অলিম্পিয়ান সাগর চা দোকানি মায়ের স্বপ্ন পূরণ
বয়স মাত্র ১৮। বিকেএসপির একাদশ শ্রেণীর আরচ্যারি বিভাগের ছাত্র সাগর ইসলাম। তুরস্কের আনতালিয়ায় অলিম্পিক কোটা প্লেস টুর্নামেন্টে সরাসরি অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতা অর্জনের পাশাপাশি রৌপ্য জেতেন গতকাল। গলফার সিদ্দিক, আরচ্যার রোমান সানার পর কৃত্তিত্ব গড়লেন সাগর। অলিম্পিকে খেলা, নিজের ক্যারিয়ারসহ নানা বিষয় নিয়ে গতকাল রাতে তুরস্কের আনতালিয়া থেকে ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়েরের সঙ্গে কথা বলেছেন সাগর।
বাংলাদেশের তৃতীয় ক্রীড়াবিদ হিসেবে সরাসরি অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছেন, এ অনুভূতি কেমন?
সাগর : আলহামদুল্লিাহ, অত্যন্ত খুশি ও গর্বিত লাগছে। বাংলাদেশের জন্য এমন সম্মান বয়ে আনতে পেরেছি এবং আমিও নিজেও একটি বিশেষ যোগ্যতা অর্জন করলাম।
এই টুর্নামেন্টে রিকার্ভ বিভাগে তিন জন আরচ্যার ছিলেন। আপনি রুবেল ও রামের চেয়ে জুনিয়র। আপনার ওপর প্রত্যাশা বা চাপ কোনোটাই তেমন ছিল না। শেষ পর্যন্ত আপনিই চমক দিলেন।
সাগর : এটা ঠিক আমার ওপর চাপ সেভাবে ছিল না। আমি রুবেল ভাই ও রামের চেয়ে জুনিয়র তবে প্রত্যাশা অবশ্যই ছিল। ফেডারেশন আমার ওপর ভরসা রেখেই এখানে পাঠিয়েছে। আমি আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছি। আল্লাহর রহমত ও সকলের দোয়ায় সফল হয়েছি।
প্রি কোয়ার্টারে রুবেল বাদ পড়ে গেল, কোয়ার্টারে রামও হেরে যায় ঐ দুই সময় আপনি একটু বাড়তি চাপে ছিলেন কি না?
সাগর : খেলার ফরম্যাট অনুযায়ী ঐ দুই পর্যায়েই আমার খেলা কয়েক মিনিট পর হয়েছে তাদের চেয়ে। রুবেল ভাই লড়াই করে হেরেছে তাকে সান্তনা দেয়ার পাশাপাশি জিজ্ঞেস করেছি বাতাস ও অন্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে। আরচ্যারিতে প্রতিনিয়ত পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে পারে। আমি মনে সাহস রেখে চেষ্টা করেছি সফল হতে পেরেছি।
আপনি র্যাংকিং রাউন্ডে ষষ্ঠ হওয়ায় দুই ধাপ খেলতে হয়নি। সরাসরি ১/১৬ থেকে খেলছেন। র্যাংকিং রাউন্ডে ষষ্ঠ হওয়াটা অলিম্পিক কোটা পাওয়া এবং রৌপ্য জেতায় বড় ভূমিকা রেখেছে কি না?
সাগর : অবশ্যই, র্যাংকিং রাউন্ডের পজিশন বড় অবদান রেখেছে। আমি ছয় নম্বর হওয়ায় ১/১৪৮ ও ২৪ স্তরে খেলিনি। একটু বিশ্রাম ও প্রস্তুতির বাড়তি সুযোগ পেয়েছি এবং শীর্ষ র্যাকিং পজিশন হওয়ায় তুলনামূলক পেছনের র্যাংকিংয়ের খেলোয়াড় পেয়েছি। যা আমাকে মানসকিভাবে সহায়তা করেছে। আরচ্যারিতে র্যাংকিং পজিশনের উপরই এলিমিনেশনের ধাপ চূড়ান্ত হয়। র্যাংকিং ভালো পজিশন থাকলে পরবর্তীতে সহজ হয়।]
র্যাংকিংয়ে আপনার চেয়েও ভালো পজিশনে ছিল রাম। সে চার নম্বর থেকেও কোয়ার্টার থেকে বিদায় নিল। আপনি শেষ পর্যন্ত রৌপ্য জিতলেন এবং অলিম্পিকও নিশ্চিত করলেন। আপনার যাত্রা থেমে যেতে পারত ১/১৬ পর্বেই। সেখানে শুট অফে (টাইব্রেকারে) জিতেছেন। আবার কোয়ার্টারেও শুট অফে জিতেছেন। আপনার এই সাফল্যে ভাগ্যেরও সহায়তা পেয়েছেন।
সাগর : খেলোয়াড় হিসেবে আমরা সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করতে পারি শুধু। এরপর প্রকৃতি, ভাগ্য অনেক কিছুরই হাত থাকে। যেটা বলেছেন সেটাও সঠিক। ১/১৬ পর্যায়ে আমার ও প্রতিপক্ষের সমান ৫-৫ সেট পয়েন্ট ছিল। শুট অফেও দুই জন ৯ এর ঘরেই মেরেছিলাম। আমার তীর দশের অধিক নিকটবর্তী হওয়ায় আমি পরের ধাপ যাই। কোয়ার্টারেও শুট অফে জিতেছিলাম। তবে কোয়ার্টারে হারলেও একটা সম্ভাবনা ছিল যেহেতু পাঁচজন ব্যক্তিগত ইভেন্টে সুযোগ পাবে। কোয়ার্টারে অন্য চার জনের চেয়ে আমার সেট পয়েন্ট বেশি থাকত। হেরে সুযোগ পাওয়ার চেয়ে জিতেই খেলছি, এটি বেশি গৌরবের।
২৬ জুলাই প্যারিসে অলিম্পিক শুরু হচ্ছে। আর মাত্র এক মাস বাকি। অলিম্পিকের আগে নিজেকে কিভাবে প্রস্তুত করবেন?
সাগর : আসলে হাতে সময় একেবারেই কম। এই এক মাসের প্রতিটি মিনিট কাজে লাগাতে চাই। কোচও আমাকে নিয়ে বিশেষভাবে পরিকল্পনা করবেন। অলিম্পিকেও ভালো কিছু করতে চাই।
বিশ্বের সেরা আরচ্যারদের সঙ্গে লড়াই করে আপনিও অলিম্পিকে জায়গা করে নিয়েছেন। রোমান ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে ১/৩২ পর্যন্ত গিয়েছিলেন। আপনি কি তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারবেন?
সাগর : আসলে অলিম্পিক অনেক বড় জায়গা। সব ক্রীড়াবিদেরই স্বপ্ন থাকে পদক জেতার। আমারও রয়েছে, তবে আমাদের বাস্তবতা-অভিজ্ঞতা একটু ভিন্ন। আমি চেষ্টা করব যতটুকু সম্ভব ভালো করা যায়।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে আপনি অলিম্পিক খেলতে যাচ্ছেন। আপনার এই সাফল্যের রহস্য কি?
সাগর : অবশ্যই, কঠোর পরিশ্রম আর পরিশ্রম। এর বাইরে অন্য কিছু নয়। পরিশ্রম করে বিকেএকসপিতে সুযোগ পেয়েছি। বিকেএসপিতে ভালো করে পরিশ্রম করায় জাতীয় দলে এসেছি। জাতীয় দলে পরিশ্রম করায় এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেলছি এবং সফল হলাম। পরিশ্রমের বাইরে কিছু নেই।
পরিশ্রম তো অনেকেই করেন। সফল না হওয়ায় হাল ছাড়েন আবার পরিশ্রমও সঠিক পথে হয় না। আপনার যাত্রাটা কেমন ছিল?
সাগর : আমার বাবা নেই, মা আছেন। আরচ্যারির জন্য আমি ঈদেও বাড়িতে যাই না। ঈদের দিন অনুশীলন করেছি। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠার পর ও রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত আরচ্যারি নিয়েই কাজ করি। এটাই হচ্ছে পরিশ্রম। যারা পরিশ্রম করবে কোনো না কোনোভাবে সফল হবেই।
২০১৯ সালে আপনি বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছিলেন সপ্তম শ্রেণীতে। তখনও বাংলাদেশে আরচ্যারি এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। সেই সময় আরচ্যারি বেছে নেয়ার কারণ কি?
সাগর : আমাদের জেলা রাজশাহীতে আরচ্যারি হতো। সেখানে খেলতে খেলতে ভালো লাগে। ঢাকায় জাতীয় খেলায় খেলতে আসি। এরপর বিকেএসপিতে ট্রায়াল দেই। টিকে গেলে ভর্তি হয়ে যাই। এরপর আরচ্যারিই আমার ধ্যানজ্ঞান।
আরচ্যার সাগর হয়ে ওঠার পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি?
সাগর : প্রথম ও সবচেয়ে বড় অবদান মায়ের। আমার বয়স যখন তিন বছর। তখন আমার বাবা মারা যান। আমার মা রাজশাহীতে চায়ের দোকান করে আমাদের মানুষ করেছেন। চায়ের দোকানীর ছেলে হয়ে আরচ্যারি খেলব ও পড়ব। এটা কঠিনই ছিল। আমার মা আমার স্বপ্ন পূরণ করেছেন। তার অনেক কষ্ট হয়েছে, আড়ালে কেঁদেছেন। আমাকে কখনো বুঝতে দেননি এবং খেলতে বাধাও দেননি। আমার এক ভাই ও দুই বোন রয়েছে। আমরা একটু বড় হওয়ার পর অনুরোধ করি মাকে অন্য ব্যবসা করতে, মা এখনো সেই দোকান চালিয়ে সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন। ছেলে খেলে ভালো কিছু করুক সেটাই চেয়েছেন। আজ (গতকাল) আমি আমার মায়ের ইচ্ছে পূরণ করতে পেরেছি, এজন্য বেশ খুশি লাগছে।
তাছাড়া আরচ্যার হয়ে ওঠার পেছনে বিকেএসপির অবদান অনেক। সেখানে ভালো কোচিং পাওয়ায় জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছি। জাতীয় দলে কোচ মার্টিনের নির্দেশনায় পরিপূর্ণ আরচ্যার হয়েছি। ফেডারেশন যথেষ্ট সহায়তা করে। যার ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভালো করছি।
কিছু দিন আগেই জাতীয় আরচ্যারি হয়েছে। আপনি জাতীয় আরচ্যারিতে কখনো চ্যাম্পিয়ন হতে পারেননি। জাতীয় আরচ্যারিতে সেরা ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এককভাবে সেরা না হয়েও আপনি অলিম্পিকে সরাসরি খেলবেন কখনো ভেবেছিলেন?
সাগর : জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হতে পারিনি এটা ঠিক। তবে এশিয়া কাপে ইরাকে মিশ্র ও দলগত বিভাগে রৌপ্য জিতেছি। ইসলামিক গেমসও পদক রয়েছে। তবে ব্যক্তিগত প্রথম বড় অর্জন বললে এটাই। পরিশ্রম করলে কোনো না কোনো সময় সফলতা ধরা দিবেই।
রোমানের পর আপনি দ্বিতীয় আরচ্যার হিসেবে সরাসরি অলিম্পিক খেলছেন। আপনি এখন তারকা আরচ্যারই নন গোটা ক্রীড়াঙ্গনেই বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদের তকমা পাবেন। অনেক ক্রীড়াবিদ সেটা ধরে রাখতে পারেন না উল্টো বিতর্কিত-সমালোচিত হন। আপনি নিজেকে ধরে রাখতে কতটা আত্মবিশ্বাসী?
সাগর : আমি নিজেকে তারকা মনে করছি না। খেলা ভালোবাসি, খেলে যাচ্ছি-দেশের জন্য কিছু করতে পারলে সেটাই তৃপ্তির। আমাকে যদি কেউ অনুসরণ করে বা পছন্দ করে সেটা আলাদা ভালো লাগার হবে। আচার-আচরণ, চলাফেরায় আমি সেই সাগরই থাকব।
রোমান সরাসরি অলিম্পিক খেলার পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছিলেন। ফেডারেশনও তাকে সংবর্ধনা দিয়েছিল। আপনাদের পৃষ্ঠপোষক তীরও দূত করেছিল। এই অর্জনের পর আপনার প্রত্যাশা কি?
সাগর : সবারই ইচ্ছে থাকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার। আমারও রয়েছে। এই অর্জনের মাধ্যমে যদি দেখা করতে পারি সেটাই হবে সবচেয়ে ভালো লাগার। ফেডারেশন বা আমাদের স্পন্সর কি করবে আমার জন্য সেটা তাদের বিষয়। আমার এখন মনোযোগ এক দিন পর শুরু হতে যাওয়া বিশ্বকাপ আরচ্যারি এরপর তো অলিম্পিকই।
আপনারা সরাসরি অলিম্পিকে অংশ নিচ্ছেন। এরপরও আপনাদের আর্থিক অনটন থেকে যায়। ক্রিকেট, ফুটবল বাদে অন্য সকল খেলার খেলোয়াড়রা আর্থিক-সামাজিক মর্যাদা সেভাবে পায় না। এ নিয়ে মনে অতৃপ্তি কাজ করে?
সাগর : খারাপ লাগার মতোই, তবে খারাপ লাগাতে দেই না। এসব নিয়ে ভাবলে আর মনোযোগ থাকবে না সেভাবে। আর বললেও তো আর পরিবর্তন হবে না। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ পেলে বলব, কি বলব সেটাই গোপনই থাক।
এজেড/এইচজেএস