ডিএফএ : ভোটে আছে, খেলায় নেই
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাচন আসন্ন। সেই নির্বাচনে অন্যতম বড় প্রভাবক হবেন জেলা-বিভাগীয় ফুটবল এসোসিয়েশনের ৭২ জন কাউন্সিলর। অথচ প্রতিটি জেলা-বিভাগে হয় না নিয়মিত লিগ, এমনিক বাফুফেও জেলাগুলোর জন্য আয়োজন করতে পারে না জেলা চ্যাম্পিয়নশিপ।
হকি, সাঁতার, অ্যথলেটিক্সসহ অনেক ফেডারেশনের গঠনতন্ত্রে রয়েছে ফেডারেশনের চার বছর মেয়াদে অন্তত দুইবার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করতে হবে। দুই বার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ না করলে কাউন্সিলরশীপ/ভোটাধিকার থাকবে না। দেশের অন্যতম শীর্ষ ফেডারেশন হয়ে বাফুফের গঠনতন্ত্রে সেই ধারা নেই। গঠনতন্ত্রের ২১ ধারার সি ও ডি উপধারায় বলা হয়েছে শুধু, প্রতি জেলা ও বিভাগীয় ফুটবল এসোসিয়েশন থেকে একজন করে ডেলিগেট হবেন।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে জেলা-বিভাগীয় পর্যায়ে জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা সকল খেলা পরিচালনা করে আসছিল। ২০০৭ সালের পর বাফুফে ফিফার নির্দেশনা দেখিয়ে জেলা-বিভাগীয় পর্যায়ে আলাদা সংগঠন করে ‘জেলা ফুটবল এসোসিয়েশন’ ও ‘বিভাগীয় ফুটবল এসোসিয়েশন'। এরপর থেকে জেলা-বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা ফুটবল আয়োজন করে না। জেলা-বিভাগীয় ফুটবল এসোসিয়েশনের ওপরই মূলত দায়িত্ব ফুটবল আয়োজনের। জেলা ফুটবল এসোসিয়েশন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের আওতায় নেই ফলে সরকারি অর্থ অনুদান পায় না। বাফুফের অধীভুক্ত হলেও বাফুফেও আর্থিক সহায়তা দিতে পারে না। জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের নেই নিজস্ব স্থাপনাও। জেলা ক্রীড়া সংস্থা বা স্টেডিয়ামের দুই একটি কক্ষে কোনো রকম চলে আসছে এই অফিস।
বাস্তবিক অর্থে খেলার চেয়ে ভোটই যেন মূখ্য হিসেবে দেখছেন ময়মনসিংহ বিভাগীয় ফুটবল এসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল্লাহ ফুয়াদ রেদোয়ান, 'জেলা-বিভাগের ফুটবলের দুরবস্থার জন্য সম্পূর্ণ অর্থে বাফুফে দায়ী। জেলা ক্রীড়া সংস্থার অধীনেই সারা দেশে ফুটবল এত বছর ভালো চলেছে। তারা ফুটবলকে আলাদা করলেও চর্চা করেনি। নিজেরা ফিফা-এএফসি থেকে অর্থ পেলেও জেলা-বিভাগে দেয় না।’
জেলা-বিভাগে ফুটবল পরিচালনার জন্য বাফুফে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে কয়েক লাখ টাকা করে দিয়েছিল। যদিও ফুটবলাঙ্গনের অনেকের ধারণা, সেই অর্থ ২০২০ সালের নির্বাচন সামনে রেখেই দেয়া হয়েছিল। এর আগে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের সাবেক সভাপতি মঞ্জুর কাদের জেলা ফুটবল লিগ কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় বেশ কয়েক জেলায় দুই-এক বছর লিগ হয়েছিল। এরপর বাফুফে সভাপতির সঙ্গে মনোমালিন্যে মঞ্জুর কাদের আর উদ্যোগ নেননি। বাফুফের কাছে মঞ্জুর কাদেরের এখনো অর্ধ কোটি টাকার বেশি পাওনা রয়েছে।
মাস দুয়েক আগে বাফুফেই একটি তালিকা করেছে গত পাঁচ-ছয় বছরে কোন জেলায় ফুটবল লিগ হয়েছে। ২০১৮-২৪ পর্যন্ত সেই তালিকায় প্রতি বছর লিগ হয়েছে এমন একটি জেলাও নেই। যদিও মাঝে করোনা মহামারি ছিল। নিয়মিত জেলা আয়োজনের মধ্যে রয়েছে শুধু সিলেট, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ফুটবল এসোসিয়েশন। নীলফামারী ও নরসিংদী বাফুফের নিয়মিত লিগের তালিকায় না থাকলেও এই দুই জেলার ফুটবল এসোসিয়েশনের সভাপতি নিশ্চিত করেছেন তারা নিয়মিত আয়োজন করেন। বাফুফের তথ্য অনুযায়ী ছয় বছরে মাত্র একটি লিগ আয়োজন করেছে মুন্সিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ। গাজীপুর সেটাও করেনি। বাকি জেলাগুলোর মধ্যে ৬ বছরে ২-৩ বার করেছে অধিকাংশ।
জেলা পর্যায়ে লিগ আয়োজন হয় না। আবার ফেডারেশন সকল জেলা নিয়েও কোনো টুর্নামেন্ট করে না। এরপরও সবাই ভোটার। বিষয়টি একটু দৃষ্টিকটুই মনে করছেন বাফুফের পদত্যাগ করা সদস্য ও নীলফামারী জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের সভাপতি আরিফ হোসেন মুন, 'বাফুফে, ডিএফএ সকল সংগঠনের মূল উদ্দেশ্যই খেলা আয়োজন। সেই খেলাই যদি আয়োজন না হয় তাহলে সেখানে কাউন্সিলর বা ভোটাধিকার থাকাটা দৃষ্টিকটুই।’
আশি-নব্বইয়ের দশকে শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দী কাপ অত্যন্ত জমজমাট হতো। এখন আর বাফুফে জাতীয় পর্যায়ে সেই রকম আয়োজন করে না। কাজী সালাউদ্দিন ২০০৮ সালে বাফুফে সভাপতি হওয়ার পরের বছর সকল জেলা নিয়ে ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপ করেছিলেন। সেটা কিছুটা সাড়া ফেললেও পরবর্তীতে আর ধারাবাহিকতা ছিল না। সাবেক ফুটবলার বিজন বড়ুয়া কক্সবাজার জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি ছিলেন। ২০১২ থেকে এখন পর্যন্ত নির্বাহী কমিটির সদস্য বাফুফের। এক যুগ বাফুফেতে থাকলেও তিনি নিশ্চিতভাবে মনে করতে পারছেন না কয় বার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ হয়েছে, ‘জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় আমরা করতে পারি না। এটা আসলেই দুঃখজনক। এক যুগে মনে হয় না ২-৩ বারের বেশি হয়েছে অথচ এটি প্রত্যেক বছর হওয়া দরকার।’
জেলা-বিভাগের দিকে বাফুফের মনোযোগ নেই। শুধু ভোটের সময় তাদের কদর বাড়ে। যদিও ফুটবলাঙ্গনের অভিযোগ, অনেক জেলা-বিভাগ থেকে বাফুফের প্রভাবশালীরা নিজেদের ইচ্ছেমতো পছন্দের ব্যক্তিকেই কাউন্সিলর করে নেন। জেলা-বিভাগীয় ফুটবল এসোসিয়েশনের নির্বাচনও তাই প্রশ্নবিদ্ধ হয় নানা প্রভাবে। জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জেলা ক্রীড়া সংস্থা থেকে দু’জন সদস্য মনোনীত হবে। এবার মুন্সিগঞ্জ জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের নির্বাচনে মুন্সিগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থা কোনো চিঠিই পায়নি। এ রকম অভিযোগ ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হয় অনেক জেলা-বিভাগ ফুটবল এসোসিয়েশনে। বাফুফে কর্তা ব্যক্তিরা এসব অভিযোগ আমলে নেন না।
বাফুফে জেলা-বিভাগীয় ফুটবল এসোসিয়েশনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য ডিএফএ মনিটরিং কমিটি করেছিল। সাবেক সংসদ সদস্য ও বাফুফের তৎকালীন নির্বাহী সদস্য শামসুল হক চৌধুরি সেই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। যদিও সেই কমিটি তেমন কাজ করেনি। এরপরও নামসর্বস্ব একটি কমিটি ছিল। কাজী সালাউদ্দিনের চতুর্থ মেয়াদে সেই কমিটিও নেই। সালাউদ্দিন নিজেই জেলা ফুটবল লিগ কমিটির চেয়ারম্যান হলেও গত দুই বছরে কোনো সভা করেননি।
৫ আগস্ট পরবর্তী উদ্ভুত পরিস্থিতিতে জেলা-বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা ভেঙেছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। জেলা ফুটবল এসোসিয়েশন মন্ত্রণালয়ের আওতায় না থাকায় সেই কমিটি এখনো বহাল আছে। জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের মনোনীত ব্যক্তি বাফুফের নির্বাচনে ভোটাধিকার পাবেন। জেলা ফুটবল এসোসিয়েশন থেকে ডেলিগেট হয়ে আসতে হলে সেই ব্যক্তিকে জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের সাধারণ পরিষদের সদস্য হতে হবে। জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনকে একটি সভার মাধ্যমে ডেলিগেট নির্ধারণ করতে হয়। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে অনেক জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের অনেক কর্মকর্তা অগোচরে। এই পরিস্থিতিতে বাফুফের নির্বাচনে ডেলিগেট নির্ধারন নিয়ে ফুটবলাঙ্গনে খানিকটা কৌতুহল তৈরি হয়েছে।
জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের গঠনতন্ত্রে বাফুফে সভাপতি দুজন সাধারণ পরিষদে সদস্য মনোনয়নের এখতিয়ার আছে। ডিএফএ’র গঠনতন্ত্রে রয়েছে সরকারের কোনো পদে আছেন এমন কেউ জেলা পর্যায়ে নির্বাচন করতে পারবে না। অথচ বাফুফের নির্বাহী কমিটিতে আবার ঠিকই সরকারি পদে থাকা ব্যক্তিরা নির্বাচন করছেন।
ময়মনসিংহ বিভাগীয় ফুটবল এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি রেদোয়ান ডিএফএ’র গঠনতন্ত্র নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন, ‘ডিএফএ’র গঠনতন্ত্রে বেশ কিছু বিষয় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। খেলা পরিচালনার দিকে বাফুফে ডিএফএকে তেমন চাপ দেয় না অথচ নির্বাচন ও অন্য সংক্রান্ত বিষয়ে বেশ নজরদারি রাখে। ডিএফএ’র ক্ষেত্রে এমনটি করলেও ক্লাবের নির্বাচন ও গঠনতন্ত্রে বাফুফের নিয়ন্ত্রণ নেই। এখানে একটা সামঞ্জস্য প্রয়োজন।’
এজেড/এইচজেএস