ট্রেবল ছাপিয়ে ‘গোল-ফাউল’ বিতর্ক!
এক মৌসুমে তিনটি চ্যাম্পিয়ন ট্রফি জয়ের ঘটনা সচরাচর ঘটে না। ২০১৩ সালে শেখ রাসেলের পর আবার বাংলাদেশের ফুটবলে ট্রেবলের কীর্তি গড়েছে বসুন্ধরা কিংস। অসাধারণ এই কীর্তি গড়লেও ফুটবলাঙ্গনে ট্রেবল বন্দনার চেয়ে আলোচনায় ফাউল নাকি গোল– এমন বিতর্ক!
নির্ধারিত সময়ে খেলা ১-১ গোলে সমতা ছিল। তখন অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধও শেষ দিকে। সেই সময় কর্নার থেকে মোহামেডানের বক্সে জটলার মধ্যে গোল করেন কিংসের ডিফেন্ডার জাহিদ হোসেন। আর তাতেই কিংস ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায়। জাহিদ বল প্লেসিংয়ে জালে পাঠানোর আগে কিংসের উজবেকিস্তানি ফুটবলার ববুরবেগ মোহামেডানের অধিনায়ক সোলেমান দিয়াবাতেকে ধাক্কা দিয়ে বসেন। মোহামেডানের দৃষ্টিতে এটি ফাউল, আরেক পক্ষের দাবি বৈধ গোলই হয়েছে।
মোহামেডানের সাবেক ফুটবলার ও বর্তমান টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য ইমতিয়াজ সুলতান জনি এজন্য রেফারিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন, ‘খেলার খুবই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল। রেফারি এই সেনসেটিভ সিদ্ধান্তটি আরও একটু সময় নিয়ে এবং অন্য রেফারিদের সঙ্গে আলোচনা করে নিতে পারতেন। কর্নার থেকে বল ধরতে পোস্ট ছেড়ে বেরিয়েছিল গোলরক্ষক সুজন। তখন কিংসের বিদেশি ফুটবলার (ববুরবেগ) আমাদের সোলেমানকে ধাক্কা দেয়, এতে সুজন বল ধরতে না পেরে পড়ে যায়। এটা অবশ্যই ফাউল। রেফারি বিচার-বিবেচনা না করে হুট করেই গোলের সিদ্ধান্ত দিয়ে একটি দলের প্রতি অবিচার করেছেন।’
কালকের ম্যাচের রেফারি ছিলেন জসীম আক্তার। বড় ম্যাচ পরিচালনায় তার খুব বেশি অভিজ্ঞতা নেই। রেফারিং সংশ্লিষ্ট দুয়েকজন জসীমের সিদ্ধান্তের দুর্বলতা খুঁজে পেয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, ‘কিংসের ফুটবলার মোহামেডানের অধিনায়কের গায়ে ধাক্কা দিয়েছে। এতেই ফাউল হয়, গোলরক্ষক বল স্পর্শ করেছে কি করেনি, সেটা বিবেচনার প্রয়োজন নেই।’ বসুন্ধরা কিংসের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর বায়েজিদ জোবায়ের আলম নিপুর আবার ব্যাখ্যা ভিন্ন, ‘দুই জনই শূন্যে লাফিয়েছে। সেখানে ইচ্ছাকৃত ধাক্কা বা গায়ে হাত দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। শূন্যে কিছুক্ষণ থাকার পর দুই জনই পড়েছে। এটা ফাউল হয় না।’
ফুটবলে রেফারির সিদ্ধান্ত নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলে বিশ্ব জুড়েই। কালকের ম্যাচে সিদ্ধান্ত নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত থাকলেও সেটি যে বেশ সংবেদনশীল সিদ্ধান্ত– এ নিয়ে প্রায় সবাই একমত। বিশেষত বক্সের মধ্যে রেফারির দৃষ্টি ছিল মূলত বলের দিকে। সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে দুই খেলোয়াড়ের স্পর্শ এবং এর প্রভাব দেখা একটু কষ্টসাধ্যই। তাই ভিএআর প্রয়োজন বলে মনে করেন মোহামেডানের কর্মকর্তা জনি ও কিংসের নিপুও।
বাফুফের রেফারিজ কমিটির চেয়ারম্যান সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী। তিনিও ভিএআরের পক্ষে, ‘আমাদের ফুটবল লিগ ও টুর্নামেন্ট অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হচ্ছে। ক্লাবগুলোর বিনিয়োগের পরিপূর্ণতা দিতে অবশ্যই ভিএআর প্রয়োজন।’ ক্লাবগুলো ফুটবলে অনেক বিনিয়োগ করলেও সেই অর্থে তেমন কোনো প্রাপ্তি নেই। অংশগ্রহণ ফি, প্রাইজমানিও নিয়মিত-সঠিক সময়ে পায় না ক্লাবগুলো। এই বঞ্চনার সঙ্গে রেফারিংয়ের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ক্লাবগুলোকে আরো অসহিষ্ণু করে তোলে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে রেফারিদের ওপর একটি শীর্ষ ক্লাবের প্রভাব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে ফুটবলাঙ্গনে।
সাবেক ফিফা রেফারি ও বর্তমানে রেফারিজ কমিটির চেয়ারম্যান তৈয়ব হাসান এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘রেফারিরা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও সততার সঙ্গে খেলা পরিচালনা করেন। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রভাবিত নন। রেফারিরাও অন্য সবার মতো রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ, তাদেরও ভুল হয়, সেই ভুল হিউম্যান এরর, কখনোই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়।’
আরও পড়ুন
বাফুফে কর্তারা প্রায়ই আর্থিক সংকটের কথা বলেন। রেফারিদের সম্মানী প্রদানেই যেখানে কষ্টসাধ্য, সেখানে ভিএআরের মতো ব্যয়বহুল প্রযুক্তি আদৌ বাস্তবায়নযোগ্য কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেই। এই প্রসঙ্গে সালামের বক্তব্য, ‘হৃদযন্ত্রে সমস্যা হলে বাঁচতে হলে অপারেশন করতেই হবে। আমাদের ফুটবল টুর্নামেন্টের আরও উৎকর্ষতা ও বিতর্কমুক্ত করতে হলে ভিএআর লাগবেই। না হলে এ রকম আলোচনা-চলবেই।’
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ এখন পাঁচটি ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। লিগের শেষ রাউন্ডও একই সময়ে একযোগে পাঁচটি ভেন্যুতে হবে। অন্য রাউন্ডেও একই দিন একাধিক ভেন্যুতে খেলা হয়। ভিএআর সকল ভেন্যুতে স্থাপন ও পরিচালনা করা কষ্টসাধ্য সেটা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমরা পর্যালোচনা করে একটি নির্দেশনা বা রূপরেখা করে উদ্যোগ গ্রহণ করলে ভিএআর বাস্তবায়ন অসম্ভব নয়।’
ফুটবলের চলমান মৌসুম শেষের পথে। নতুন মৌসুমের খেলা গড়াবে সেপ্টেম্বর থেকে। অক্টোবরে বাফুফে নির্বাচন। ফেডারেশন কর্তাদের কর্মকাণ্ডও অনেকটা নির্বাচনকেন্দ্রিক। ফলে ভিএআরের ভাবনা বাস্তবায়ন অনেকটা দূরাশাই। চলতি লিগের মাঝপথে বিদেশি রেফারির আলোচনা শুরু হলেও রেফারিজ কমিটি দেশি রেফারিদের ওপরই আস্থা রেখেছে।
এজেড/এএইচএস