রেকর্ডময় গ্রুপপর্ব, যেভাবে রাজ করেছেন বোলাররা
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চলছে নাকি মিরপুরের শের-ই বাংলা স্টেডিয়ামে বসেছে কোনো বহুজাতি টুর্নামেন্ট? ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও যুক্তরাষ্ট্রে চলমান মেগা আসর দেখে এমন প্রশ্ন জাগতেই পারে। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তদের জন্য সুখবর– মিরপুরের বিতিকিচ্ছিরি স্মৃতিকে কিছু সময়ের জন্য হলেও মুক্তি দিয়েছে চলমান বিশ্বকাপ! বিগত আসরগুলোকে ছাড়িয়ে সবদিক থেকে এবার সর্বনিম্ন রানের রেকর্ড হয়েছে।
বিশ্বকাপের ছয়দিন আগে পর্দা নেমেছিল ২০২৪ আইপিএলের। যা দেখে অনেকেই ভেবেছিলেন এই বুঝি বোলারদের দিন ফুরিয়ে আসছে! বাঘা বাঘা বোলারদের নাভিশ্বাস উঠিয়ে চার-ছক্কার সব রেকর্ড তো ভেঙেছে-ই, রানের গণ্ডি আড়াইশ পেরিয়েছে ৮ বার। দুইশ রানও হয়েছে রেকর্ড সংখ্যক। প্রায় কাছাকাছি সময়ে হওয়া পিএসএল, বিপিএল, এসএ টি-টোয়েন্টি কিংবা বিগ ব্যাশ— এসব টুর্নামেন্টও খুব একটা পিছিয়ে ছিল না। এবার ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টগুলোর সঙ্গে চলমান বিশ্বকাপকে মেলান, মনে হচ্ছে না ভিন্ন জগতের কোনো টি-টোয়েন্টি দেখছি?
ক্রিকেট অজনপ্রিয় আমেরিকা কেমন বিশ্ব আসর উপহার দেয় তা নিয়ে আগ্রহ ছিল সবার। তাতে কতটা জল পড়েছে সেটিও ইতোমধ্যে জেনে ফেলার কথা। তবে অভিজ্ঞ ক্যারিবীয় দ্বীপগুলো কি ভিন্ন কিছু করেছে? তুলনামূলক দৃষ্টিতে দেখলে এখানে ম্যাচ আয়োজন থেকে শুরু করে রান ওঠা, সবমিলে ঢের এগিয়ে ক্রিস গেইল ও ড্যারেন সামিদের অঞ্চলটি। এখন পর্যন্ত টুর্নামেন্টের তিনটি ২০০ রানের ইনিংসই দেখা গেছে এখানে, তার মধ্যে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের করা ২১৮ রান তো পুরো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসেই সর্বোচ্চ।
২ জুন শুরু হওয়া বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব শেষ হয়েছে গতকাল (১৮ জুন)। প্রথমবারের মতো ২০ দলের এই আয়োজনে টিকে আছে আর কেবল ৮ প্রতিযোগী। বিদায় নিয়েছে সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও অন্যতম পরাশক্তি নিউজিল্যান্ডসহ ১২টি দেশ। আজ বুধবার (১৯ জুন) থেকে শুরু হতে যাওয়া সুপার এইট রাউন্ডের আগে দেখে নেওয়া যাক চলতি আসরে কেমন ভুগেছেন ব্যাটসম্যানরা। আর বোলাররাই বা কীভাবে রাজত্ব গড়েছেন ধারাবাহিকভাবে!
বোলারদের ‘স্বর্গরাজ্য’
গ্রুপ পর্বে ম্যাচ হয়েছে ৩৭টি, এর মধ্যে ১৩টি যুক্তরাষ্ট্রে আর ২৪ ম্যাচ ক্যারিবিয়ানে। রানও তুলনামূলক বেশি দেখা গেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বীপ দেশগুলোতে। তবে গ্রুপ পর্ব এক নজরে দেখলে বোঝা যাবে যে, এখানে কতটা রাজত্ব ছিল বোলারদের। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে রাজ করেছেন পেসাররা আর ওয়েস্ট ইন্ডিজে স্পিনারদের অধিপত্য। তাদের সামনে ব্যাটাররা ছিলেন জড়োসড়ো, বড্ড নড়বড়ে!
চলতি টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্বের রানরেট ছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ইতিহাসের সর্বনিম্ন। ৩৭ ম্যাচে রান হয়েছে ৬.৭১ গড়ে। এর আগে সর্বনিম্ন ৭.৪৩ রানরেট দেখা গিয়েছিল ২০২১ আসরে, সেটিও এবারের চেয়ে ওপরে। এ ছাড়া এবার উইকেট পড়েছে প্রতি ১৭.৮০ রানে একটি করে, এটি এই সংস্করণের বিশ্বকাপে সর্বনিম্ন রানে উইকেট পড়ার রেকর্ড। অথচ ২০১০ ও ২০২২ আসর ছিল এদিক থেকে সর্বনিম্ন (২১.৪২)।
— ESPNcricinfo (@ESPNcricinfo) June 19, 2024
যুক্তরাষ্ট্রের পিচগুলো ভালোই আতিথ্য দিয়েছে পেসারদের। নিউইয়র্ক, ডালাস ও ফ্লোরিডায় হওয়া ১৩ ম্যাচে পেসাররা ১৭.৫০ গড়ে রান দিয়ে ১২৫ উইকেট এবং স্পিনাররা ২১.৬ গড়ে ৩৪ উইকেট শিকার করেন। অন্যদিকে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ছয়টি ভেন্যু ছিল স্পিনারবান্ধব। সেখানে হওয়া ২৪ ম্যাচে ঘূর্ণি বোলাররা ১৯.৪৬ গড়ে ১১৬টি উইকেট নেন। এর মধ্যে ছিল একজন বোলারের পাঁচ উইকেট শিকারসহ ছয়বার চার উইকেট নেওয়ার কীর্তি।
ডট বলের বিশ্বকাপ
গ্রুপ পর্বের শেষদিকের ম্যাচে হয়েছে ডট বলের বিশ্বরেকর্ড। নিউজিল্যান্ডের পেসার লকি ফার্গুসন ৪ ওভারে সবকটি মেডেনসহ ৩ উইকেট নেন। পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে করা তার ২৪টি ডট বল বিশ্বকাপ ইতিহাসেরই সর্বোচ্চ। অথচ সেদিন সকালেই বাংলাদেশের হয়ে নেপালের বিপক্ষে সর্বোচ্চ ২১টি বল ডট দিয়েছিলেন পেসার তানজিম হাসান সাকিব।
২০২৪ আসরের আগে সর্বোচ্চ ২০টি ডট বল দেওয়ার রেকর্ড ছিল দুজনের। যৌথভাবে রেকর্ডটি ওয়েস্ট ইন্ডিজের কেমার রোচ ও শ্রীলঙ্কার অজন্তা মেন্ডিসের দখলে ছিল। বোলারদের কেমন দাপট ছিল সেটি এবারের আসরে ডট বলের রেকর্ডে চোখ রাখলেও টের পাওয়া যায়। চলতি বিশ্বকাপে রোচ-মেন্ডিসের সমান ২০টি করে ডট বল করেছেন আটজন বোলার। তারা হচ্ছেন– ওটনিয়েল বার্টম্যান, ফ্রাঙ্ক এনসুবুগা, আদিল রশিদ, ট্রেন্ট বোল্ট, টিম সাউদি, লকি ফার্গুসন, মোহাম্মদ আমির ও মুস্তাফিজুর রহমান।
এবার দলীয় ১০০ রানের আশপাশে অলআউট হওয়ার ঘটনা ঘটেছে ১২ বার। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ইতিহাসে এর ধারেকাছে নেই কোনো আসর। এর আগে সর্বোচ্চ ৮ বার করে একশ রানের আশপাশে অলআউট হওয়ার নজির দেখা গিয়েছিল ২০১৪ ও ২০২১ বিশ্বকাপে। এ ছাড়া এবার সর্বোচ্চ তিনবার ৫০ রানের নিচে অলআউটও হয়েছে দুই দেশ। এর মধ্যে উগান্ডা দুই ম্যাচে ৩৯ ও ৪০ রানে অলআউট হওয়ার লজ্জায় পুড়ে। বিশ্বকাপ ইতিহাসে এই দুটিও সর্বনিম্ন।
আরও পড়ুন
চলতি বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত ৪ ম্যাচে সর্বোচ্চ ১২ উইকেট শিকার করেছেন আফগান পেসার ফজলহক ফারুকি। সমান ম্যাচে ৯টি করে উইকেট পেয়েছেন ছয়জন বোলার। তাদের মধ্যে বাংলাদেশের তানজিম হাসান সাকিবসহ আছেন ট্রেন্ট বোল্ট, আকিল হোসেন, এনরিখ নরকিয়া, শামার জোসেফ ও অ্যাডাম জাম্পা।
সুসময় আসছে ব্যাটারদের!
ব্যাটারদের জন্য স্বস্তির বিষয় তাদের ক্যারিয়ার হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া নিউইয়র্কের নাসাউ কাউন্টি স্টেডিয়ামের অস্তিত্ব বিলীনের পথে। যেখানে ব্যাটারদের খাবি খেতে হয়েছে অপ্রত্যাশিত বাউন্স ও নিচু বলের ধঁকল সামলাতে গিয়ে। কেবল নাসাউ–ই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে বিশ্বকাপ অধ্যায় শেষ গ্রুপ পর্বেই। ফলে সুপার এইট, সেমিফাইনাল ও ফাইনাল গড়াবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে। যেখানকার বেশিরভাগ পিচই রান ওঠার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে। এবার তিনটি দুইশ বা এর বেশি রান হওয়া ম্যাচও অনুষ্ঠিত হয়েছে ক্যারিবীয় দ্বীপে।
তবে সবমিলিয়ে হিসাব করলে নবম আসরটিতে গড় রান কম হলেও, দুইশ রান ওঠার দিক থেকে ২০২৪ আসরের অবস্থান তিনে। যা বিগত আসরগুলোকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর আগে ২০০৭–০৮ বিশ্বকাপে পাঁচবার এবং ২০১৫–১৬ আসরে চারবার দলীয় ২০০ রান দেখা গিয়েছিল।
এবার দলীয় রানের গড় কম থাকলেও, ব্যক্তিগতভাবে খুব একটা পিছিয়ে নেই ব্যাটাররা। আফগানিস্তানের ওপেনার রহমানউল্লাহ গুরবাজ এখন পর্যন্ত আসরের সর্বোচ্চ ১৬৭ রান করেছেন। ৪ ম্যাচে তার ব্যাটিং গড় ৪১.৭৫ এবং স্ট্রাইকরেট ১৫০.৪৫। এ ছাড়া ক্যারিবীয় তারকা নিকোলাস পুরান সমান স্ট্রাইকরেটে ১৬৪ এবং ১৯০.২৪ স্ট্রাইকরেটে অস্ট্রেলিয়ার মার্কাস স্টয়নিস ১৫৬ রান করেছেন।
এএইচএস