ্বিকভাবে জনপ্রিয় দুই ইভেন্টের জন্য বরাদ্দ ছিল ৭৪ লাখ ও ৭২ লাখ টাকা। জাতীয় সুইমিং কমপ্লেক্সের অবস্থা বর্তমানে এতটাই ভঙ্গুর, শীতে পানি গরম করার অবস্থাও নেই। বাজেট এবং অন্যান্য আর্থিক অবস্থা মিলিয়ে এসব খেলায় সাফল্য আশা করাও হয়ত বড় রকমেরই পাপ।
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ, ফেডারেশন কাপ, স্বাধীনতা কাপসহ প্রায় সব পর্যায়ের ফুটবলে তারাই বাফুফের একমাত্র ভরসা। বিপিএলের চ্যাম্পিয়ন দল বসুন্ধরা কিংসটাও তাদেরই। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র ও শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের সব দায়িত্বটাও ছিল তাদের। এমনকি দেশের একমাত্র ক্লাব মালিকানাধীন ফুটবল স্টেডিয়ামও তাদেরই। ফুটবলের আঁতুড়ঘর বঙ্গবন্ধ স্টেডিয়াম যখন সংস্কারের জন্য পুরোদমে ব্যস্ত, তখন জাতীয় দলের ক্যাম্প আর খেলাও হচ্ছে বসুন্ধরা গ্রুপের অর্থায়নে গড়ে ওঠা কিংস অ্যারেনায়।
বাজেটই যখন এত কম, তখন বিভিন্ন খেলায় যুক্ত খেলোয়াড়দের আর্থিক অবস্থার চিত্রটাও সহজেই অনুমেয়। কদিন আগেই দাবার বোর্ডে প্রয়াত হওয়া গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়ার পরিবার এখনও আর্থিক সাহায্যের জন্য ঘুরছেন দ্বারে দ্বারে। দেশের জন্য পদক এনে দেওয়া আর্চার রোমান সানা বেতন সংক্রান্ত ক্ষোভে গিয়েছিলেন অবসরে। সাফজয়ী নারী ফুটবল দলের বেতন বকেয়া নিয়েও কম আলোচনা হয়নি।
এর বিপরীতে ক্রিকেটে ঘরোয়া পর্যায়েই ক্রিকেটাররা আয় করছেন লাখ লাখ টাকা। আন্তর্জাতিক সাফল্য না থাকলেও প্রতিনিয়ত পকেট ভারী হচ্ছে ক্রিকেটারদের। দেশের ক্রীড়াঙ্গনের বিভিন্ন খাতে বেতনের সেই বৈষম্যের চিত্র থাকছে পরের পর্বে।
জেএ/এফআই