ঐতিহাসিক, নান্দনিক ও বিড়ম্বনার উদ্বোধন!
তখন প্যারিস সময় বিকেল পাঁচটা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের এক ভলান্টিয়ার এসে অতি পাতলা একটি রেইনকোট দিলেন। মিডিয়া ট্রিবিউনের উৎসুক এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, ‘বৃষ্টির সম্ভাবনা কেমন?’ ফরাসি বালকের সোজা সাপ্টা জবাব– ‘সন্ধ্যা ৭টা থেকে টানা ২৪ ঘণ্টা বৃষ্টি।’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরুর আগেই দর্শক, সাংবাদিক সবার গায়ে সাদা রঙের রেইনকোট। বৃষ্টি থেকে শুধু রেহাই পেয়েছিলেন ভিভিআইপি শেডে থাকা মাত্র শ’খানেক লোক। এদের মধ্যে আছেন ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) সভাপতি টমাস বাথ, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রো–সহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। তাদের একটু সামনেই একই স্ট্যান্ডে থাকা অন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবৃন্দ ঠিকই ভিজছিলেন।
সিন নদীর তীরে রাস্তায় দর্শক ছিলেন লাখ খানেক। নদীর ওপরই অবস্থিত আইফেল টাওয়ারের সামনের রাস্তায় করা হয়েছে আরেকটি মঞ্চ। সেই মঞ্চের দুই দিকেও ছিলেন দর্শক। প্রতি গ্যালারীতেই ছিল জায়ান্ট স্ক্রিন। এক জায়গায় একসঙ্গে সকল কর্মকাণ্ড না হওয়ায় দর্শকদের স্ক্রিনের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয়েছে অধিকাংশ সময়। বৃষ্টির তীব্রতা মাঝে-মধ্যে এত বেশি হয়েছে যে, ছাতায় ছেয়ে গেছে পুরো গ্যালারি। টানা চার ঘণ্টা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অনুষ্ঠান দেখা বেশ ঝক্কি-ঝামেলারই বটে।
একটি প্রোমো দিয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরু। ফ্রান্স ফুটবলের কিংবদন্তি জিনেদিন জিদান হাতের মশাল দেখিয়ে সিন নদীকে কানেক্ট করা হয়। সেই প্রোমো চলার ফাঁকেই শুরু হয় মার্চ পাস্ট। আধুনিক অলিম্পিকের জন্ম গ্রীসে। তাই গ্রীস দিয়েই শুরু হয় মার্চ পাস্ট। এরপরই আসে শরণার্থী দল। যারা অলিম্পিকের নামেই গেমসে অংশগ্রহণ করছে। সিন নদীতে জাহাজ-নৌকা করে মার্চ পাস্ট করেছে দলগুলো। যা অলিম্পিকের উদ্বোধনী ইতিহাসে বিশেষ নতুনত্ব।
মার্চ পাস্টের মধ্যেই আবার সেই মশাল নিয়ে প্রোমো চলতে থাকে। সেই প্রোমোতে ফ্রান্সের ঐতিহাসিক স্থাপনা, বিশেষত্ব অনেক কিছুই ফুটিয়ে তোলা হয়। প্রোমোর মধ্যে আবার মার্চ পাস্ট দেখানো হয়। বড় কন্টিনজেন্টের দেশগুলো ছিল জাহাজে। ছোট কন্টিনজেন্টের কয়েকটি দেশ একটি জাহাজে বা ছোট নৌকায় মার্চ পাস্টে ছিলেন।
বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদ মাত্র পাঁচ জন। এরপরও বাংলাদেশ একটি আলাদা ছোট্ট নৌকা পেয়েছে। আয়োজকরা সেই নৌকায় বাংলাদেশকে দশ জনের কোটা বেধে দিয়েছিল। সেই দশজনের মধ্যে বাংলাদেশের চার ক্রীড়াবিদ, এক কোচ ও পাঁচ জন কর্মকর্তা ছিলেন। শ্যুটার রবিউল ছাড়া বাকি চার ক্রীড়াবিদই মার্চ পাস্টে ছিলেন। শ্যুটিং প্যারিসের বাইরে থাকায় রবিউল ও তার কোচ ছিলেন না। আরচ্যার সাগর ইসলামের হাতে ছিল বাংলাদেশের পতাকা। সাগর ছিলেন এক পাশে কোনায় পতাকা নিয়ে আরেক পাশে ছিলেন নারী সাঁতারু সোনিয়া। আরেক সাঁতারু রাফি ছিলেন প্রথম সারির একটু পেছনে। দ্রুততম মানব ইমরানুর রহমানের অবস্থান হয়েছে দুই কর্মকর্তার পেছনে।
শেফ দ্য মিশন ইন্তেখাবুল হামিদ ও পতাকা বহন করা সাগর ইসলামের পাশে সামনের সারিতে থাকাই যৌক্তিক। তার পাশে ছিলেন ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক ও বিওএ উপমহাসচিব নজীব আহমেদ। তার একটু পেছনে শ্যুটিং ফেডারেশনের সভাপতি আতাউল হাকিম। যদিও বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের প্যারিস অলিম্পিক-পূর্ব আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশিত কন্টিনজেন্ট তালিকায় তার নামটি ছিল না।
গেমসের মার্চ পাস্টের মূল আকর্ষণ ক্রীড়াবিদ ও কোচ। বাংলাদেশ মার্চ পাস্টে কোচ না পাঠিয়ে কর্মকর্তারা ছিলেন। অ্যাথলেটিক্সে কোচ আনুষ্ঠানিকভাবে দলের সঙ্গে নেই, সাঁতারে কোচ আব্দুল হামিদ থেকেও সিন নদীর নৌকায় ঠাঁই পাননি। সাধারণ সম্পাদক এমবি সাইফ ছিলেন মার্চ পাস্টে। গেমসের মার্চ পাস্টে ভারত, ভুটানসহ অনেক দেশই নিজস্ব সংস্কৃতির পোষাক পরেছে। বাংলাদেশ পুরুষ ক্রীড়াবিদ, কোচ ও কর্মকর্তারা চিরাচরিত কোট-প্যান্ট পরে গেমসের মার্চ পাস্টে অংশ নেন। বাংলাদেশের সংস্কৃতি মেনে অবশ্য শাড়ী পরেন নারী ক্রীড়াবিদ ও কোচ। তার ওপর ছিল কোটও।
আরও পড়ুন
মার্চ পাস্টের মধ্যেই চলেছে নাচ-গান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সুন্দর গান-নাচ হলেও বেসুরো বৃষ্টিতে সবই বেরসিক। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের টিকিট পাওয়া ছিল দুষ্কর। অনেক চড়া দাম দিয়ে (বাংলাদেশি টাকায় কয়েক লাখ টাকা) টিকিট কিনেও বৃষ্টির কাছে পরাজিত হয়ে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন অনেকেই। সাংবাদিকদের ভোগান্তি ছিল সবচেয়ে বেশি। মিডিয়া ট্রিবিউন ছিল খোলা আকাশের নিচে। তাই বৃষ্টির মধ্যে ল্যাপটপ, মোবাইল ও ক্যামেরা বের করে কাজ করা সম্ভব ছিল না। অনেকে বাধ্য হয়ে অনুষ্ঠানস্থল থেকে মিডিয়া সেন্টারে গিয়ে টিভি স্ক্রিন দেখেই প্রতিবেদন করেছেন। অনেক সাংবাদিক ফ্রান্সের এই আয়োজন নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন, ‘এই বৃষ্টিতে ঠান্ডা-জ্বর হলে ক্রীড়াবিদদের পারফরম্যান্সের প্রভাব পড়লে পদকের ক্ষেত্রেও ফ্যাক্টর হবে।’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শক-সাংবাদিকদের বিড়ম্বনা হলেও, টিভি পর্দায় থাকা দর্শকরা অবশ্য দারুণ উপভোগ করেছেন। তাদের অনেকের দৃষ্টিতে অলিম্পিক ইতিহাসে অন্যতম সেরা উদ্বোধন এটি। নান্দনিকতা, আধুনিকত্ব, ইতিহাস, আলো-আধারের খেলা ও জিরো কার্বন সবকিছু মিলিয়ে প্যারিস অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধন ক্রীড়াপ্রেমীদের মন কাড়লেও বৃষ্টির বাগড়া পরিপূর্ণতা দিতে দেয়নি।
গতকাল গেমস উদ্বোধনে সবচেয়ে সুন্দর মুহুর্ত দুই কিংবদন্তির মেলবন্ধন। ফ্রান্সের ফুটবলার জিনেদিন জিদান ও স্পেনের টেনিস তারকা রাফায়েল নাদাল একে অন্যের হাত থেকে গেমসের মশাল নেওয়ার সময় জড়িয়ে ধরেন। ভ্রাতৃত্বের বন্ধনই গেমসের অন্যতম উদ্দেশ্য। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আইওসি সভাপতি টমাস বাথ-ও সেই বুলি আওড়িয়েছেন, ‘আমরা অলিম্পিকের মাধ্যমে সব বিশ্ব এক থাকব।’
এজেড/এএইচএস