হাত খরচ ৪০০, বুটের দামই ১৮ হাজার; এরপরও ইতিহাস গড়ে বিশ্বকাপে
বাংলাদেশের হকির ইতিহাস ও সংস্কৃতি বহু পুরনো। এশিয়ান পর্যায়ে অনেক জয় থাকলেও বিশ্বকাপের মঞ্চে কখনো পা রাখেনি বাংলাদেশ। আজ (মঙ্গলবার) ওমানের মাসকটে যুব এশিয়া কাপ হকিতে থাইল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ। নতুন ইতিহাস রচনার পর অধিনায়ক মেহরাব হাসান সামিন মুঠোফোনে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়েরকে।
অভিনন্দন। প্রথমবার বাংলাদেশ হকিতে বিশ্বকাপ খেলবে। আপনার নেতৃত্বে সেই যোগ্যতা অর্জন করল। অনুভূতি কেমন?
মেহরাব হাসান সামিন : এটা জীবনের সেরা অনুভূতি। বাংলাদেশ একটি খেলায় বিশ্বকাপে খেলবে। আমার অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ সেই খেলা নিশ্চিত করল। এটা ক্রীড়াবিদ হিসেবে অনেক বড় সম্মানের। এর কৃতিত্ব আমার টিমমেটদের দিতে চাই। তাদের অনেক ত্যাগের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। নাহলে হতো না।
ফুটবল, ক্রিকেটের বাইরে দেশের অন্য সকল খেলার খেলোয়াড়রা নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে খেলেন। আপনাদের এই দলের সেক্রিফাইসের গল্পটা কেমন?
মেহরাব হাসান সামিন : ক্যাম্প চলাকালে আমরা হাত খরচ পাই মাত্র ৪০০ টাকা। মাসে হাজার ১২ হয়। এক জোড়া ভালো বুটের দামই ১৮ হাজার টাকা। আমার সহ-অধিনায়ক সারা মাসের টাকা জমিয়ে বুট কিনেছিল। পরে চিন্তা করে দেখল এত টাকার বুট পড়বে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বিক্রিই করে দেয়। এ রকম পরিস্থিতি আমাদের ছিল।
আমাদের বয়স এখন ২০ প্লাস। আমাদের অনেককেই পরিবারকেও সাহায্য করতে হয়। সীমিত আয়ে সেভাবে সম্ভবও হয় না। এরপরও আমাদের সকল খেলোয়াড়দের মনোযোগ খেলার দিকেই ছিল। দেশকে বিশ্বকাপের মঞ্চে নেব এবং শেষ পর্যন্ত পেরেছি।
আপনারা দেশের জন্য খেলেন। এরপরও এত কম সুযোগ-সুবিধা এবং প্রতিবন্ধকতা পেরিয়েও স্বীকৃতি কম কষ্ট লাগে না।
মেহরাব হাসান সামিন : আমাদের ফেডারেশনের আর্থিক সঙ্কট। কোনো স্পন্সর নেই, আবার সরকারও তেমন অর্থ দেয় না। আমাদের ক্যাম্পই চালায় অনেক কষ্ট করে ফলে তাদের কাছ থেকে আমরা আর্থিকভাবে খুব বেশি কিছুর প্রত্যাশা করি না। আমাদের প্রত্যয় ছিল একটা ভালো ফলাফল করার যাতে সবাই হকির দিকে আকৃষ্ট হয় এবং পৃষ্ঠপোষকতা আসে। আমরাও আর্থিক এবং সামাজিক আরও মর্যাদা পাই। বিশ্বকাপ নিশ্চিতের মাধ্যমে আশা করি সেটা সম্ভব হবে।
জুনিয়র এশিয়া কাপের আগের পর্ব ছিল এএইচএফ কাপ। সিঙ্গাপুরে সেই টুর্নামেন্টে আপনারা আবাসন, খাবার অনেক সমস্যার মধ্যেই ছিলেন।
মেহরাব হাসান সামিন : অনেক কষ্টের মধ্যেও ফেডারেশন আমাদের সিঙ্গাপুর পাঠিয়েছিল। একটু কষ্ট হয়েছে অবশ্যই। এক রুমে ছয় সাত জন ছিলাম। একটির ওপর আরেকটি বেড। খাওয়াতেও কিছুটা কষ্ট ছিল। দেশে অনুশীলনের সময় আমাদের পকেট মানি চারশ আর বিদেশে আসলে সেটা মাত্র এক হাজার।
এএইচএফ কাপের পর জুনিয়র এশিয়া কাপের আগে আপনাদের কোচের বদল হয়েছে। কোচ বদলে আপনাদের খেলায় কোনো প্রভাব পড়েছে কি?
মেহরাব হাসান সামিন : কোচ নিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। যেই আসুক আমাদের খেলা আমাদেরই খেলতে হবে। কাকে কোচ করবে সেটা ফেডারেশনের বিষয় আমাদের নয়।
সিঙ্গাপুরে যখন এএইচএফ কাপ খেলতে যান। তখন কি ভেবেছিলেন শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ নিশ্চিত করতে পারবেন?
মেহরাব হাসান সামিন : এটা আসলে লম্বা জার্নি। যুব বিশ্বকাপ খেলতে দু’টি টুর্নামেন্টের দুটি ধাপ পার হতে হয়েছে। আমাদের সবারই স্বপ্ন ছিল বিশ্বকাপে খেলার। তবে দুই টুর্নামেন্টের শুরুতে ঐ টুর্নামেন্ট নিয়েই প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল।
ওমানে প্রথম ম্যাচে স্বাগতিকদের হারিয়ে শুরু করলেন। পরের ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৬-০ গোলের হার। এরপর আবার ঘুরে দাঁড়ালেন কিভাবে?
মেহরাব হাসান সামিন : পাকিস্তান অনেক ভালো দল। সিনিয়র দলের কয়েকজন রয়েছে এই দলেও। আমরা বড় ব্যবধানে হারের পর স্বাভাবিকভাবেই মন খারাপ ছিল। আমাদের ফিরে আসার সামর্থ্য রয়েছে এটা সবার মনে ছিল। এজন্য পরের ম্যাচই মালয়েশিয়াকে রুখে দিয়েছি। মালয়েশিয়া অত্যন্ত ভালো দল। চীনের ম্যাচটি আমাদের জয় পাওয়া উচিত ছিল।
বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো যুব হকির বিশ্বকাপ খেলছে এটা ক্রীড়াঙ্গনের অত্যন্ত গর্বের ও আনন্দের। বাংলাদেশের যুব পর্যায়ে হকির মান উন্নয়ন হয়েছে নাকি আন্তর্জাতিক হকি ফেডারেশন এশিয়ার কোটা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ সুযোগ পেল বিশ্বকাপে।
মেহরাব হাসান সামিন : বাস্তবিক ও যৌক্তিক প্রশ্ন। আমার দৃষ্টিতেই দু’টিই। এশিয়ার কোটা বৃদ্ধি অবশ্যই আমাদের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক। পাশাপাশি আমাদের খেলোয়াড়দের মানও ভালো। ওমান হকিতে অনেক বিনিয়োগ করছে। স্বাগতিক দেশ তাদের আমরা হারিয়েছি। চীন, মালয়েশিয়ার বিপক্ষে ড্র আমাদের খেলোয়াড়দের মান নির্দেশ করে।
আব্দুস সাদেক, মামুনর রশীদ, মাহবুব হারুন, জামাল হায়দারের মতো তারকা ও কিংবদন্তীরা যুব বিশ্বকাপে খেলতে পারেনি। আপনারা সেদিক থেকে নিজেদের সৌভাগ্যবান বলবেন?
মেহরাব হাসান সামিন : তারা অবশ্যই কিংবদন্তী। আমাদের অনেকেরই তারা আইডল, আইকন এবং গুরুও। আমরাও নিজেদের সেরাটা দিয়ে দেশকে সর্বোচ্চ সম্মান দিতে চাই।
সম্প্রতি নারী ফুটবল দল সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সরকার, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অনেক আর্থিক পুরস্কার প্রদান করেছে। আপনারা কি প্রত্যাশা করছেন?
মেহরাব হাসান সামিন : অবশ্যই আমরা সংবর্ধনা প্রত্যাশা করছি। যুব বিশ্বকাপে প্রথমবার খেলা নিশ্চিত করা ক্রীড়াঙ্গনের বিশেষ অর্জন। এর স্বীকৃতি পেলে আমরা আরও বেশি উদ্বুদ্ধ হব।
আগামী বছর ডিসেম্বরে যুব হকির বিশ্বকাপ। এক বছর কিভাবে প্রস্তুতি নিতে চান।
মেহরাব হাসান সামিন : আমাদের ক্যাম্প যেন তারাতারি হয়। এই এশিয়া কাপের আগে প্রস্তুতি ম্যাচ পাইনি। বিশ্বকাপ খেলবে ইউরোপের অনেক দেশই। তাদের সম্পর্কে ধারণা নেই। ইউটিউবে খেলা দেখা এক রকম আর নিজেরা খেলা আরেক রকম। আমরা চাই বিশ্বকাপের আগে বিদেশে গিয়ে প্রস্তুতি ও অনেক ম্যাচ খেলার সুযোগ। পাশাপাশি আমাদের সুযোগ-সুবিধাও বৃদ্ধির অনুরোধ থাকবে।
ফেডারেশনে নতুন কমিটি এসেছে। নতুন কমিটিকে আপনারা সাফল্য উপহার দিলেন। তাদের কাছে প্রত্যাশা কি?
মেহরাব হাসান সামিন : আমাদের হকি লিগ অনিয়মিত। আমরা চাই লিগটি নিয়মিত হোক। সিনিয়রদের সঙ্গে খেললে আমরা আরো বেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারব।
খেলোয়াড় হিসেবে আপনার ক্যারিয়ার নিয়ে স্বপ্ন...
মেহরাব হাসান সামিন : আমার স্বপ্ন বাংলাদেশ যেন অলিম্পিকেও খেলতে পারে। আমরা একবার যুব অলিম্পিকে ফাইভ এ সাইডে খেলেছি। স্বপ্ন দেখি মূল অলিম্পিকে খেলার।
মূল অলিম্পিকের আগে সিনিয়র দলের হকি বিশ্বকাপের স্বপ্নটা আরও বাস্তবিক নয়?
মেহরাব হাসান সামিন : আমরা যেমন পেরেছি, আমাদের সিনিয়র দলেরও সামর্থ্য রয়েছে বিশ্বকাপে খেলার কিন্তু তারা খেলার মধ্যেই থাকে না। এশিয়ান গেমসের পর খেলা নেই। খেলা না থাকলে আনফিট থাকবে পারফরম্যান্স খারাপ হবে। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে ফলাফল খারাপ হলে র্যাকিংও নিচে নামবে।
ক্রিকেটে অধিনায়কের যেমন ভূমিকা ফুটবল, হকি মাঠে তেমন নয়। এরপরও আপনার দায়িত্ব এবং চাপ কেমন ছিল?
মেহরাব হাসান সামিন : হকিতে মাঠে কোচই সিদ্ধান্ত নেন। অধিনায়ক মূলত খেলোয়াড়-কোচ-অফিসিয়ালের সেতুবন্ধন। খেলোয়াড়রা অনেক চাহিদার কথা আমাকে জানালে আমি কোচ, ম্যানেজারকে জানাই। আবার অনেক সময় কোচও আমাকে বাড়তি কাজ দেয়। আমাদেও কোচিং স্টাফ স্বল্প। তাই স্যার অনেক সময় আমাকে ডিফেন্সের বিষয়টি দেখতে বলেছে। যতটা পেরেছি সহযোগিতার চেষ্টা করেছি। ওমানে একটি ম্যাচে ম্যান অফ দ্য ম্যাচও হয়েছি।
হকিতে আসলেন কীভাবে?
মেহরাব হাসান সামিন : আমার বাবা ফুটবল খেলতেন। আমার পরিবারে খেলাধূলা পেশা হিসেবে নেওয়া আমিই প্রথম। ২০১৪ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই পথচলা শুরু। ২০২১ সালে বিকেএসপি পর্ব শেষ হয়েছে। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন নিয়ে পড়ছি।
বিশ্বকাপ নিশ্চিত করার পর এখন নিশ্চয়ই ক্যাম্পাসে আপনার তারকাখ্যাতি বাড়বে।
মেহরাব হাসান সামিন : সত্যিকার অর্থে হকিতে সেই লেভেলে ধরে না সাধারণ জনজীবনে। এতে খারাপ তো কিছুটা লাগেই। এখন আশা করি এর কিছু পরিবর্তন হবে।
আগামীকাল আবার চীনের বিপক্ষে পঞ্চম স্থানের ম্যাচ।
মেহরাব হাসান সামিন : গ্রুপ পর্যায়ে হারাতে পারিনি। আগামীকাল চীনকে হারিয়ে পঞ্চম হয়েই দেশে ফিরতে চাই। সবাই দোয়া করবেন আমাদের জন্য।
এজেড/এফআই