‘৭-১’ ট্র্যাজেডির এক দশক, ব্রাজিলের ভুল কোথায় ছিল?
কোচ লুই ফিলিপ সোলারি সেদিন ঠিক কী ভাবে টিম হোটেলে ফিরেছিলেন সেটা জানার উপায় হয়ত নেই। ব্রাজিলের দলের কার কী অবস্থা হয়েছিল ২০১৪ সালের ৮ জুলাইয়ের পর থেকে তাও হয়ত জানার উপায় নেই। কিন্তু বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে যে ট্র্যাজিক ইভেন্ট ব্রাজিল নিজেদের মাটিতে দেখেছিল, সেই ধ্বংসস্তুপ থেকে আজ পর্যন্ত আর ফেরা হয়নি তাদের। জার্মানির কাছে নিজেদের মাঠ বেলো হরিজেন্তে স্টেডিয়ামে ৭-১ গোলে হেরেছিল বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে।
সেই গোলের পর থেকেই ব্রাজিল ফুটবলে শুরু হয়েছে এক ধীরগতির পতন। যেখান থেকে আজও ফেরা হয়নি তাদের। প্রতিটি টুর্নামেন্ট ব্রাজিল শুরু করে ফেবারিটের তকমা নিয়ে। মাঝে দুইবার অলিম্পিক স্বর্ণপদক আর একটা কোপা আমেরিকাও জয় করেছিল তারা। কিন্তু, ব্রাজিল ফুটবলের চিরায়ত সৌন্দর্য্যের মৃত্যু হয়েছিল সেদিনের ওই এক ম্যাচে।
১৯৫০ সালের বিশ্বকাপের ফাইনাল ব্রাজিল খেলেছিল নিজেদের ঘরের মাঠে। ঐতিহাসিক মারাকানায় জয় পেলেই বিশ্বকাপ তাদের। এমন এক ম্যাচে ব্রাজিল হেরে যায় উরুগুয়ের কাছে। শোকে বিহ্বল ব্রাজিল সেদিনের পর বদলে ফেলেছিল নিজেদের জার্সি। সাদা থেকে ব্রাজিলের জার্সি হয়ে যায় হলুদ।
২০১৪ সেমিফাইনালের পর ঠিক তেমন কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন হয়নি ব্রাজিল ফুটবলে। কিন্তু কালের সাক্ষী হিসেবে ব্রাজিলের কপালে লেগে যায় ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে হারের তকমা। এখনো ২০১৪ বিশ্বকাপের কথা এলেই পোস্টার হয়ে থাকে বেলো হরিজেন্তে স্টেডিয়ামের সেই বিধ্বংসী রাত।
সেমিফাইনাল শুরুর আগেই ব্রাজিলের আত্মবিশ্বাস ছিল তুঙ্গে। ঘরের মাঠে বিপুল সমর্থন কাজে লাগিয়ে নিশ্চিত করবে বিশ্বকাপের ফাইনাল, এমনটাই ছিল অনুমান। শুরুটাও আক্রমণাত্মক। নেইমার জুনিয়র আর থিয়াগো সিলভার অনুপস্থিতিতে স্বাগতিকরা শুরু করেছিল আক্রমণ দিয়ে।
ম্যাচে জার্মানি প্রথম আক্রমণে ওঠে ১৩ মিনিটে। মার্সেলো বল কেড়ে নিতে গিয়ে পাঠিয়ে দেন গোললাইনের বাইরে। কে জানত, ওই মুহূর্তটাই ব্রাজিলের ফুটবলে ইতিহাস বদলে দিয়েছে পরের ১ দশকের জন্য। জানলে হয়ত মার্সেলো নিজেও বলটা ক্লিয়ার করতে চাইতেন না ওভাবে।
কর্ণার থেকে বল ক্লিয়ারের আশায় কাছের পোস্টে জড়ো হয়ে যান সবাই। দূরের পোস্টে চলে যায় বল। হালকা টাচে বল জালে জড়িয়ে দেন আনমার্কড থমাস মুলার। মিনিট খানেক পর ফার্নান্দিনহোর ভুল। সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্কোরশিটে নাম লেখান মিরস্লাভ ক্লোসা। ব্রাজিলের রোনালদো নাজারিওকে টপকে হয়ে যান বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা।
পরের ৭ মিনিটের মধ্যে জার্মানি আরও ৩ গোল করে। টনি ক্রুসের জোড়া গোল চলে আসে। গ্যালারিতে তখন অজস্র কান্নাভেজা চোখ। টনি ক্রুস, সামি খেদিরা, মেসুত ওজিলরা কোনো সুযোগই দেননি সেদিন। টিম প্লে আর পাসিং ফুটবলটা যেন শিখিয়ে দিচ্ছিলেন ব্রাজিলের ফুটবলারদের। প্রথমার্ধ শেষ হয় ৫ গোলে পিছিয়ে থেকে। ব্রাজিলের হার নিশ্চিত হয়ে যায় তখনই।
এরপরেও বেরসিকের মতো দ্বিতীয়ার্ধে দুই গোল করে বসেন আন্দ্রে শুরলা। নব্বই মিনিটে অস্কারের করা সেই গোল যেন ব্রাজিলের কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটে হয়ে থাকবে আজীবনের জন্য। ম্যাচ শেষ হয় ৭-১ স্কোরলাইনে। এক দশক পরেও যা ব্রাজিলকে পোড়ায় ব্যাপকভাবে।
এতগুলো বছর পর জার্মানির সেই দলের কোচ জোয়াকিম লো নিজেও এই জয়কে স্মরণ করেছেন। তার কাছে, এটাই ক্যারিয়ারের স্মরণীয় জয়। তবে সেদিন দ্বিতীয়ার্ধে আরও গোলের প্রত্যাশা ছিল তারও।
সোলারি এমন হারের পর ছেড়ে দিয়েছিলেন ব্রাজিলের দায়িত্ব। কদিন পর কোচিং ক্যারিয়ারটাই শেষ করেন। অস্কার, জুলিও সিজার, ফ্রেডদের মতো অনেকেই এরপর অনেকটা হারিয়ে গেলেন। নেইমারের বদলি হিসেবে সেই ম্যাচে ছিলেন বার্নাড। স্মৃতি মনে রাখেনি তাকেও। ফার্নান্দিনহোকে সেদিন দায় দেয়া হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। ম্যানসিটির হয়ে এরপর অনেক মনে রাখার মত মুহূর্ত উপহার দিলেও ব্রাজিলের হলুদে তাকে আর সেভাবে দেখা যায়নি।
সেদিন কী ভুল করেছিল ব্রাজিল?
এক দশক পার হয়ে গেলেও এখনো ফুটবল আর বিশ্বকাপের আলোচনায় থাকে ব্রাজিলের ৭-১ গোলে হারের সেই ম্যাচ। কিন্তু ঘরের মাঠে কী এমন ভুল করেছিল ব্রাজিল? সেটাই এখন পর্যন্ত বড় এক প্রশ্ন। ট্যাকটিকাল ভুলের পাশাপাশি মাঠে বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়ের পজিশন আর মুভমেন্ট সেদিন ডেকে এনেছিল লজ্জা।
ওপরের এই ছবিটি সেদিনের ম্যাচের প্রথম ৩০ মিনিটের গড় একটি চিত্র। ব্রাজিলের জন্য সেদিন সবচেয়ে বড় বিপদ ছিল ডাবল পিভট রোলে থাকা লুইজ গুস্তাভো এবং ফার্নান্দিনিয়োর মুভমেন্ট। মাইকন এবং মার্সেলো দুজনেই কিছুটা আক্রমণাত্মক মনোভাবের ছিলেন শুরু থেকেই। নেইমারের না থাকায় সেদিন মাইকনের কাঁধে ছিল বাড়তি দায়িত্ব।
সেই দায়িত্বের কারণেই কিছুটা ওপরে উঠে এসেছিলেন মাইকন। ওজিল এবং টনি ক্রুসের মতো দুই অসাধারণ প্রতিভাবান ফুটবলার এরই সুযোগ নিয়েছিলেন। দুই ডাবল পিভটের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন জার্মানির চার ক্রিয়েটিভ মিডফিল্ডার ক্রুস-ওজিল-খেদিরা এবং মুলার। সেই চাপটাই আর নিতে পারেননি ব্রাজিল। জার্মানির এই চারজনই ডেকে এনেছিলেন বড় বিপদ।
জার্মানি সেদিন একইসঙ্গে মাঠে প্রয়োগ করেছিল গ্রেগেনপ্রেসিং ও পজেশন ফুটবল। ফার্নান্দিনিয়োর ওপর প্রেসিং করে একাধিকবার তাকে ভুল করতে বাধ্য করেছিলেন ক্রুস ও খেদিরা। দান্তে নিজেও এর চাপ অনুভব করেছিলেন।
দান্তে সেদিন খেলেছিলেন থিয়াগো সিলভার বদলি হিসেবে। কিন্তু সাসপেনশনে থাকা সিলভার বিকল্প হতে পারেননি দান্তে। ওজিল ক্রুস আর সামি খেদিরা বেশ নাজুক অবস্থায় ফেলে দেন তাকে। সেই ম্যাচের পর দান্তের ক্যারিয়ারটাই আক্ষরিক অর্থে থেমে যায়। ব্রাজিল এতসব ভুলের মাশুল দেয় প্রথমার্ধে ৫ গোল হজম করে।
ব্রাজিল দলে তরুণ অনেকেই এসেছে। রদ্রিগো, ভিনিসিয়াস জুনিয়র, রাফিনহা, এন্ড্রিকরা এখন নতুন ব্রাজিলের প্রতিনিধি। কিন্তু ব্রাজিলকে আর পাওয়া যায়নি সেই আগের ছন্দে। ২০১৪ সালের আগে থেকেই ইউরোপিয়ান প্রতিপক্ষের কাছে হারের ঘটনা ছিল ব্রাজিলের নিয়তি। কিন্তু বেলো হরিজেন্তের সেই হার ছাপিয়ে গিয়েছে সবকিছু।
ব্রাজিলের ভক্তদের কাছে ৭-১ এ হার বিষাদের। তবে এই বিষাদ কেবল একদিনের জন্য না। বরং এক দশক আগে নিজেদের ফুটবলের সবচেয়ে বড় বাঁকবদল হিসেবেই ৮ জুলাই হাজির হয় ব্রাজিল ভক্তদের সামনে।
জেএ