হকি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ, ‘স্বপ্ন নয়–সত্যি ও বাস্তব’
বাংলাদেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় খেলা হকি। বিশ্বকাপ পর্যায়ে খেলার সামর্থ্য বাংলাদেশ হকির রয়েছে। সামর্থ্য থাকলেও পরিকল্পনা-সাধ্য ও বাস্তবায়ন নানা বিষয় মিলিয়ে এতদিন স্বপ্নই ছিল। আজ (মঙ্গলবার) ওমানের মাসকাটে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২১ থাইল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো যুব হকি বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত করেছে।
ওমানে বাংলাদেশ অ-২১ দলে ম্যানেজার হিসেবে আছেন ফেডারেশনের অ্যাডহক কমিটির সদস্য ও সাবেক কোচ কাওসার আলী। বাংলাদেশ হকির কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব ওমান থেকে বেশ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেন, ‘জীবনের প্রায় সায়াহ্নে এসে দারুণ এক মুহূর্তের সাক্ষী হলাম। বাংলাদেশ হকিতে বিশ্বকাপ খেলবে এটা এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। আমাদের ছেলেরা এটা প্রমাণ করেছে তারা খেলতে পারে। এটা সম্ভব হয়েছে ছেলেদের পারফরম্যান্স, ফেডারেশনের পরিকল্পনা ও কোচিং স্টাফদের পরিশ্রমের কারণেই।’
অ-২১ হকি দলের সঙ্গে কয়েক মাস আগেই হেড কোচের দায়িত্বে ছিলেন সাবেক জাতীয় খেলোয়াড় মোহাম্মদ আশিকুজ্জামান। সিঙ্গাপুরে এএইচএফ কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে জুনিয়র এশিয়া কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তাই খেলোয়াড়দের খুব কাছ থেকে দেখা আশিকের পর্যবেক্ষণ, ‘ছেলেরা অনেক কষ্ট করেছে দেশের জন্য। অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও তারা দেশের জয়ের জন্য নিজেদের উজাড় করেছে।’
২০১৭ সালে যুব অলিম্পিকে বাংলাদেশ ফাইভ এ সাইড হকিতে খেলেছিল। ১৯৭৭ সাল থেকে যুব হকি খেলা বাংলাদেশের কখনোই বিশ্বকাপ খেলা হয়নি। ফেডারেশনের অ্যাডহক কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশের হয়ে প্রথম যুব বিশ্বকাপ বাছাই খেলা দলের অধিনায়ক হাসান ইমাম চৌধুরি সান্টা বলেন, ‘১৯৭৭ সালে মালয়েশিয়ায় আমরা এশিয়ার ১২ দলের মধ্যে পঞ্চম হয়েছিলাম। চতুর্থ হলে পরের বছর প্যারিসে যুব বিশ্বকাপ খেলতে পারতাম। আমরা না পারলেও চার যুগ পর বাংলাদেশ যুব বিশ্বকাপ খেলছে, এটা দেখতে পারছি এটাই বড় প্রাপ্তি।’
আশি-নব্বই দশকে বাংলাদেশের কয়েকজন খেলোয়াড় ছিলেন এশিয়ান মানের। জুম্মন লুসাই, রফিকুল ইসলাম কামাল, মামুনুর রশীদদের সময়ে বাংলাদেশ যুব বিশ্বকাপ খেলতে পারেনি। এর কারণ সম্পর্কে কামাল বলেন, ‘আমরা ১৯৯৬ সালে খুব ভালো দল ছিলাম। যুব এশিয়া কাপের সেমিফাইনাল হেরে বিশ্বকাপ মিস করি। সেই সময় বিশ্বকাপে এশিয়ার কোটা কম ছিল, আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতাও ছিল একটু বেশি।’
আগে যুব বিশ্বকাপে ১৬ দল অংশগ্রহণ করত। হকির বিশ্বায়নের জন্য আন্তর্জাতিক হকি ফেডারেশন সেই সংখ্যা বৃদ্ধি করে ২৪–উন্নীত করেছে। এতে কোটা বেড়েছে এশিয়ারও। ফলে জুনিয়র এশিয়া কাপে ছয়ের মধ্যে থাকলেই বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ মিলছে। বাংলাদেশ হকিতে জুনিয়র এশিয়া কাপে ষষ্ঠ স্থানেই থাকে অধিকাংশ সময়। ফলে এবার বিশ্বকাপ খেলা অনেকটাই অনুমেয় ছিল।
নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশে ফুটবলের পরই জনপ্রিয় খেলা ছিল হকি। হালের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেটের অবস্থান ছিল তৃতীয়। কালের বিবর্তনে হকি এখন বেশ পিছিয়ে। ক্লাব-ফেডারেশন দ্বন্দ্ব , সংগঠকদের অদূরদর্শিতা ও নানা কারণ রয়েছে হকির পিছিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে। না হলে বাংলাদেশ হকি সিনিয়র বিশ্বকাপেও খেলার সম্ভাবনা ও সামর্থ্য ছিল।
জাতীয় দলের সাবেক তারকা খেলোয়াড় ও দেশের অন্যতম সেরা কোচ মামুনুর রশীদ বলেন, ‘হকি ফেডারেশন সঠিক পরিকল্পনা ও দক্ষ নেতৃত্ব থাকলে সিনিয়র বিশ্বকাপ খেলাও সম্ভব। এজন্য দরকার সমন্বিত উদ্যোগ ও একাগ্রতা।’ হকি ছাড়াও ফুটবল, ক্রিকেটেও বাংলাদেশ যুব পর্যায়ে সফল হলেও সিনিয়র দলে অতটা সফল নয়। এই প্রসঙ্গে অ-২১ দলের সাবেক কোচ আশিকুজ্জামানের পর্যবেক্ষণ, ‘বিভিন্ন খেলার বয়সভিত্তিক পর্যায়ে আমাদের বয়স লুকানোর সংস্কৃতি রয়েছে। অন্য দেশের খেলোয়াড়রা পরিপক্ব ও মান উন্নত করে সিনিয়র দলে খেলে। আমাদের দেশের বিভিন্ন খেলায় যুব পর্যায়ের সাফল্যে তুষ্ট হয়ে উন্নতির মাত্রা তেমন হয় না। ফলে সিনিয়র দলে মানগত ঘাটতি থেকেই যায়। তবে হকিতে বিগত সময়ের খেলোয়াড়দের মান বর্তমানদের চেয়ে ভালো ছিল।’
আগামী বছর ভারতে অনুষ্ঠিত হবে যুব বিশ্বকাপ। সেই বিশ্বকাপে এশিয়ার বাইরে ইউরোপ ও অন্য মহাদেশের শক্তিশালী দলগুলো খেলবে। এজন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ কামালের, ‘বিশ্বকাপে খেলছি এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের। বিশ্বকাপে যেন আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও মান বজায় রাখতে পারি এজন্য ফেডারেশনকে এখন থেকেই পরিকল্পনা করতে হবে। ফেডারেশনের পাশাপাশি সরকার ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসতে হবে সহায়তার জন্য।’
কামালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মামুন যুব বিশ্বকাপকে বাংলাদেশ হকির টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচনা করতে চান। তার মতে, ‘বাংলাদেশ হকির অনেক সমস্যা-সংকট রয়েছে। সেগুলো দূরে ঠেলে এই সাফল্যকে সামনে রেখে আমাদের চলা উচিৎ।’
এজেড/এএইচএস