ওয়াসিম আকরাম– ‘প্রডিজি’ থেকে ‘সুলতান অব সুইং’
১৯৯২ বিশ্বকাপের ফাইনাল। নেইল ফেয়ারব্রাদারের সঙ্গে অ্যালান ল্যাম্বের জুটি। ১৩ ওভারেও নেই উইকেটের দেখা। পাকিস্তানের অধিনায়ক ইমরান খান বল তুলে দিলেন তরুণ ওয়াসিম আকরামের হাতে। লাহোর থেকে উঠে আসা এই বোলারের বয়স তখন ২৬। যদিও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পার করে ফেলেছেন ৮ বছর।
১৮ বছর বয়সে যখন পাকিস্তানের হয়ে অভিষেক হয়, তখন ছিলেন প্রডিজি। ১৯৯২ সালে এসেছিলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা পেসারের তকমা নিয়ে। ইমরান খানের আস্থার প্রতিদান দিলেন সেই ওভারে। ওভারের শেষ দুই বলে দুইটা অসামান্য সুইং ডেলিভারি। অ্যালান ল্যাম্বের পর ফিরলেন ক্রিস লুইস। বিশ্বকাপের ইতিহাসের সবচেয়ে ম্যাজিকাল দুই ডেলিভারি বলা হয় মেলবোর্নের ফাইনালের সেই দুই বলকে।
ইংল্যান্ড সেই ধাক্কা থেকে আর ফিরতে পারেনি। একটা বিশ্বকাপের জন্য ইংল্যান্ডের সেই অপেক্ষা শেষ হয় বিশ বছর পর। আর পাকিস্তান এখনও একটা বিশ্বকাপ নিয়েই তৃপ্ত।
ওয়াসিম আকরাম এসেছিলেন প্রডিজি বা বিশেষ গুণসম্পন্ন একজন তরুণ হিসেবে। এরপর হয়েছেন সময়ের সেরা। ২০০৩ বিশ্বকাপের পর যখন ক্রিকেটকে বিদায় জানাচ্ছেন ততদিনে তিনি হয়েছেন সুইং অব সুলতান। নামের পাশে ৯১৬টি আন্তর্জাতিক উইকেট। প্রথম বোলার হিসেবে ওয়ানডেতে পূর্ণ করেছিলেন ৫০০ উইকেটের মাইলফলক। ১৯৬৬ সালের আজকের এই দিনে (৩ জুন) লাহোরে জন্ম হয়েছিল সর্বকালের অন্যতম সেরা এই পেসারের।
করাচির রাস্তা থেকে ইসলামিয়া কলেজ
পাকিস্তান ক্রিকেট বরাবরই পেসারদের উর্বরভূমি। তবে ওয়াসিম আকরাম আশির দশকে যে পেস বিপ্লবের সূচনা করে দিয়েছিলেন, বর্তমানে বলতে গেলে সেই ধারারই অংশ হয়ে বেড়ে উঠেছেন শাহিন আফ্রিদি, হারিস রউফরা। ডেনিস লিলি, জেফরি থমসন কিংবা ম্যালকম মার্শাল, জোয়েল গার্নারদের সেই সময়ে উপমহাদেশ থেকে কেউ পেস বোলিংয়ে সেরা হয়ে উঠবেন, তা একপ্রকার অসম্ভবই ছিল।
ওয়াসিম আকরাম তা করেছেন, বেশ ভালোভাবেই করেছেন। নানির কাছে করাচিতে থাকার দিনগুলোতে রাস্তায় টেনিস বলে ইলেকট্রিক টেপ পেঁচিয়ে খেলতেন। প্রচলিত ভাষায় টেপ টেনিস। সেই বল থেকেই একসময় কিছুটা টেপ তুলে নিয়ে বাড়তি সুইং করানোর চেষ্টা করতেন। কিশোর বয়সের সেই টেপ টেনিসের শিক্ষাটা পরবর্তীতে কাজে লাগিয়েছেন ২২ গজের পিচে। অধুনা যুগে এসে যা পরিচিত হয়েছে রিভার্স সুইং হিসেবে।
ব্যবসায়ী বাবার ঘরে বেড়ে ওঠা ওয়াসিম আকরাম আদতে হতে চেয়েছিলেন টেনিস খেলোয়াড়। আরেকটা শখ ছিল চারুকলায় পড়ার। কিন্তু সব ছেড়ে ক্রিকেটার হলেন। এমনকি মাধ্যমিকের পর ইসলামিয়া কলেজেই ভর্তি হলেন বাঁহাতি পেস বোলার হিসেবে। কলেজের প্রথম বর্ষে দলে জায়গা পাননি, কারণ অধিনায়ক নিজেই ছিলেন বাঁহাতি পেসার।
তবে দ্বিতীয় বছরে ওয়াসিম নিজেই চলে যান পাকিস্তানের জাতীয় দলে। লাহোর জিমখানার সাথে একটি ম্যাচে ওয়াসিম আকরাম নেন চারটি উইকেট যার মধ্যে ছিল রমিজ রাজা ও ইন্তিখাব আলমের উইকেট। ক্লাব ক্রিকেটে এই সাফল্য তাকে নিয়ে আসে পাদপ্রদীপের আলোতে। এরপর সাবেক ফাস্ট বোলার খান মোহাম্মদের ক্যাম্পে ডাক পান ওয়াসিম আকরাম।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট না খেলেই টেস্ট অভিষেক
১৯৮৪ সালের জুন মাসে শুরু হয় ক্যাম্প। এই ক্যাম্পে রামিজ রাজা, ইজাজ আহমেদ, মহসিন কামালরাও ছিলেন। এই রমিজ রাজা আর ইজাজ আহমেদের সঙ্গেই ওয়াসিম আকরাম পরে বিশ্বকাপ জেতেন। মহসিন কামাল এখন বাংলাদেশের ফিটনেস কোচ।
সেই ক্যাম্পে নতুন বলে একবারই বল করার সুযোগ পান। তাতেই বাজিমাত। ১৮ বছর বয়সে মাত্র একবার নেটে বোলিং করে চলে আসেন জাতীয় দলে। ওয়াসিম আকরাম পরবর্তীতে স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমি অবাক হয়ে যাই যখন দেখি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে একটি তিনদিনের ম্যাচে ডাক পেলাম। তখনও আমি কোন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলিনি। তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না যে একাদশে সুযোগ পাবো। কিন্তু ম্যাচের আগেরদিন জাভেদ মিয়াঁদাদ বলেন, তুমি খেলছো।
সেই তিনদিনের প্রস্তুতি ম্যাচের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ওয়াসিম আকরাম বলেছিলেন, ‘১৮ বছর বয়সী কারো জন্য সেই শুরুটা ছিল বিশেষ কিছু। মাত্র একবার নেটে বল করেই সরাসরি দলে। প্রথম উইকেটটা পাই জন রাইটের, প্রথম ইনিংসে ৫০ রান দিয়ে সাত উইকেট পাই। পরের ইনিংসেও আরো দুটো উইকেট।’
‘আমি টেস্ট ক্রিকেট খেলতে চাইতাম ঠিকই কিন্তু তখন ভাবিনি সুযোগ পাবো। পাকিস্তান দল যখন নিউজিল্যান্ড সফরে যাবে সেই ক্যাম্পে আমি ডাক পেলাম। জাভেদ মিয়াঁদাদ নির্বাচকদের সাফ বলে দিলেন তিনি আমাকে দলে চান।’
কাউন্টি ক্রিকেট আর আন্তর্জাতিকে রাজত্ব
১৯৮৭ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তান ও ইংল্যান্ডের মধ্যে একটি সিরিজের সময় ইংলিশ ব্যাটসম্যান নেইল ফেয়ারব্রাদার ওয়াসিম আকরামকে জিজ্ঞেস করেন, ল্যাংকাশায়ারের হয়ে খেলতে চান কি না। কিশোর ওয়াসিম পাল্টা প্রশ্ন করেন, সেখানকার লিগে? আদতে ফেয়ারব্রাদারের প্রস্তাব ছিল আরও বড়। ল্যাংকাশায়ার কাউন্টি দলের কথা বলছিলেন তিনি।
সেই কাউন্টিতে পরে ১১ বছর খেলেন ওয়াসিম আকরাম। ফেয়ারব্রাদারকে পরে হারিয়েছিলেন ১৯৯২ এর বিশ্বকাপের ফাইনালেও। ওয়াসিম আকরাম হয়ে ওঠেন দিনে দিনে হয়ে ওঠেন দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৯২ এর বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী। ইমরান খান পরবর্তী যুগে পাকিস্তানের অধিনায়ক।
ক্রিকেট ইতিহাসে ওয়ানডে আর টেস্ট দুই ফরম্যাটেই ন্যূনতম ৪০০ উইকেট পেয়েছেন এরকম বোলারের সংখ্যা মাত্র ২ জন; মুত্তিয়া মুরালিধরন এবং ওয়াসিম আকরাম। এর মাঝে ওয়াসিম আকরামই একমাত্র ফাস্ট বোলার। একজন ফাস্ট বোলার হিসেবে ১৮ বছর ১১০ দিনের ওয়ানডে ক্যারিয়ার ইঙ্গিত দেয় তার অবিশ্বাস্য ফিটনেসের দিকে।
ওয়ানডে ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশিদিন খেলা চালিয়ে যাওয়া ক্রিকেটারদের তালিকায় প্রথম ২০ জনের মাত্র ৪ জন বোলার। এই চারজন বোলারের মাঝে ওয়াসিম আকরাম বাদে বাকি তিনজনই স্পিনার।
অনন্য অসামান্য ওয়াসিম
ওয়াসিম আকরামের কিছু কীর্তির কথা আলোচনা করা যাক। টেস্ট এবং ওয়ানডে দুই ক্ষেত্রেই পাকিস্তানের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি ওয়াসিম আকরাম ১৯৯৩ সালে ‘উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটার’ নির্বাচিত হন। এছাড়া উইজডেন দ্বারা নির্বাচিত গত শতাব্দীর সেরা ওয়ানডে বোলার হিসেবেও নির্বাচিত হন ওয়াসিম।
ওয়াসিম আকরাম একমাত্র বোলার, যার টেস্ট এবং ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই দু’টি করে হ্যাটট্রিক রয়েছে। এর মাঝে ওয়ানডের দু’টো হ্যাটট্রিক সরাসরি বোল্ড করার মাধ্যমে। বোলার ওয়াসিম কতটা দুর্ধর্ষ, সেটা এই ছোট্ট পরিসংখ্যানেই হয়ত স্পষ্ট।
থম বোলার হিসেবে ওয়ানডে ক্রিকেটে ৫০০ উইকেট লাভ করেন ওয়াসিম আকরাম। পরবর্তীতে মুরালিধরন তার রেকর্ড ভাঙলেও আর কোনো ফাস্ট বোলার এই রেকর্ডের কাছাকাছি যেতে পারেননি।
ব্যাট হাতেও লোয়ার অর্ডারে যথেষ্ট কার্যকরী ছিলেন। টেস্টে তিনটি সেঞ্চুরি রয়েছে, যার মধ্যে একটি অস্ট্রেলিয়ার মাটিতেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে করেছিলেন তিনি। এছাড়া জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২৫৭ রানের একটা ইনিংস খেলেন, যা কিনা আট নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। এছাড়া সেই ইনিংসেই ১২টি ছক্কা মেরেছেন, যা কিনা এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ছক্কা মারার রেকর্ড। পাকিস্তানি অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ডও এটাই।
ইমরান খান হয়ত একারণেই আক্ষেপ করেছিলেন ব্যাট হাতে সিরিয়াস হলে ওয়াসিম আকরাম ইতিহাসের সেরা অলরাউন্ডার হতে পারতেন। ওয়াসিম আকরাম তা হননি। কিন্তু একজন প্রডিজি থেকে ১৮ বছরের ব্যবধানে সুলতান অব সুইং হয়েছেন। ব্যাট হাতে সিরিয়াস হলে অমন একজন বোলার কী পেত ক্রিকেট দুনিয়া?
জেএ