আরমানিটোলায় সর্বোচ্চ শ্রদ্ধায় বিদায় ফজলুর
শতবর্ষী আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় আজ ছুটি ছিল। ওস্তাদ ফজলুর প্রয়াণের খবর শুনে হাজির হয়েছেন স্কুলের বর্তমান, সাবেক শিক্ষার্থী, শিক্ষক, জাতীয় পর্যায়ের হকি অঙ্গনের সবাই। আরমানিটোলা স্কুলের কোল ঘেষেই তারা মসজিদ। বাদ আসর নামাজ শেষে আরমানিটোলা স্কুলের হকি টার্ফ প্রাঙ্গনে হয় ফজলুর জানাজা। হকির টার্ফ পূর্ণ হয়ে কেন্দ্রীয় মাঠের অর্ধেক পর্যন্ত মানুষ ছিল। ক্রীড়াঙ্গনে কোনো ব্যক্তির জানাজায় এত লোকের উপস্থিতি চোখে পড়েনি সাম্প্রতিক সময়ে।
বাংলাদেশের হকির অন্যতম আতুড়ঘর আরমানিটোলা স্কুল। এই স্কুলেই মূলত এলাকা ও বিদ্যালয়ের বাচ্চাদের হকি শেখাতেন ফজলু। স্কুলের সাবেক ক্রীড়া শিক্ষক খন্দকার রফিকুল ইসলাম ফজলুর সম্পৃক্ততা ও অবদান সম্পর্কে বলেন, '১৯৯২ সাল থেকে আমি স্কুলে ক্রীড়া শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করি। ফজলুও তখন থেকে এই স্কুলে হকি শেখায়। অদ্যাবধি শিখিয়ে গেছে। স্কুলের সঙ্গে তার আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক না থাকলেও আত্নার সম্পর্ক ছিল। আরমানিটোলা স্কুল ও ফজলু যেন ওতপ্রোত অংশ।'
আরমানিটোলা স্কুলে রয়েছে বিশাল মাঠ। সেই মাঠের পাশে হকি ফেডারেশন পুরাতন টার্ফ দিয়েছে কয়েক বছর আগে। সেই টার্ফেই ওস্তাদ ফজলু হকি একাডেমী গড়ে তুলেছিলেন। কাল থেকে আর ওস্তাদ বল, স্টিক নিয়ে খেলা শেখাবেন না। এটা ভেবে অঝোরে কাদছিলেন স্কুলের ও একাডেমীর অনেক শিক্ষার্থী।
ওস্তাদের ফজলুকে শেষ এক ঝলক দেখতে এসেছিলেন বাংলাদেশ ওয়ানডের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান মেহরাব হোসেন অপি। তার জীবনের সঙ্গেও মিশে আছেন ফজলু, 'এই স্কুলের মাঠে একটি প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট ম্যাচে আমি প্রথম নেমেছিলাম। তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। ৫১ রান করে ম্যাচ সেরা হয়েছিলাম। ওস্তাদ ফজলু আমাকে হকির একটি মেডেল দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন, 'তুমি একদিন অনেক বড় খেলোয়াড় হবে।' আজ বারবার এই কথা মনে পড়ছে।'
বাংলাদেশের হকির অন্যতম সেরা খেলোয়াড়দের একজন কামরুল ইসলাম কিসমত। তিনি ফজলুকে আখ্যায়িত করলেন বিশেষভাবে, 'কোচ অনেক আছে, হতেও পারে, তবে ওস্তাদ সবাই হতে পারে না। ফজলু আসলেই ওস্তাদ ছিলেন।' কিসমত যখন এই মন্তব্য করছিলেন তখন পাশেই ছিলেন হকির অন্যতম কিংবদন্তী খেলোয়াড় ও কোচ মামুনুর রশীদ। তিনিও পূর্ণ সমর্থন করলেন, 'আসলেই কিসমত ভাই একেবারে যথার্থ বলেছেন। আমরা অনেকেই রয়েছি, কোচ তবে ফজলু ভাই আসলেই ওস্তাদ।'
পুরান ঢাকার অন্যতম কৃতি ক্রীড়াবিদ হকির তারকা খেলোয়াড় রাসেল মাহমুদ জিমি। তিনিও বিশাল শূন্যতা অনুভব করছেন, 'তিনি শুধু আমার ওস্তাদই নন। আমার সাথে পারিবারিক সম্পর্কও রয়েছে। তিনি আমার বাবার কাছ থেকে খেলা শিখছেন। আমার সাথে পারিবারিক সম্পর্ক। প্রতি ঈদে তিনি আমাদের বাসায় যেতেন। পরিবারের সদস্যই ছিলেন।'
ওস্তাদ ফজলু গত কয়েক বছর আগে ব্রেন স্ট্রোক করেছিলেন। চিকিৎসার পর সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরলেও গত কয়েক দিন আবার হঠাৎ অসলগ্ন কথা বলছিলেন। সাবেক জাতীয় খেলোয়াড় রফিকুল ইসলাম কামাল আকস্মিক অসংলগ্নতা সম্পর্কে বলেন, 'হঠাৎ দিন চারেক আগে বলছিল, 'আমার একাডেমী থাকবে তো? আমি কি মাঠে যাব?' কেন জানি অজানা শঙ্কা ভর করছিল। আমি তার মেয়েকে চিকিৎসকের কাছে নিতে বলছিলাম আর লাকীকে (আম্পায়ার) বলছিলাম, 'তুই ওস্তাদকে মাঠে নিয়ে যা। লাকী এই কয়েকদিন তার সঙ্গে ছিল।'
পুরান ঢাকার অন্যতম সংস্কৃতি হকি। সেই সংস্কৃতি ধরে রেখেছিলেন ফজলু। তার স্মৃতি ও হকির কার্যক্রম চলমান রাখার তাগিদ সাবেক হকি খেলোয়াড় তারেক আদেলের কন্ঠে, 'এখন আমাদের সবার দায়িত্ব ওস্তাদ ফজলুর একাডেমী চলমান রাখা। আমাদের কাজের মাধ্যমে তাকে বাচিয়ে রাখতে হবে।'
জানাজার আগে সামান্য স্মৃতিচারণে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে দাবি উঠে ফজলু একাডেমীর পক্ষ থেকে আরমানিটোলা স্কুলে হকির কার্যক্রম আম্পায়ার সেলিম লাকীকে চালিয়ে যাওয়ার। আম্পায়ার সেলিম লাকী গত কয়েকদিন ফজলুর সঙ্গে জড়িত ছিলেন ওতপ্রোতভাবে, 'ওস্তাদ ফজলু বংশ পরম্পরায় পুরান ঢাকায় হকি নিয়ে কাজ করছে। আমার পর আমার ছেলেও তার কাছে হকি শিখছে। আমার ছোট্ট বাচ্চাও কাঁদছে।'
স্মৃতিচারণ শেষে জানাজার শেষভাগে এসে উপস্থিত হন জাতীয় দলের আরেক সাবেক ক্রিকেটার জাভেদ ওমর বেলিম। ক্রিকেটার হলেও হকির পরিবেশেই বেড়ে উঠা জাভেদ ওমরের। তাই ফজলুর সঙ্গে অনেক সখ্যতা। অগ্রজকে অনুভব ও মূল্যায়ন করলেন এভাবে, 'সে মোটামুটি ভালো খেলোয়াড়ই ছিলেন। এরপরও জাতীয় দলে খেলতে পারেননি। তাই একটা আক্ষেপ ছিল। সেই তাড়না থেকেই বোধ হয় অনেক জাতীয় খেলোয়াড়ের জন্ম হয়েছে তার মাধ্যমে। মানুষের সঙ্গে মিশতে অনেক পছন্দ করত। যেই অনুষ্ঠানে দেখা হতো বলত আসো ছবি তুলি। মিস করব অনেক।'
জাতীয় দলে খেলতে পারেননি ফজলু। তার অন্তিম যাত্রায় তাই মরদেহের ওপর বাংলাদেশের পতাকা দিয়েছেন রফিকুল ইসলাম কামাল ও রাসেল মাহমুদ জিমি। কিংবদন্তী ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব না হয়েও সর্বোচ্চ সম্মান ও ভালোবাসায় আরমানিটোলা থেকে প্রস্থান হয়েছে ফজলুর।
এজেড/এইচজেএস