চা বিক্রেতা মাকে নিয়েই সাগরের সংবর্ধনা
শেখ রাসেল রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্সে সবার মধ্যে একজনকে আলাদা করা গেল সহজেই। অতি সাধারণ এক সুতির কাপড়ে বসে আছেন চেয়ারে। তাকে ঘিরে আরচ্যারি অঙ্গনের অনেকেই। ৪৭ বছর বয়সী সেলিনার ছেলে সাগর ইসলামই যে মাত্র ১৭ বছর বয়সে প্যারিস অলিম্পিকে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে।
রাজশাহীতেই থাকেন স্বামীহারা সেলিনা। শহরে চায়ের দোকান করে পরিবারকে টানতেই দিন-মাস-বছর ফুরোয় তার। ঢাকায় আসা যেন তার জন্য বিলাসিতা। তবে দুই বার ঢাকায় এসেছেন। দুই বারই সাগরের জন্য। একবার এসেছিলেন ছেলের ইউরোপীয়ান ভিসা সংক্রান্ত কাজে। এবার এসেছেন ছেলের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে।
ঢাকায় এসে সংবর্ধনা মঞ্চে উঠেছেন। তাই বেশ গর্বিত সেলিনা, 'আজ আমার ছেলের জন্য মঞ্চে উঠার সুযোগ পেয়েছি। আমি খুবই খুশি। সবাই আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন। যেন সে আরো ভালো কিছু করতে পারে।’ সাগরও খুশি মাকে মঞ্চে উঠার সুযোগ করে দিতে পেরে, 'আমার বাবা নেই। মা অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছেন। মাকে খুশি করতে পেরেছি এবং এখানে আসার উপলক্ষ্য করে দিতে পেরে ভালো লাগছে।'
আরচ্যারি ফেডারেশন আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান তীর-সিটি গ্রুপ সাগরকে পাঁচ লক্ষ টাকা পুরস্কার প্রদান করেছেন। অল্প বয়সী সাগর আর্থিক পুরস্কার পেয়ে খানিকটা বিস্মিতই, 'জানতাম এত বড় পুরস্কার পাব। এই টাকা মায়ের সঙ্গে আলোচনা করেই ব্যয় করব। এখনো ঠিক করিনি কি করব।' সাগরের টাকা সাগরের জন্যই ব্যয় করার পরিকল্পনা মায়ের, 'টাকা সাগরের। এটা ওর জন্যই খরচ হবে। ওর খেলা বা ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন।'
মধ্যবয়সী একজন মহিলা রাস্তায় চা বিক্রি করা বাংলাদেশের সমাজে বেশ কষ্টকরই। তবে নিজের কাজে গর্বই করেন তিনি, 'এটাও অন্য দশটা কাজের মতোই কর্ম। মানুষ আমার কাছে চা-পানি, বিস্কুট চায়। আমি তাদের দিচ্ছি। বিক্রির মাধ্যমে আয় করছি।’ ছেলে অল্প কিছু দিন পরই অলিম্পিক খেলবে। অলিম্পিয়ানের মা হয়েও তিনি নিজের বর্তমান কাজই করে যেতে চান, 'আমি এই কাজটি ভালো জানি। এটাই করতে চাই। নতুন কিছু নয়।'
২৬ জুলাই প্যারিসের অলিম্পিকে শুরু হবে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের সর্ববৃহৎ আসর অলিম্পিক। আরচ্যারি ডিসিপ্লিনের খেলা এক দিন আগেই শুরু হবে। জার্মান কোচ মার্টিন ফ্রেডরিক সপ্তাহ খানেক আগেই প্যারিস যেতে চান, 'আবহাওয়া ও সামগ্রিক পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে ১৮-২০ জুলাইয়ের মধ্যে প্যারিস থাকতে চাই। এটা সাগরের অনুশীলনের জন্য ভালো হবে।' অলিম্পিক শুরু হতে মাত্র চার সপ্তাহ বাকি। সামনের এই সময়টুকু পুরোপুরি সাগরকে নিয়েই মনোযোগ মার্টিনের, 'অবশ্যই সামনের কিছু দিন সাগরকে নিয়েই কাজ করব। অনুশীলনে তার পার্টনারও লাগবে। আজ ফেডারেশনের সঙ্গে এ নিয়ে বিস্তারিতভাবে বসব।'
টোকিও অলিম্পিকে রোমান সানা সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। দিয়া ওয়াইল্ড কার্ড নিয়ে খেলেছেন। এবার শুধু সাগরই খেলতে যাচ্ছেন। আর কারো ওয়াইল্ড কার্ড পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। সরাসরি যোগ্যতা অর্জন করা সাগরের চোখ পদকের দিকেই, 'আমি শুধু এশিয়ার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে খেলার যোগ্যতা অর্জন করিনি, বিশ্বের সবার সঙ্গেই লড়েছি। সবার সঙ্গে লড়ে যদি কোটা অর্জন করতে পারি তাহলে পদক নয় কেন?’ দৃঢ় প্রত্যয় থাকলেও অলিম্পিকে বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন। এটাও মানেন এই আরচ্যার, 'প্রতি সেটে ২৮-৩০ স্কোর করতেই হবে। এ রকম করতে পারলে ভালো কিছু সম্ভব।' জার্মান কোচ মার্টিনের প্রত্যাশা খানিকটা বাস্তবিক, 'অলিম্পিক পর্যায়ে কোয়ার্টারে খেলাটাও ভালো ফলাফল। কারণ কোয়ার্টারে খেললে আপনি পদকের জোর সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে।'
সাগর ইসলামের এই সাফল্যের অন্যতম নেপথ্য আরচ্যারি ফেডারেশন। তারা নিয়মিত অনুশীলন ও বিদেশে টুর্নামেন্টে আরচ্যারদের পাঠানোয় মান উন্নত হয়েছে। আরচ্যার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রাজিবউদ্দিন আহমেদ চপল এই অর্জনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চান। ফেডারেশনের সভাপতি লে.জেনারেল মোঃ মইনুল ইসলাম (অব) গাজীপুরেই আরচ্যারির জন্য নতুন জায়গার ব্যাপারে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিবকে চিঠি দিয়েছেন। আরচ্যারির ফেডারেশনের পৃষ্ঠপোষক তীর গ্রুপের কর্মকর্তারাও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন টানা দুই অলিম্পিকে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করায়।
শেখ রাসেল রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্সে আরচ্যারি ফেডারেশন আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন হ্যান্ডবল, বক্সিং, জিমন্যাস্টিক্স সহ আরো কয়েকটি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকরা। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব আমিনুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন।
এজেড/এইচজেএস