ট্যাকটিক্স পোস্টমর্টেম: মালদ্বীপকে কেন হারাতে পারল না বাংলাদেশ
মালদ্বীপ ১ - ০ বাংলাদেশ
র্যাঙ্কিং পার্থক্য যতটাই হোক, কিংস অ্যারেনায় মালদ্বীপের বিপক্ষে বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচটায় খেলতে নেমেছিল ফেবারিট হয়েই। বিগত ১ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ম্যাচে নেই মালদ্বীপ, নিজ দেশেও নেই লিগের প্রচলন। নেই ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি। সঙ্গে কিংস অ্যারেনার অতীত রেকর্ড আর ঘরের সমর্থন তো ছিলই বাংলাদেশের পক্ষে। তবু পরাজিত দলটার নাম বাংলাদেশ।
বুধবার সন্ধ্যায় আলী ফাসিরের একমাত্র গোল হয়েছিল বাংলাদেশ-মালদ্বীপ ম্যাচের ব্যবধান। কিন্তু ম্যাচের বাকি সবই ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। আক্রমণ, গোলমুখে শট কিংবা মাঝমাঠে আধিপত্য সবখানে বাংলাদেশই ছিল এগিয়ে। হ্যাভিয়ের ক্যারবেরার দল তবে হারল কোথায়?
গোল্ডেন জোনে ব্যর্থ মোরসালিন
হালের বাংলাদেশ দলে সবচেয়ে বড় পোস্টার অবশ্যই শেখ মোরসালিন। ২০২৩ সালে এই তরুণের অন্তর্ভুক্তি জাতীয় দলে দিয়েছিল ভিন্ন মাত্রা। গেল বছর ১৩ ম্যাচে ১৩ গোল পেয়েছিল টিম বাংলাদেশ। যেখানে মোরসালিনের উপস্থিতি ছিল দারুণ। কখনো ডামি রানার হয়ে, কখনো সরাসরি গোলে অবদান রেখে নিজেকে করেছিলেন বিশ্বস্ততার প্রতীক।
ক্যারবেরা এই ম্যাচে বিগত বছরের মতোই মোরসালিনকে রেখেছিলেন ৪-৪-২ ডায়মন্ড ফর্মেশনের চূড়ায়। যেখানে তার মূল কাজ ছিল ক্লাসিক্যাল নাম্বার টেন আর খেলতে হয়েছিল ‘জোন ১৪’ তে। কিন্তু ফুটবল মাঠের এই গোল্ডেন জোনে এসে যেন গতকাল অনেকটা সময় খুঁজে পাওয়া যায়নি মোরসালিনকে।
হোল্ডিং পজিশনে থাকা হৃদয় যেমন ব্যর্থ হয়েছেন মোরসালিনকে সাহায্য করতে, তেমনি ডান ও বামপ্রান্তে থাকা কাজেম-সোহেল রানারা মূলত ব্যস্ত ছিলেন রাকিব-ফাহিমের সঙ্গে জুটি গড়তে। ফুটবলের ‘গোল্ডেন জোন’ নামে পরিচিত ডি-বক্সের ঠিক বাইরে মোরসালিন থাকলেন অনেকটা সময় নিষ্ক্রিয় হয়ে। যদিও তিন বদলি খেলোয়াড় নামার পর মোরসালিন ঠিকই ম্যাচে ফিরেছিলেন স্বরূপে। যদিও ততক্ষণে দেরি হয়ে যায় অনেকখানি।
ক্রস ও কাটব্যাকে দুর্বলতা
বাংলাদেশ দলে এই মুহূর্তে বল পায়ে ড্রিবলের দিক থেকে রাকিব বাকিদের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে সে কথা স্বীকার করতেই হয়। ডানপ্রান্ত থেকে গতকালের ম্যাচে একাধিকবার ঝড় তুলেছেন। ফাহিমও ছিলেন স্বপ্রতিভ। তবে মালদ্বীপের দুই সেন্টার ব্যাকের কাছে বারবার আটকাতে হয়েছে তাদের। নিজেরা বক্সে ঢুকতে ব্যর্থ হয়েছেন সত্য, তেমনি কিছুটা পিছিয়ে এসে পাসিং কিংবা ক্রস করাতেও ছিলেন ব্যর্থ।
পুরো ম্যাচে একাধিকবার সুযোগ পেলেও বাংলাদেশ প্রথম সফল ক্রস করে তিন বদলি খেলোয়াড় মাঠে নামার পর। ১৫তম মিনিটে ফয়সাল ফাহিমের ক্রসের পর আরেকটি সফল ক্রস পেতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ৭০ মিনিট পর্যন্ত। ইমনের সেই হেডও চলে যায় বারপোস্টের বাইরে দিয়ে। ম্যাচের মাঝের সময়টায় উইং আর আক্রমণভাগের সমন্বয়হীনতা বারবারই চোখে পড়েছে।
ফরোয়ার্ড লাইনে খেলা রাকিব এবং ফাহিম দুজনেই মূলত উইঙ্গার। তাদের পা থেকে তেমন কাটব্যাক পাস কিংবা বক্সে জায়গা করতে না পারা বাংলাদেশের আক্রমণকে পিছিয়ে দিয়েছে বারবার। এরসঙ্গে ছিল গোল মিসের মহড়া।
গোল করবেন কে?
শেষ ৭ ম্যাচে ১ গোল। আরও সহজভাবে বললে পুরো বছরে বাংলাদেশের গোল কেবল ১টি। ভুটানের বিপক্ষে সেই গোলটাও মূলত এসেছিল গোলরক্ষকের হাত ফসকে যাওয়া বল থেকে। বাংলাদেশের ফুটবলে অন্তত এই বছরে গোল করার মতো অবস্থা যেন নেই কেউই।
মালদ্বীপ যেখানে নিজেদের প্রথম সুযোগেই গোল আদায় করেছে, সেখানে বাংলাদেশ মিস করেছে একের পর এক সহজ সুযোগ। ম্যাচশেষে কোচ ক্যারবেরা যেমনটা বলছিলেন, ‘আমাদের ৩/৪ গোলে জেতা উচিত ছিল। বাংলাদেশ জাতীয় দল, অনূর্ধ্ব-২৩ দল—যতগুলো ম্যাচে আমি কোচ ছিলাম, আমি মনে করি, এ ম্যাচেই আমার দল সবচেয়ে বেশি গোলের সুযোগ তৈরি করেছিল।’
কিন্তু গোল মিসের উৎসবই যেন কাল করেছিল বাংলাদেশ। অন্তত শেষ ১০ মিনিটেই ৫টি নিশ্চিত গোলের সুযোগ হারিয়েছে পুরো দলের সদস্যরা। যে তালিকায় তপু বর্মন থেকে শুরু করে শেখ মোরসালিন কিংবা ইমন সকলেই ছিলেন।
আরও একবার সেটপিস দুর্বলতা
কোচ ক্যারবেরার কথাই আবার আনতে হচ্ছে। ম্যাচশেষে নিজের দলের সেটপিস দূর্বলতা নিয়ে এই কোচের সরল বক্তব্য, ‘আমরা বারবার সেট পিসে গোল খাচ্ছি। ভুটানের বিপক্ষে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচেও এমনভাবে গোল খেয়েছিলাম। এই একটা জায়গায় বারবার শিখিয়েও কাজ হচ্ছে না। ব্যাপারটা দুশ্চিন্তা ও হতাশার।’
মালদ্বীপের আলী ফাসিরের ওই গোলে বাংলাদেশের অন্তত দুজন ডিফেন্ডার ছিলেন পুরোপুরি ভুল পজিশনে। শাকিল ব্যর্থ হয়েছেন মালদ্বীপের অভিজ্ঞ ফরোয়ার্ডকে নজরে রাখতে। অনেকটা প্র্যাকটিস সেশনের মতো করেই লাফিয়ে উঠে আলী ফাসির বাংলাদেশের জালে বল জড়ান।
আর ঠিক কবে বাংলাদেশ এই সমস্যা থেকে সেরে উঠবে সেই প্রশ্নের উত্তর হয়ত ফুটবল ভক্তদের মতো জানা নেই কোচ ক্যারবেরার নিজেরও।
জেএ/এইচজেএস