আবাহনী ক্রিকেটে উড়ছে, ডুবছে ফুটবলে!
দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় ক্লাব ঢাকা আবাহনী। ফুটবলের মাধ্যমে দেশব্যাপী ক্লাবটির জনপ্রিয়তা অর্জিত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে এই খেলায় তাদের খুবই দুরবস্থা। গত ছয় মৌসুমে ক্লাবটির লিগ শিরোপা নেই। যা আবাহনীর জন্মলগ্নের পর কখনও ঘটেনি।
দেশের ক্রীড়াঙ্গনে গত কয়েক বছর যেন একটা অলিখিত রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে– ক্রিকেট লিগে চ্যাম্পিয়ন ঢাকা আবাহনী ও ফুটবলে বসুন্ধরা কিংস। দুই দলই গড়ে অত্যন্ত সেরা দল। বাকিরা থাকে মূলত রানার্স-আপ হওয়ার দৌড়ে। ক্রিকেটে যে আবাহনীর দোর্দন্ড প্রতাপ, সেই আবাহনী ফুটবলে একেবারে রুগ্ন চিত্রে। ক্রিকেটে লিগ শিরোপা উৎসবের কয়েকদিনের মধ্যে আবাহনী ফুটবলে দুই ট্রফি থেকেই ছিটকে গেছে।
চলতি মৌসুমে স্বাধীনতা কাপ ও লিগের শিরোপা আগেই খুইয়েছে ধানমন্ডির ক্লাবটি। গতকাল (মঙ্গলবার) গোপালগঞ্জে ফেডারেশন কাপের সেমিফাইনালে হেরেছে বসুন্ধরা কিংসের কাছে। খেলাধুলায় হার-জিত থাকতেই পারে তবে গতকাল এত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে আবাহনীর ফুটবলারদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল চরম প্রশ্নবিদ্ধ। এক গোলে পিছিয়ে পড়ার পরও দ্বিতীয়ার্ধে যেন তাদের শরীর চলছিল–ই না। এত নিষ্প্রাণ ফুটবলাররা যেন অপেক্ষায় ছিলেন কখন রেফারির শেষ বাঁশি বাজে! আবাহনীর এমন হাল দেখে খুবই ব্যথিত ক্লাবটির অন্যতম কিংবদন্তি ফুটবলার শেখ মো. আসলাম, ‘কালকের খেলাটি আমি দেখেছি, এত খারাপ লেগেছে বলার বাইরে। তিনটি পাস ঠিকমতো দিতে পারে না প্রতিপক্ষের অর্ধে। এরকম আবাহনী দেখা অত্যন্ত কষ্টের।’
আবাহনী মধ্যবর্তী দলবদলে নিয়েছিল বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়াকে। সেই জামালকে বেশ ঢাকডোল পিটিয়ে নিলেও তাকে সেভাবে খেলায়নি। গতকাল ফেডারেশন কাপে একাদশে রাখলেও দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে উঠিয়ে নিয়েছেন কোচ। জামালের নিম্নমানের পারফরম্যান্স ও আবাহনীর অদূরদির্শতা ঠিকই চোখে পড়েছে আসলামের, ‘বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক আবাহনীতে পুরো সময় খেলতে পারছে না। এটাও দেখতে হবে জীবনে কখনও ভাবিনি। সে আর্জেন্টিনা থেকে আবাহনীতে আসলোই বা কেন, আর আবাহনী তাকে নিলো কেন– কোনো কিছুই বোধগম্য নয়।’
২০১৮ সালে বসুন্ধরা কিংস প্রিমিয়ার ফুটবলে আসার পর থেকে কাগজে-কলমে তারাই সেরা দল গড়ছে। এরপর আবাহনীর প্রাধান্য দিনকে দিন কমেছে। প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচে আবাহনী এখনও কিংসকে হারাতে পারেনি। আবাহনী সর্বশেষ কিংসকে হারিয়েছে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীনতা কাপের ফাইনালে। ওই মৌসুমে কমলাপুর টার্ফে খেলোয়াড়দের সুরক্ষা বিবেচনায় কিংস ফেডারেশন কাপে অংশ নেয়নি। সেই টুর্নামেন্টে আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এরপর ঘরোয়া ফুটবলে আর আবাহনীর সাফল্য নেই।
১৯৮৫ সালে আবাহনীর হ্যাটট্রিক লিগ চ্যাম্পিয়ন দলের অধিনায়ক ছিলেন ইমতিয়াজ সুলতান জনি। তার ক্যারিয়ারের সুবর্ণ সময় আবাহনীতে থাকলেও পরবর্তীতে মোহামেডানে খেলে সেখানেই সংগঠক-ক্যারিয়ার শুরু করেন প্রয়াত বাদল রায়ের অনুপ্রেরণায়। আবাহনীর সাবেক এই ফুটবলার অত্যন্ত ব্যথিত ক্লাবের এই পারফরম্যান্সে, ‘তিন-চার ম্যাচ আগেই বসুন্ধরা কিংস চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাচ্ছে। শীর্ষ দুই দলের মধ্যে ব্যবধান থাকছে কখনও ১২, ১৪-১৫ পয়েন্ট। যা কেবল আবাহনীর জন্য তো নয়ই, আমাদের সামগ্রিক ফুটবলের জন্যও ভালো নয়।’
আরও পড়ুন
আবাহনী-মোহামেডান দল গড়েই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য। ক্রীড়াঙ্গনের এই আপ্ত বাক্য এখন আর নেই। বাস্তবিক অর্থে দুই দলই এখন রানার্স-আপ হলেই যেন সন্তুষ্ট। আবাহনী কিংসকে মাঠে সেভাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে না। ঘরোয়া ফুটবলের ফলাফলে অন্যতম নিয়ন্ত্রক বিদেশি ফুটবলার। আবাহনী গত কয়েক বছর কিংসে খেলা বিদেশিদের নিজেদের ডেরায় ভিড়িয়েছে। তাদের দিয়ে অবশ্য সফল হতে পারেনি। উল্টো আবাহনী থেকে ডরিয়েল্টনকে নিয়ে সফল হয়েছে কিংস।
খেলোয়াড় সংগ্রহে যেমন দুর্বলতা রয়েছে তেমনি আছে কোচিং স্টাফেও। পতুর্গিজ কোচ ম্যারিও ল্যামোসের ওপর নির্ভরশীল ছিল আবাহনী কয়েক বছর। এবার ম্যারিওকে বিদায় দিলেও ফিরিয়ে এনেছে পুরনো কোচ আন্দ্রেস ক্রুসিয়ানিকে। যিনি তেমন সময়পোগী নন। ফুটবলে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পজিশন গোলরক্ষক। আবাহনী সেই দীর্ঘদিন থেকে গোলরক্ষক কোচ আতিকের ওপরই নির্ভরশীল। সাবেক জাতীয় গোলরক্ষক হলেও গোলকিপিং কোচিংয়ে আধুনিকতায় কিংসের নুরুজ্জামান নয়নের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। তাই আবাহনীর গোলরক্ষক শহিদুল আলম সোহেলের অনেক ভুলে গোলরক্ষক কোচ আতিকের দায় এড়ানোযোগ্য নয়।
বসুন্ধরা কিংস ফুটবলারদের অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে বেঞ্চে বসিয়ে রাখে। যাতে আবাহনী ভালো দল গড়তে না পারে। কিংসের অর্থের কাছে দেশের অন্য ফুটবল ক্লাবগুলোই মূলত পরাজিত। এরপরও ব্যবস্থাপনার দায় দেখছেন আবাহনীর আরেক কিংবদন্তি আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু, ‘টাকাই সব নয়, ব্যবস্থাপনা-উদ্দীপনাও বড় বিষয়। এখানে আবাহনীর ঘাটতি আছে। মোহামেডান তো স্বল্প বাজেটেও দারুণ খেলছে।’
আবাহনীর চেয়ে কম বাজেটের দল আরেক জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী ক্লাব মোহামেডান। আবাহনীতে কয়েকজন জাতীয় ফুটবলার থাকলেও মোহামেডানে তাও নেই। এরপরও সেই মোহামেডান কিংসকে এক বছরের মধ্যে দু’বার হারিয়েছে এবং এক বছরে ফাইনালে উঠেছে তিনবার। মোহামেডান সীমিত সামর্থ্যে অনেকটা সফল হলেও আবাহনী কেন ব্যর্থ? এই প্রশ্ন আবাহনী ফুটবল দলের বর্তমান ম্যানেজার কাজী নজরুল ইসলামেরও, ‘বসুন্ধরার সঙ্গে লড়ে হারতে পারি, কিন্তু আমরা ফর্টিজ ও অন্য দলগুলোর সঙ্গে কেন পয়েন্ট হারাচ্ছি। এটা আমারও প্রশ্ন।’ বর্তমান ম্যানেজার নিজেই প্রশ্নে হাবুডুবু খেলেও সাবেক তারকা ফুটবলার শেখ মো. আসলামের আরেক প্রশ্নে মূলত অনেক উত্তর নিহিত রয়েছে, ‘আবাহনী দলের কোচিং ও ম্যানেজম্যান্ট স্টাফের কে কোন পর্যায়ে খেলেছে? এটা বিশ্লেষণ করলেই অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে।’
২০১৯ সালে ক্যাসিনো কাণ্ডের পর মোহামেডানের পুর্নজন্মে ভূমিকা রেখেছেন সাবেক তারকা ফুটবলাররা। গত পাঁচ বছর ধরে সাব্বির, কায়সার হামিদ, জনি ও জোসিরা দলের সঙ্গে ছায়া হয়ে আছেন। আবাহনীর কিংবদন্তি দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল, চুন্নু, আসলামসহ অনেকেই ক্লাবের ফুটবল দলের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততাই নেই। এক যুগেরও বেশি সময় আবাহনী ফুটবল দলকে এক হাতে চালিয়েছে সাবেক ফুটবলার সত্যজিৎ দাশ রুপু। এবারের দলও মূলত তার গড়া। দলবদলের শেষ মুহূর্তে তাকে সরিয়ে তারই সহকারী নজরুলকে ম্যানজোর করে ক্লাবের নীতি-নির্ধারকরা। ফুটবল ফেডারেশন ও ফুটবলের অনেক বিষয়ে রুপু আইন-বাস্তবতার নিরিখে নানা সময়ে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করলেও, আবাহনীর এই ব্যর্থতা বিশ্লেষণে কোনো মন্তব্য করতে অপারগ।
এজেড/এএইচএস