কেমন ছিল নতুন বিসিবি সভাপতির প্রথম দিন
দেশের ক্ষমতার পালাবদলের হাওয়া যে বাংলাদেশ ক্রিকেটের গায়ে লাগবে সেটা এক প্রকার অনুমিতই ছিল। গত ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে নাজমুল হাসানের পাপনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই গুঞ্জন ছিল বিসিবি থেকে সরে যাবেন পাপন। গেল সপ্তাহেই জানা গিয়েছিল পদত্যাগ করতে রাজি আছেন তিনি। এর সপ্তাহখানেক পর আজ আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতির পদ থেকে সরে গেলেন তিনি।
আর পদত্যাগের পরই দেশের ১৫তম বিসিবি সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন ফারুক আহমেদ। সকালে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রালয়ের সভাকক্ষে আলোচনায় বসেন দেশে থাকা বিসিবির পরিচালকরা। এ সময় ফারুককে সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করে উপস্থিত বোর্ড পরিচালকরা। দায়িত্ব গ্রহণের ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই সাবেক এই অধিনায়ক পা রাখেন মিরপুরের সবুজ গালিচায়।
ফারুক আহমেদ মিরপুরে এসেছেন অসংখ্যবার। তবে আজকের আসাটা তার জন্য ছিল অন্যরকম। কেননা সভাপতি হয়ে আজই প্রথমবার এসেছিলেন বিসিবি কার্যালয়ে। প্রাইভেট কার থেকে নেমে সবার সাথে কুশল বিনিময় শেষে কিছুক্ষণ পরই চলে আসেন শের-ই বাংলার প্রেস কনফারেন্স রুমে। এরপর শুরুতেই কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে দাঁড়িয়ে ১ মিনিট নিরবতা পালন করেন তিনি। এরপরই শুরু হয় সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তর পর্ব।
ক্রিকেটসহ নানা বিষয় উঠে আসে সংবাদ সম্মেলনে। অনিয়ম, সুযোগ সুবিধা, জাতীয় দলের ক্রিকেটার, কোচসহ আরও নানান প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন নতুন বিসিবি সভাপতি। বর্তমান প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে নিয়ে যে প্রশ্ন আসবে সেটা একপ্রকার নিশ্চিতই ছিল। সেই প্রশ্নের উত্তরে অবশ্য আগের অবস্থানের কথাই বললেন ফারুক।
তিনি বলছিলেন, 'চন্ডিকা হাথুরুসিংহের চুক্তি কতদিন আমি আসলে জানি না। তবে আমি আমার আগের অবস্থানেই আছি (হাথুরুর বিদায় চান)। এখন যেহেতু আমি দায়িত্ব পেয়েছি। এখন আমি বিকল্প খুঁজবো, তার চাইতে বেটার কাউকে পাই কি না, কাছাকাছি মানের কাউকে পাওয়া যায় কি না এসব দেখবো। এরপর বাকিদের সাথে আলাপ করবো, সিইও আছেন, আগে যারা কাজ করেছেন তাদের সাথে কথা বলে নেবো। তারপরে...আসলে আমি ওই অবস্থান থেকে সরিনি এখনো।'
এরপর স্থানীয় কোচদের প্রসঙ্গে ফারুক বলেন, ‘লোকাল কোচ আমার মনে হয় খুব ভালো আছে। তবে আমিই একমাত্র ডিসিশন মেকার হওয়া উচিত নয়। হয়তো আমার ওপর দায়িত্বটা বেশি। কারণ, আমি সিদ্ধান্ত নেব। কিন্তু অন্যদের সঙ্গেও কথা বলতে হবে।’
বছর খানেক ধরে তামিম ইকবালকে নিয়ে জলঘোলা কম হয়নি। নতুন বিসিবি সভাপতি ফারুক অবশ্য তামিমের ক্রিকেটে ফেরার কথা জানিয়ে বলেন, ‘আপনি যদি আমাকে বলেন আমি দেখতে চাই তামিম আরও দুই তিন বছর খেলবে। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। আমার ব্যক্তিগত অভিমতে কিন্তু কিছু যায় আসে না। ওর ফিটনেস হবে, টিমে আসতে হলে কী করতে হবে; যে বিভাগুলো আছে। সভাপতি হিসেবে অফ দ্য রেকর্ড যদি জিজ্ঞেস করেন, আমি কিন্তু দেখতে চাই আরও দুই বছর ক্রিকেট খেলুক। আমি চাই আর কী।’
তামিম যদি বোর্ডে আসেন তাতেও আপত্তি নেই বোর্ড সভাপতির, ‘কোন ফরম্যাটে খেলবে, আমার মনে হয় ৫০ ওভার বেস্ট। লঙ্গার ভার্শন সবচেয়ে ভালো হতো অভিজ্ঞতাসহ, কিন্তু এটার যে কষ্ট হয়তো ওর শরীর নিতে পারবে না। আমি জানি না। এটা তামিমই বলতে পারবে। খুব ভালো হয় যদি ও খেলতে পারে। আর যদি খেলতে না পারে, বোর্ডে আসে তাহলে আমি খুব খুশি হবো। কারণ আপনি দেখেন, তামিম আমার অন্তত বিশ বছরের ছোট হবে; যদি বেশি না হয়। কাছাকাছি হয়তো। সে সাবেক অধিনায়ক, তার মানে তার লিডারশিপ কোয়ালিটি আছে।’
‘এসব ছেলে যত আসবে, তাদের যদি আমরা তাড়াতাড়ি কাজে লাগাতে পারি; তাহলে কিন্তু অনেক আইডিয়া আসবে; অনেক ভালো কিছু করতে পারবে। দেখি ওর সঙ্গে কথা বলে ব্যক্তিগতভাবে, ওর পরিকল্পনা কী, এভাবে আমরা এগিয়ে যেতে পারি।-যোগ করেন তিনি।
বিসিবি সভাপতি আলাদা করে রিশাদ হোসেনকে প্রশংসায় ভাসালেন, ‘একটা প্রশ্ন আমি করব, আমার মনে হয় রিশাদ একজন ভালো ক্রিকেটার। সে কিন্তু লঙ্গার ভার্সনটা খুব ভালো খেলতে পারে। (দল গঠনে) এরকম সাজেশন থাকবে। আমার মনে হয় এই ছেলেটা আমাকে খুব ভালো ইমপ্রেস করেছে।’
‘আমার কাছে মনে হয়েছে ছেলেটা শেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে টপ স্পিন ও আর্ম বলের সঙ্গে টার্ন করাতে পেরেছে। যে কারণে আমার কাছে মনে হয়েছে সে টেস্ট ম্যাচ অথবা এইচপি....(দলে খেলতে পারে)। আমি জানিনা ও ‘এ’ টিমে খেলতে গেছে কি না। অন্য যেকোনো একটা লেভেলে লেগ স্পিনারদের অনেক বল করতে হয়। সেজন্য এরকম সাজেশন আর কি।’
এদিকে, টাইগার অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে নিয়ে নতুন সভাপতি বলেন, ‘সাকিবের ব্যাপারে পলিসি কী হওয়া উচিত, সেটা বোর্ডের সঙ্গে আলাপ করব। সাকিব এখন যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থা সে চালিয়ে যেতে পারবে কি না বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করব। আমাদের এখন দুটি টেস্ট ম্যাচ আছে। তারপরে কী হবে, সেটা তখন বোর্ডের একটা পলিসির ব্যাপার হবে।’
তিনি বলেন, ‘সবার আগে আমি যদি চিন্তা করি, আমি বাংলাদেশি এবং পরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল- আমার দল তাহলে কিন্তু আমরা অনেক সমস্যা থেকে বের হতে পারবো। তখন এখানে কোনো ব্যক্তিগত পছন্দ থাকবে না। তখন কোন ব্যক্তিগত এজেন্ডা থাকবে না। দেখবেন সব ইন প্লেস হবে। তার মানে আমাদের দেশ এবং আমাদের দল সবার আগে। তারপরে ইন্ডিভিজুয়ালগুলো ফিট ইন করবে।’
‘আমি সবাইকে এই বার্তা পরিষ্কারভাবে দিতে চাই- আমি যদি দেশ ও দলের কথা চিন্তা করি, তখন কিন্তু অন্য জায়গাগুলো গৌণ হয়ে যাবে। এ পছন্দের, ও পছন্দের এটা কমে যাবে।’
বিসিবিতে দুর্নীতি নির্মূল করতে চান নতুন সভাপতি। তিনি বলেন, প্রতিটা সেক্টরে এমন দুর্নীতি হয়েছে বাংলাদেশে। এটা আমরা সবাই জানি। আমরা তো সবাই বাংলাদেশেরই মানুষ। এক্ষেত্রেও কিন্তু, প্রতিটা সংগঠনে যেমন দুর্নীতির কথা শুনেছি; ক্রিকেট বোর্ড এটার বাইরে না। যদি এরকম কিছু থাকে, এটা আমরা লুক আফটার করবো। আমরা দেখবো জিনিসটা কী হয়েছে। আগামীতে দুর্নীতি পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না। এটা কেউ যদি বলে, আমি তার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করবো না। কিন্তু একটা সিস্টেম চালু করতে হবে। যেখান থেকে আমরা এই জিনিসগুলো কমাতে পারবো। একসময় দুর্নীতমুক্ত একটা জায়গা পাবো।’
দীর্ঘ ৬৫ মিনিটের সংবাদ সম্মেলন শেষ করে প্রেস কনফারেন্স রুম ছাড়েন ফারুক আহমেদ। এরপর মিরপুরের সবুজ গালিচায় পা রেখে মাঠকর্মীদের সাথে কুশল বিনিময় করেন নতুন এই বিসিবি বস। পরক্ষণেই জড়ো হন সব মাঠকর্মীরা। এরপর সবার সাথে দাঁড়িয়ে গ্রুপ ছবিও তুলেন দেশের ক্রিকেটের সাবেক এই অধিনায়ক।
এসএইচ/এফআই