এএফসিতে বাফুফে প্রতিনিধি, নেই বাংলাদেশি ক্লাব, সিদ্ধান্ত কার?
মানুষ ভুল শুধরে শিক্ষা নেয়। বাফুফে অবশ্য সেই পথের পথিক নয়। বিশেষ করে বাফুফের নারী উইং। গত বছর অলিম্পিক বাছাইয়ে নারী দল পাঠায়নি বাংলাদেশ। এত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নারী ফুটবল কমিটির আনুষ্ঠানিক সভা ছাড়াই হয়েছিল। ফেডারেশনের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন ও নারী উইংয়ের প্রধান মাহফুজা আক্তার কিরণ সম্মিলিতভাবে সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বছর ঘুরে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটাও নারী ফুটবল কমিটির সভা ছাড়াই। এএফসি থেকে বাংলাদেশের নারী ক্লাবের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার আমন্ত্রণ এসেছিল। বিষয়টি সভায় আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত না নিয়ে বাংলাদেশের কোন ক্লাবের নাম না প্রেরণের সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। এশিয়ার ২২টি দেশের একটি ক্লাব থাকলেও সেখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধি নেই।
মহিলা ফুটবল কমিটি ও বাফুফের অন্যতম নির্বাহী সদস্য আমের খান। তিনি এই বিষয়ে চরম হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা ফেডারেশনের কমিটিতে থেকেও জানতে পারি না কোথায় কোন আমন্ত্রণ আসে, কী হচ্ছে। গণমাধ্যম মারফত জেনেছি এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বাংলাদেশের নারী ক্লাবের খেলার সুযোগ এসেছিল। ব্যক্তিগতভাবে আমি অবশ্যই খেলার পক্ষে। ব্রাদার্স ক্লাব নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও যেমন অনূর্ধ্ব-১৮ লিগ খেলেছে। আমাদের মহিলা ফুটবল কমিটির সভায় বিষয়টি উঠলে অবশ্যই কোনো না কোনো পন্থা বের হতো, যাতে আমাদের মেয়েরা খেলার সুযোগ পেত।’
বিষয়টি ক্লাব সংক্রান্ত। এএফসি’র সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা ক্লাবকে অবহিত করাই ছিল বাফুফের দায়িত্ব। এরপর ক্লাব খেলবে কি খেলবে না সেটা তখন ক্লাবের দায় হতো। ক্লাবকে সিদ্ধান্ত না নেওয়ার সুযোগ দিয়ে উল্টো নিজেরাই না করে দিয়েছে ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
এবারের নারী ফুটবল লিগে চ্যাম্পিয়ন নাসরিন স্পোর্টস একাডেমি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেলতে এই দলের আর্থিক সামর্থ্য বাস্তবিক অর্থে নেই। অনেক সময় চ্যাম্পিয়ন দল না পারলে পরের স্থানে থাকা দল সুযোগ পায়। নারী লিগে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে আতাউর রহমান ভূঁইয়া কলেজ স্পোর্টিং ক্লাব। এই ক্লাবটি মূলত বাফুফের সহ-সভাপতি আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিকের। এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের বিষয়টি না জানায় আফসোস করছেন খোদ বাফুফে সহ-সভাপতি, ‘এই বিষয়টি আমরা জানতামই না। জানলে অবশ্যই চেষ্টা করা যেত।’
এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন প্রতিটি দেশের সর্বশেষ নারী লিগের চ্যাম্পিয়ন দলের নাম চেয়েছিল। এএফসি যখন নাম চেয়েছে তখন নারী লিগ চলমান ছিল। বাফুফের নারী উইং সভাও করেনি, এমনকি জানায়নি অংশগ্রহণকারী ক্লাবগুলোকে। গণমাধ্যম বিষয়টি জানার পর নারী উইংয়ের চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞেস করলে তখন নারী কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ গণমাধ্যমে দুই রকম ব্যাখ্যা দেন। প্রথম দফায় যুক্তি দেখিয়েছিলেন বাংলাদেশের নারী দলের লাইসেন্সিং নেই, তাই নাম দেওয়া যায়নি। অপেশাদার নেপাল, ভুটানের ক্লাবও খেলছে এটি ধরিয়ে দিলে তখন আবার আরেক যুক্তি দেখান তিনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের গত বছর লিগ হয়নি এবং এই বছর লিগ চলমান ছিল, তাই দল দেওয়া যায়নি। এই যুক্তিও ধোপে টেকেনি। এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন ওয়েবসাইটে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, থাইল্যান্ড ও হংকং লিগ চলমান থাকায় দল পরবর্তীতে নিশ্চিত হবে।
বাফুফের নারী উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ আবার এএফসি’র নির্বাহী কমিটির সদস্য। এএফসি’র নারী উইংয়ের চেয়ারম্যানও ছিলেন এক সময়। তাই এএফসি সংক্রান্ত বিষয় তিনি আগভোগেই অবগত হন। এএফসি মহিলা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সিদ্ধান্ত হয়েছে ২০২৩ সালের ১৪ আগস্টের সভায়। এতে উপস্থিত ছিলেন কিরণও। এক বছর আগে থেকে জেনেও বাংলাদেশের ক্লাবের যেন অংশগ্রহণ থাকে এমন কোনো উদ্যোগই নেননি তিনি। সেই উদ্যোগ না নিয়ে এখন যুক্তি দিচ্ছেন চলমান লিগ ও লাইসেন্সিংয়ের। যা একেবারে অপেশাদার ও অগ্রহণযোগ্য। এমন মন্তব্য বরং দায়িত্বে অবহেলার পাশাপাশি বাংলাদেশের ফুটবলের বঞ্চিতের বিষয়টিও ওঠে এসেছে।
মাহফুজা আক্তার কিরণ সাবেক ক্রীড়াবিদ কিংবা পুরোনো কোনো সংগঠক নন। ২০০৮ সাল পরবর্তী সময়ে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে তার ক্রীড়াঙ্গনে পরিচিতি। পরবর্তীতে বাফুফের মহিলা ফুটবল কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন। সিরাজুল ইসলাম বাচ্চুর মৃত্যুর পর চেয়ারম্যান হন কিরণ। বাফুফে নির্বাচিত সদস্যের পাশাপাশি কিরণ এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের সদস্য কয়েক মেয়াদে। বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফারও সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশে বিভিন্ন ফেডারেশনে নির্বাহী কমিটির কর্মকর্তারা স্বেচ্ছামূলক কাজ করেন। এএফসি, ফিফার কাউন্সিল সদস্যরা আর্থিক সম্মানীও পান, যা বাংলাদেশের অঙ্কে বেশ বড়ই। বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের অত্যন্ত আস্থাভাজন হওয়ায় মূলত তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিচরণ করছেন। তাই সাবেক ফুটবলার ও সংগঠকদের এ নিয়ে চাপা ক্ষোভ থাকলেও সালাউদ্দিনের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে নিশ্চুপই থাকেন।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অংশগ্রহণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সভা না ডাকলেও, আসন্ন ভুটান ম্যাচ নিয়ে ঠিকই আজ (বুধবার) সভা হয়েছে। এসব সভার সিদ্ধান্ত মূলত বাজেট অনুমোদনের জন্য। নামকাওয়াস্তের এই সভায় অরুচি ধরেছে বাফুফের দুই সদদ্যের। তারা আজ অনলাইন সভায় অংশগ্রহণ করেননি। এতে অবশ্য সিদ্ধান্ত থেমে থাকেনি, নারী দলের ১১-১৪ জুলাই উইন্ডোতে ভুটানে দুটি ম্যাচ খেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
নারী দলের ব্রিটিশ কোচ পিটার বাটলার উন্নত র্যাঙ্কিংয়ে থাকা দলের সঙ্গে খেলতে চান। সেখানে বাফুফের নারী উইং সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভুটানের বিপক্ষে খেলার। যারা দক্ষিণ এশিয়ার নারী ফুটবলে সবচেয়ে দুর্বল। ২০২২ সালে ছোটন নারী দলকে সাফ চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন। আসন্ন অক্টোবরে পিটার সেই শিরোপা ধরে রাখতে পারবেন কি না সেটাই দেখার বিষয়।
এজেড/এএইচএস