বাংলাদেশকে বাস্তবতা দেখাল ‘জোড়াতালি’র দল
- ব্যাটিংয়ে সেই মুরগি খুঁজি তিতি তিতির গল্প
- মুস্তাফিজের রূপবদল
- বাংলাদেশের সামর্থ্যের রিয়েলিটি চেক
প্রবল ঝড়-বৃষ্টির মুখে বাংলাদেশকে স্বাগত জানিয়েছিল স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট্র। শঙ্কা ছিল সিরিজ আয়োজন নিয়েও। তবে সেই শঙ্কা উড়িয়ে নির্ধারিত দিনেই মাঠে গড়ায় প্রথম টি-টোয়েন্টি। প্রাকৃতিক ঝড় থামলেও লিটন-শান্তদের বিবর্ণ পারফরম্যান্সে লজ্জার হারে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
বাংলাদেশের টেস্ট পূর্ব যুগে আইসিসি ট্রফিতে দুই দলের সাক্ষাৎ হলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে গতকালই প্রথমবার মুখোমুখি হয় তারা। প্রথম দেখাতেই ঐতিহাসিক জয়ই তুলে নিয়েছে স্বাগতিকরা। টি-টোয়েন্টির র্যাঙ্কিংয়ে ১০ ধাপ এগিয়ে থাকা বাংলাদেশকে ৫ উইকেটে হারিয়েছে আইসিসির সহযোগী সদস্য এই দেশটি।
যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেটের চর্চার শুরুটা বহু আগে থেকে হলেও কখনোই ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। অভিবাসীদের হাত ধরে মার্কিন মুল্লুকে ক্রিকেটের যে নবযাত্রা, তারও খুব একটা প্রসার ঘটেনি। ক্রিকেটকে বিশ্বায়নের অংশ হিসেবে এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে সহ-আয়োজক হিসেবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজন করতে যাচ্ছে আমেরিকা।
যে কারণে বিশ্বকাপের আগে কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তিন ম্যাচের সিরিজ খেলছে বাংলাদেশ। সিরিজের প্রথম ম্যাচে ব্যাটিং ভরাডুবিতে ৫ উইকেটে হারের পর বিশ্বকাপের আগমুহূর্তে টাইগার ক্রিকেটারদের সামর্থ্য নিয়ে পুরোনো প্রশ্নটা আরও জোরালো হচ্ছে।
সেই ‘মুরগি খুঁজি তিতি তিতি’র গল্প
ব্যাটসম্যানরা ১৬০-১৭০ রান করবেন আর বোলাররা সে পুঁজি দিয়ে ম্যাচ জেতাবেন—বাংলাদেশ দলের টি-টোয়েন্টি জয়ের ফর্মুলা অনেকটা এমনই। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রতিপক্ষের বিপক্ষেই এমন ফর্মুলা বড় ধাক্কা খেয়েছে। টপঅর্ডারের লিটন-শান্ত-সৌম্যদের ব্যর্থতার পর হৃদয়ের ফিফটিতে টেনেটুনে ১৫৩ রানের পুঁজি গড়েছিল বাংলাদেশ। যা ডিফেন্ড করতে পারেননি মুস্তাফিজ-সাকিবরা। ৩ বল বাকি থাকতেই টার্গেট পেরিয়ে যায় স্বাগতিকরা।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সিরিজ ও বিশ্বকাপ খেলতে দেশ ছাড়ার আগে ঘরের মাটিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলেছে বাংলাদেশ। যেখানে ৪-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতলেও ঘুরে ফিরে অস্বস্তি ছিল টাইগারদের ব্যাটিংয়ে। টপ-অর্ডারের ব্যর্থতায় কোনো ম্যাচেই বড় স্কোর গড়তে পারেনি লিটন-শান্তরা। যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষেও একই চিত্র। গতকাল (মঙ্গলবার) হিউস্টনের প্রেইরি ভিউ ক্রিকেট কমপ্লেক্সে টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে পাওয়ার প্লেতেই দুই ওপেনার লিটন দাস (১৪) ও সৌম্য সরকারকে (২০) হারায় বাংলাদেশ। দলের স্কোর পঞ্চাশ ছুঁতেই ড্রেসিং রুমে ফেরেন নাজমুল হোসেন শান্তও। প্রথম ১০ ওভারে রান ওঠে কেবল ৬৫।
হৃদয়ের ৪৭ বলে ৫৮ আর মাহমুদউল্লাহর ২২ বলে ৩১ রানের মান বাঁচানো ইনিংসে দেড়শো পেরোয় বাংলাদেশ। পুঁজিটা মোটেও ডিফেন্ড করার মতো ছিল না সেটি হাড়ে হাড়ে বুঝিয়েছেন স্বাগতিক ব্যাটাররা। ২৮ বলে ৬২ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে যুক্তরাষ্ট্রকে স্মরণীয় জয় এনে দেন হারমিত ও কোরি অ্যান্ডারসন। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে টপ অর্ডারদের ব্যাটিং ব্যর্থতা।
মুস্তাফিজের রূপবদল
শেষ ৪ ওভারে যুক্তরাষ্ট্রের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল তখনো ৫৫ রান। বাংলাদেশের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছিল না। তবে তিন ওভারেই ৪৬ রান দিয়ে ম্যাচ ছিটকে দেন মুস্তাফিজ ও শরিফুল। শেষ ওভারে ৯ রান ডিফেন্ড করতে সাকিবের কোটা বাকি থাকলেও শান্ত বল তুলে দিয়েছিলেন পার্টটাইমার মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে। তিন বলেই ম্যাচ শেষ হয়ে যায়। বাংলাদেশের বোলিং বিভাগে ঘুরে ফিরে আসছেন মুস্তাফিজ। দুটি উইকেট পেলেও ৪ ওভারে ফিজ একাই খরচ করেছেন ৪১ রান। যা বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে খারাপ ইকোনমিক্যাল বোলিং।
সাম্প্রতিক সময়ে আইপিএলে সুনাম কুড়ানো এই পেসার রান খরচেও কার্পণ্য করছেন না। মুস্তাফিজ যে বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং করতে পারেননি সেটি ম্যাচশেষে ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন যুক্তরাষ্ট্রের অবিস্মরণীয় জয়ের অন্যতম নায়ক হারমিত সিং। ফিজের বোলিং নিয়ে এই অলরাউন্ডার বলছিলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম মুস্তাফিজ বাতাসের বিপরীতে বোলিং করবেন। কিন্তু যখন ওকে দেখেছি বাতাসের দিক থেকে বোলিং করতে, তখন ভেবেছি, অন্য প্রান্ত থেকে কোনো ওভারে ২০ রান নেওয়ার সুযোগ আছে আমাদের। হতে পারে তারা আমাদের গুরুত্ব দেয়নি, অথবা কী হতে পারে, এটা আমি জানি না। তবে মুস্তাফিজের ৪ ওভার শেষ করে দেওয়ায় আমরা শেষ ওভারে ২০ রানও নিতে পারব—এমন বিশ্বাস ছিল আমাদের।’
অবশ্য টাইগার অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তকে পাশে পাচ্ছেন মুস্তাফিজ। তিনি বলেছেন, ‘টি-টোয়েন্টিতে এমনটা হতেই পারে। আমরা আমাদের প্ল্যান কাজে লাগাতে পারিনি। আমরা সবাই জানি মুস্তাফিজ কতটা ভালো। আমরা মুস্তাফিজের বোলিং নিয়ে চিন্তিত নই। আমাদের পরের ম্যাচে দল হিসেবে খেলতে হবে।’ বোলিংয়ের সময় মাঠে বাতাসের প্রভাবকেও দুষছেন শান্ত, ‘হ্যাঁ (বাতাস) অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এখানে আমরা যখন আসি তখনই দেখেছি বেশ বাতাস রয়েছে, যা ম্যাচে প্রভাব ফেলবে। আমরা সবাই তা দেখেছি। আমরা সবাই এটা জেনেই চেষ্টা করেছি প্ল্যান কাজে লাগানোর। স্পিনাররা ভালো বোলিং করেছে। আমাদের পেসাররা শেষ দুই-তিন ওভারে পরিকল্পনা মতো বোলিং করতে পারেনি।’
অধিনায়কের স্বীকারোক্তি
অধিনায়কত্ব পেলেই যেন কি জানি হয়! সাকিব আল হাসানের জায়গায় তিন ফরম্যাটের ক্রিকেটে নাজমুল হোসেন শান্তর ওপর আস্থা রেখেছিল বিসিবি। তবে অধিনায়কত্বের গুরুদায়িত্ব পাবার পর থেকেই নিজের স্বাভাবিক ছন্দে নেই শান্ত। এ ছাড়া বাজে ফর্ম নিয়েও বিশ্বকাপ স্কোয়াডে সুযোগ পাওয়া লিটন দাস যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে জীবন পেয়েও কাজে লাগাতে ব্যর্থ হলেন। এমন লজ্জার হারের জন্য ঘুরেফিরে নিজেদের ব্যাটিংকেই দুষছেন টাইগার অধিনায়ক। একইসঙ্গে ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার জন্য তিনি ভালো উইকেটে খেলতে না পারার দায়ও দেখছেন।
আর ২০ রান বেশি হলে ম্যাচটা অন্যরকম হতে পারতো বলেও মনে করেন শান্ত। বলেন, ‘আমার মনে হয় আমরা ভালো ব্যাট করিনি। মাঝের ওভারে বেশ কিছু উইকেট হারিয়েছি আমরা। যদিও দারুণ শুরু পেয়েছিলাম, তবে শেষটা ভালোভাবে করতে পারিনি। মাঝে উইকেট হারিয়ে না ফেললে আরও ২০ রান বেশি করতে পারতাম। তাহলে অন্যরকম হতে পারত ম্যাচটা।’
একইভাবে ভালো উইকেটে খেলতে না পারায় টপ অর্ডারদের পারফরম্যান্সে এমন দশা বলে মনে করছেন শান্ত, ‘আমি এটাকে ভুলের পুনরাবৃত্তি মনে করি না। আমার মনে হয় আমরা ভালো উইকেটে খেলছি না। জিম্বাবুয়ে সিরিজেও ভালো উইকেটে খেলিনি। তবে এটা মানসিক ব্যাপার। আশা করি ব্যাটসম্যানরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। (প্রবাসী বাংলাদেশিরা) হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন, তার কারণ আমরা ভালো খেলিনি। সামনের ম্যাচে চেষ্টা করব যেন একটা ভালো খেলতে পারি।’
সামর্থ্যের রিয়েলিটি চেক
টি-টোয়েন্টিতে বিশ্বকাপে কখনোই ভালো করতে পারেনি বাংলাদেশ। এবারও টাইগারদের নিয়ে খুব একটা প্রত্যাশা দেখছেন না সমর্থকরা। দেশ ছাড়ার আগে বেশি আশা করতে নিষেধ করে গেছেন অধিনায়ক ও নির্বাচকরাও। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে এভাবে হেরে যাবে এটা অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য ছিল। বাংলাদেশের হারের পরপরই সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বকাপের মূল মঞ্চে বাংলাদেশ কি করবে তারও একটা আভাস পাওয়া গেল।
এফআই