আমেরিকান জায়ানের স্বপ্নেও লাল-সবুজ জার্সি
বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। সেটা অবশ্য আমেরিকায় ‘সকার’ নামেই বেশি পরিচিত। আমেরিকান ফুটবলে অগ্রসর রাজ্য-শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম ভার্জিনিয়া। সেই ভার্জিনিয়ায় শীর্ষ পর্যায়ে খেলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত জায়ান আহমেদ। তবে বাংলাদেশের লাল-সবুজ জার্সি গায়ে জড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন ২০ বছর বয়সী জায়ান।
লেফট-ব্যাক ও উইং দুই পজিশনেই জায়ানের পারদর্শিতা রয়েছে। দুরন্ত গতি, দুর্দান্ত ড্রিবলিংয়ের পাশাপাশি যেকোনো পজিশন থেকে গোলে শট নেওয়ার যেমন ক্ষমতা, তেমনি প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে ওয়ান ভার্সেস ওয়ানেও রুখে দিতে পারেন তিনি। তাই জায়ান জর্জ ম্যাশন বিশ্ববিদ্যালয় দলের অন্যতম সদস্য। শিক্ষার্থী-অ্যাথলেট পর্যায়ে এই দল সর্বোচ্চ পর্যায়েই খেলে। দলটির হয়ে খেলার আগে জায়ান দুই বছর ছিলেন ভার্জানিয়া টেকে। যেখান থেকে আমেরিকার অনেক ফুটবলারের জন্ম। ভার্জিনিয়ায় নানা পর্যায়ে ফুটবল পারফরম্যান্স প্রদর্শন করে ইউরোপে বেশ কিছু টুর্নামেন্ট এবং ক্যাম্প করেছেন জায়ান। ২০২১ সালে ডেনমার্কে ক্যাপেলি স্পোর্ট কাপ, ২০১৭ সালে বার্সেলোনায় আবিইআর কাপে অংশ নিয়েছেন।
আমেরিকায় ফুটবলের পাশাপাশি ম্যানেজম্যান্ট ইনফরমেশন সিস্টেমে স্নাতক পড়ছেন এই তরুণ প্রবাসী। বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশে পড়াশোনা এবং খেলাধুলা করলেও জায়ানের মন বাংলাদেশে। একটাই স্বপ্নের কথা জানালেন তিনি, ‘আমি একদিন বাংলাদেশের লাল-সবুজ জার্সি পরতে চাই। নিজেকে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত করতে চাই বাংলাদেশের ফুটবলার হিসেবে।’
২০০৪ সালে ভার্জিনিয়াতেই জন্ম জায়ানের। সেখানেই বেড়ে উঠলেও বাবা-মা দুই জনই বাংলাদেশি। তাই বাংলাদেশের প্রতি আলাদা টান ও ভালোবাসা জায়ানের। সময়-সুযোগ পেলে পরিবারের সঙ্গে আসেন বাংলাদেশে। গত পরশু (বৃহস্পতিবার) বাবার সঙ্গে ঢাকায় এসেছেন সপ্তাহ দু’য়েকের জন্য। পারিবারিক সফরে আসলেও এর মধ্যে জায়ানের পাসপোর্টের প্রক্রিয়া শুরু করতে চান বাবা শরীফ আহমেদ, ‘বাবা-মায়ের সূত্রে সে বাংলাদেশি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য খেলা এবং নানা কাজেই পাসপোর্ট প্রয়োজন। মূলত খেলার বিষয়ে তাগিদের জন্যই আমরা পাসপোর্টের প্রক্রিয়া শুরু করছি শিগগিরই।’
জায়ানের বাবা শরীফ আহমেদ আশি-নব্বইয়ের দশকের ফুটবলার। ইস্কাটন সবুজ সংঘের হয়ে প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগ খেলেছেন ২ বছর। অনূর্ধ্ব-১৬ জাতীয় দলের স্কোয়াডেও ছিলেন। সেই স্কোয়াডে তার সঙ্গে ছিলেন দেশের অন্যতম সেরা ফুটবলার আরমান মিয়া, আলফাজ আহমেদরাও। ক্যাম্পে থাকলেও শরীফ আহমেদ টুর্নামেন্ট খেলতে সৌদি যেতে পারেননি শেষ পর্যন্ত। ফলে লাল-সবুজ জার্সি না পরার আক্ষেপ এখনও তাকে পোড়ায়, ‘সৌদি সফর ও ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষা একই সময়ে পড়েছিল। পাারিবারিক কারণে পরীক্ষা বেছে নেওয়ায় সৌদি যাওয়া হয়নি এবং বাংলাদেশের জার্সিও আর পরা হয়নি।’
জুনিয়র জাতীয় দলের ক্যাম্পে থাকায় ফুটবলার হিসেবে বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও ঘরোয়া ফুটবলের ক্যারিয়ার সেভাবে লম্বা করেননি শরীফ। ভারতে একটি বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। এরপর ১৯৯৪ সালে পাড়ি জমান আমেরিকায়। তিন দশক ধরে সেখানেই রয়েছেন। নিজে খেলতে না পারলেও বাবার ইচ্ছে ছেলে জায়ান যেন বাংলাদেশের জার্সি গায়ে জড়াতে পারে, ‘আসলে আমার চেয়ে জায়ানের ইচ্ছেই বেশি। সে আমেরিকায় বেড়ে উঠলেও মনেপ্রাণে সব সময় বাংলাদেশ। তার ইচ্ছে বাংলাদেশের হয়ে খেলার। আমিও চাই সে একদিন খেলুক। এজন্য আমার সর্বাত্মক সহযোগিতা থাকবে।’
নব্বইয়ের দশকের তারকা ক্রিকেটার হালিম শাহ। তার ছেলে কাজেম শাহ কিরমানি কানাডা থেকে বাংলাদেশে এসে ঘরোয়া ফুটবল খেলে জাতীয় দলের জার্সিতে ম্যাচও খেলেছেন। হালিম ও শরীফ দুই জনই ইস্কাটন সবুজ সংঘে খেলেছেন। দুই জন আবার আত্মীয়ও। কাজেমের জাতীয় দলে খেলা দেখে অনুপ্রাণিত শরীফ, ‘কাজেম ঘরোয়া ফুটবলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। জায়ানও পারবে নিশ্চয়ই সে আত্মবিশ্বাস রয়েছে। শুধু তার একটু বিকশিত হওয়ার সুযোগ দরকার।’
বাবার মতো জায়ানও বেশ আত্মবিশ্বাসী, ‘আমি ইতোমধ্যে ইউরোপে ক্যাম্প করার পাশাপাশি খেলেছি। ভিন্ন আবহে মানিয়ে নেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। বাংলাদেশ তো নিজের দেশই, অবশ্যই পারব, শুধু একটু সুযোগ চাই নিজেকে প্রমাণ করার।’
বাফুফের টেকনিক্যাল বিভাগ প্রবাসী ফুটবলারদের নিয়ে কাজ করে। জায়ানের ব্যাপারে বাফুফের টেকনিক্যাল বিভাগ অবগত। ভার্জিনিয়া লিগে জায়ানের ম্যাচ ফুটেজ এবং সিভি সবই ফেডারেশনে রয়েছে। ফেডারেশনের বাইরে দেশের এক শীর্ষ কোচ জায়ানের কিছু ফুটেজ দেখেছেন। তার প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ– বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলো এবং বয়সভিত্তিক জাতীয় দলের স্কোয়াডে থাকার সক্ষমতা রয়েছে তার। জায়ানের বয়স বিশের নিচে হলেও সাফ-এএফসি’র বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতার ট্রায়ালে ডেকে পরখ করতে পারত ফেডারেশন। বয়স বিশের বেশি হওয়ায় এএফসি অ-২৩ বাছাইয়ের টুর্নামেন্টে ক্যাম্প ছাড়া জায়ানকে যাচাইয়ের উপলক্ষ্য নেই ফেডারেশনের।
জায়ান ও তার বাবা উভয়ের পরিকল্পনা– আমেরিকায় ব্যাচেলর পর্যায়ের পড়াশোনা আর এক বছর শেষ করে বাংলাদেশে এসে প্রিমিয়ার লিগ খেলা এবং সেখানে প্রমাণ করে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ানো। ৩ জানুয়ারি আমেরিকায় ফেরার আগে জায়ানের বাবা তার সময়কার সতীর্থ ফুটবলারদের সঙ্গে সৌজন্য-সাক্ষাৎ করে ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করবেন।
আরও পড়ুন
ইংলিশ প্রিমিয়ার ফুটবল লিগে খেলা হামজা চৌধুরি বাংলাদেশের হয়ে খেলবেন। যোগ্যতাসম্পন্ন ও বাংলাদেশের হয়ে খেলতে আগ্রহী প্রবাসীদের জন্য দেশের ফুটবল দলের দ্বার উন্মুক্ত রাখতে চান বাফুফের নতুন সভাপতি তাবিথ আউয়াল। বেশ কয়েকজন প্রবাসী ফুটবলারদের নিয়ে কাজ করলেও বাফুফে সভাপতি সুনির্দিষ্টভাবে কোনো খেলোয়াড় নিয়ে মন্তব্য না করে সামগ্রিকভাবে বলেছেন, ‘আশা করছি হামজা চৌধুরীর মতো অন্য প্রবাসী যারা খেলছেন, তাদের আরও চিহ্নিত করে বাংলাদেশ দলে খেলার জন্য অনুপ্রাণিত করতে পারব। এ ছাড়া বাফুফে চেষ্টা করবে খেলোয়াড়দের নিয়ে নানান তথ্য দিতে।’
বাংলাদশ ফুটবল দলের বর্তমান অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া ডেনমার্ক প্রবাসী। দলের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ডিফেন্ডার তারিক কাজী ফিনল্যান্ড থেকে এসেছেন। নতুন দলে জায়গা পাওয়া কাজেম শাহ–ও কানাডা প্রবাসী। জেমি ডে’র সময় আকস্মিকভাবে জাতীয় দলে অভিষেক হয়েছিল কানাডা প্রবাসী রাহবার খানেরও। সরাসরি জাতীয় দলে খেলায় প্রশ্ন উঠেছিল অনেক। বিভিন্ন সময় অনেক প্রবাসী ট্রায়ালে ও ক্যাম্পে থাকলেও নিজেকে সেভাবে প্রমাণ করতে পারেননি। আবার অনেকে পর্যাপ্ত সুযোগও পাননি।
অনেক প্রবাসী ফুটবলার রয়েছেন যারা বেশ যোগ্যতা ও সম্ভাবনাময় হলেও বাংলাদেশের জন্য খেলতে আগ্রহীও থাকেন না, আবার কারও ফিফার আইন মেনে ডকুমেন্ট তৈরিতেও বেশ জটিল প্রক্রিয়া থাকে। বাফুফের বর্তমান কমিটি যোগ্যতা-আগ্রহ-ক্রাইটেরিয়া সকল কিছু বিবেচনা করেই বাংলাদেশ দলে প্রবাসীদের পথ খোলা রাখতে চায়।
এজেড/এএইচএস