মুস্তাফিজের চেন্নাই নামা
আইপিএলের আগে বাইশগজে সময়টা ভালো যাচ্ছিল না মুস্তাফিজুর রহমানের। ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সর্বশেষ সিরিজে ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। মুস্তাফিজ দলে অটোচয়েজ কি না এমন প্রশ্নও উঠছিল। শেষমেশ দল থেকে বাদও পড়েন এক ম্যাচে। খারাপ ফর্মটা সঙ্গী করেই আইপিএলের উদ্দেশে চেন্নাইয়ের বিমানে চেপে বসেছিলেন।
আইপিএলে তো গেলেন, কিন্তু ভক্তদের দুশ্চিন্তা যেন কাটছিল না। চেন্নাইয়ে পাথিরানার মতো পেসার থাকতে ফিজ একাদশে সুযোগ পাবেন কি না এ নিয়ে কম জল্পনা ছিল না। ক্রিকেট ওয়েবসাইট ক্রিকইনফোসহ কেউই মুস্তাফিজকে আইপিএলের বর্তমান চ্যাম্পিয়নদের সম্ভাব্য একাদশে দেখছিলেন না।
চোটের কারণে চেন্নাইয়ের প্রথম ম্যাচ খেলতে পারেননি লঙ্কান তারকা পেসার মাথিশা পাথিরানা। প্রথমবারের মতো হলুদ জার্সিটা গায়ে চাপানোর সুযোগটা এসে যায় মুস্তাফিজের। এরপরের গল্পটা রূপকথাকেও হার মানাবে।
চেন্নাইয়ের হয়ে অভিষেক ম্যাচেই বাঁ হাতের জাদু দেখিয়ে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন মুস্তাফিজ। ৪ উইকেট নিয়ে আইপিএলে নিজের সেরা বোলিংটাই করেছিলেন কোহলির বেঙ্গালুরুর বিপক্ষে। এরপর দলে পাথিরানা ফিরলেও আর বাদ পড়েননি। ফিজও দলের আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন দারুণভাবে। ৯ ম্যাচে ১৪ উইকেট নিয়ে আইপিএল ছাড়ার সময়ও যৌথভাবে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির আসনটা ধরে রেখেছেন।
আরও পড়ুন
যেভাবে চেন্নাইয়ে মুস্তাফিজ
মুস্তাফিজুর রহমানের আইপিএল যাত্রাটা যেন এক রোলারকোস্টার। সানরাইজার্স হায়দরাবাদ থেকে শুরু। এরপর মুম্বাই হয়ে গিয়েছিলেন রাজস্থান। সেখান থেকে দিল্লি দরবার ঘুরে শেষমেশ মুস্তাফিজের ট্রেনটা চেন্নাইয়ে এসে থামে।
গত ডিসেম্বরে দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত নিলামের একেবারে শেষদিকে ২৮ বছর বয়সী বাংলাদেশি এই পেসারের নাম তোলা হয়। যেখানে তার ভিত্তিমূল্য ছিল ২ কোটি রুপি। নিলামে তার জন্য শুরুতেই বিট করে চেন্নাই। তবে আর কোনো দল আগ্রহ না দেখানোয় ওই ভিত্তিমূল্যেই বাংলাদেশি এই পেসারকে পেয়ে যায় ধোনির দল।
নিলামের দাম অনুযায়ী, ম্যাচ বাবদ পারিশ্রমিক ১৪ লাখ ২৮ হাজার ৫৭১ রুপি। সেই হিসেবে ৯ ম্যাচে মুস্তাফিজ পাবেন ১ কোটি ২৮ লাখ ৫৭ হাজার ১৩৯ রুপি। অবশ্য এই পুরো টাকাটা পাচ্ছেন না তিনি। এখান থেকে ভারতীয় সরকার ট্যাক্স বাবদ কেটে রাখবে ২০ শতাংশ। সেক্ষেত্রে আর বাকি থাকছে ১ কোটি ২ লাখ ৮৫ হাজার ৭১২ রুপি। অবশ্য এই টাকাটাও পুরোটা পাবেন না তিনি।
মুস্তাফিজের চেন্নাই নামা
মুস্তাফিজুর রহমান আইপিএলে সেরা ফর্মে ছিলেন সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে ২০১৬ সালে নিজের অভিষেক মৌসুমে। সেবার হায়দরাবাদকে শিরোপা জেতানোর পথে শিকার করেছিলেন ১৭ উইকেট। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত একমাত্র বিদেশি ক্রিকেটার হিসেবে আইপিএলের উদীয়মান ক্রিকেটারের পুরস্কার জিতেছেন তিনি। তবে এরপর যত সময় গেছে ততই যেন ধার কমেছে বাংলাদেশি এই পেসারের।
এবার চেন্নাইয়ের হয়ে নতুন করে যেন ‘পুর্নজন্ম’ হলো মুস্তাফিজের। বিশেষ করে চেন্নাইয়ের চিপাকের স্লো উইকেটে এক কথায় অপ্রতিরোধ্য ছিলেন ফিজ। দলের পরিকল্পনায় যখনই তার হাতে বল তুলে দেওয়া হয়েছে, আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন। গতকাল (বুধবার) পাঞ্জাবের বিপক্ষে নিজের শেষ ম্যাচ বাদ দিলে সব ম্যাচেই উইকেট পেয়েছেন। উইকেট শিকারের দিক থেকে চলতি মৌসুমে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল তার।
২০১৬ সালে হায়দরাবাদের জার্সিতে ১৬ ম্যাচে শিকার করেছিলেন ১৭ উইকেট। এবার ৯ ম্যাচে ১৪ উইকেট নিয়ে শেষ করেন। নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে না পারলেও চেন্নাইয়ের হয়ে আইপিএল ক্যারিয়ারে স্মরণীয় সময়ই কাটালেন ফিজ। আইপিএল ছাড়ার আগে এবারের আসরে দুইবার পার্পল ক্যাপের মালিক হয়েছেন মুস্তাফিজ। ৩ বার হয়েছেন সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। রানবন্যার আইপিএলেও দশের কম ইকোনমি (৯.২৬) ধরে রেখেছেন।
মুস্তাফিজের বিদায়ে দুঃখ পাবে চেন্নাই
মুস্তাফিজের বিদায় নিশ্চিতভাবেই বেশ ভোগাবে চেন্নাইকে। নতুন বলে এবং স্লগ ওভারে বেশ কার্যকর ছিলেন টাইগার পেসার। দলের প্রয়োজনের মুহূর্তে মুস্তাফিজকে ব্যবহার করে প্রায় প্রতি ম্যাচেই সাফল্য পেয়েছেন রুতুরাজরা। এমন পেসারের ঘাটতি পূরণ একটু কঠিনই বটে। বাংলাদেশি এই পেসারের বিদায় প্রসঙ্গে কদিন আগে চেন্নাইয়ের ব্যাটিং কোচ মাইক হাসি বলছিলেন, ‘তার (মুস্তাফিজ) স্লোয়ার বলটা অসাধারণ যেটা খেলা বেশ কঠিন, বিশেষ করে চেন্নাইয়ে। সে যখন চলে যাবে আমরা দুঃখ পাব। কিন্তু তার দেশ তাকে ডাকছে। সে যতদিন থাকতে পারবে ততদিন আমরা তাকে রাখতে চাই। আমরা তার পারফরম্যান্সে বেশ আনন্দিত।’
এ ছাড়া হেড কোচ ফ্লেমিং বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারছি যে আন্তর্জাতিক দায়িত্বটা সবার আগে। সে আমাদের দলের জন্য দারুণ একটি সংযুক্তি ছিল।’
মুস্তাফিজের হলুদ জার্সির স্বপ্নপূরণ
চেন্নাই শিবির ছাড়ার আগে ফ্র্যাঞ্জাইটির মিডিয়া বিভাগকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন মুস্তাফিজ। সেখানে যেন কথার ঝাঁপি খুলে বসেন কম কথা বলা চুপচাপ ছেলেটা। জানান হলুদ জার্সিতে আগে থেকেই খেলার স্বপ্ন দেখার কথা। ফলে তাদের ডাক পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই ঘুমে উড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয় তার। ফিজের মতে, আইপিএলে খেললে একজন ক্রিকেটার অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস পায়, তবে জাতীয় দলের হয়ে খেলতেই তিনি বেশি অনুপ্রাণিত হন।
সাক্ষাৎকারে চেন্নাইয়ের এই বাংলাদেশি পেসার বলেন, ‘এটা চেন্নাইয়ের হয়ে আমার প্রথমবার খেলতে আসা। ২০১৬ সালে আইপিএলে আমার অভিষেক হয়, তবে সবসময় স্বপ্ন ছিল এই ফ্র্যাঞ্চাইজির (চেন্নাই) হয়ে খেলা। যখন চেন্নাই টিম ম্যানেজমেন্টের কল আসে, এরপর থেকে সারারাত আর ঘুম আসছিল না। একরকম উত্তেজনা কাজ করছিল। কিন্তু পরদিন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা ছিল, তাই ঘণ্টাখানেকের মতো ঘুমাই, এরপর থেকে শুধু মেসেজ আসছিল। রাত দেড়টার মতো বাজে তখন, সবাই আমাকে অভিনন্দন জানাতে থাকে।’
দেশের ডাক ও পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা
এবারের আইপিএলে বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন মুস্তাফিজ। প্রথমে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত তাকে ছুটি দিয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। পরে ১ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয় সেই ছুটি। যেন পাঞ্জাবের বিপক্ষে ম্যাচটি খেলতে পারেন তিনি। যদিও যেই সিরিজ খেলতে মুস্তাফিজকে টুর্নামেন্টের মাঝপথে উড়িয়ে আনা হচ্ছে, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম তিন ম্যাচে খেলবেন না তিনি। মূলত খেলার ধকল কাটিয়ে উঠতে এ সময় বিশ্রামে থাকবেন টাইগার পেসার। শেষ দুই ম্যাচ খেলতে পারেন।
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজে খেলানোর পরিকল্পনার জন্যই আইপিএলের পুরো আসরের জন্য মুস্তাফিজকে এনওসি দেয়নি বোর্ড। কয়েক দিন আগেই মুস্তাফিজকে আইপিএলে না খেলিয়ে জিম্বাবুয়ে সিরিজে খেলানোর ব্যাখা দিয়েছেন বিসিবির ক্রিকেট অপারেশন্স বিভাগের প্রধান জালাল ইউনুস চৌধুরী। তিনি বলছিলেন, আইপিএলে থেকে এই পেসারের শেখার কিছু নেই।
তিনি বলেন, ‘আইপিএল খেলে মুস্তাফিজের শেখার কিছু নেই। মুস্তাফিজের শেখার প্রসেস ওভার। বরং মুস্তাফিজের কাছ থেকে শিখতে পারে আইপিএলে অনেক খেলোয়াড় আছে। এতে বাংলাদেশের কোনো লাভ হবে না।' জালাল ইউনুসের এমন বক্তব্য নিয়ে দেশের ক্রীড়াঙ্গনেই অনেক আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। পরে মুস্তাফিজ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনও। মুস্তাফিজ যদি আইপিএল খেলত তাহলে সে বেশি লাভবান হত কি না এমন প্রশ্নের জবাবে পাপন বলেন, 'আইপিএল লাভবান হতো। আমরা কিভাবে লাভবান হবো।'
যদিও মুস্তাফিজকে আইপিএলের মাঝপথে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার বিসিবির সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন অনেকেই। এ তালিকায় আছেন ভারতীয় ধারাভাষ্যকার ও ক্রিকেট বিশ্লেষক হার্শা ভোগলেও।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ডিরেক্টর বলেছে যে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রস্তুতির জন্য বাংলাদেশে খেলাটা মুস্তাফিজের জন্য বেশি ভালো। ডোয়াইন ব্রাভো যখন পাথিরানাকে শেখাবে তখন ফিজ খুব বেশিদিন থাকবে না। ধোনি এবং ফ্লেমিংয়ের সঙ্গটা অন্য রকম ব্যাপার। বাংলাদেশের ক্রিকেট ডিরেক্টর যা বলেছে আশা করি তা মিথ্যা হবে। কারণ সে বলেছে আইপিএল থেকে মুস্তাফিজের শেখার কিছু নেই। তখনই প্রশ্নটা উঠছে কোথায় তাহলে তার জন্য ভালো। আমি বুঝতে পারছি ব্যাপারটা। আসলে বাংলাদেশের রীতিটা ঠিক করতে হবে। এখানে খেলাটা মুস্তাফিজের জন্য খুবই ভালো। কারণ এখানে সে দারুণ বোলিং করছে।
পুরো পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না মুস্তাফিজ
আসরের মাঝপথে দল ছাড়ায় পারিশ্রমিকের পুরো টাকা পাচ্ছেন না ফিজ। আইপিএলের নিয়মানুযায়ী, পুরো টুর্নামেন্ট খেললে সব টাকাই পেতেন। তবে সেটি না হওয়ায় আনুপাতিক হারে পারিশ্রমিক পাবেন এই পেসার। ১ মে পর্যন্ত চেন্নাইয়ের হয়ে ৯ টি ম্যাচ খেলেছেন ফিজ। আর তাই আইপিএল থেকে প্রাপ্ত টাকার অঙ্কটা হিসেব হবে এ ক’টি ম্যাচ ধরে। নিলামের দাম অনুযায়ী, ম্যাচ বাবদ পারিশ্রমিক ১৪ লাখ ২৮ হাজার ৫৭১ রুপি। সেই হিসেবে ৯ ম্যাচে মুস্তাফিজ পাবেন ১ কোটি ২৮ লাখ ৫৭ হাজার ১৩৯ রুপি। অবশ্য এই পুরো টাকাটা পাচ্ছেন না তিনি। এখান থেকে ভারতীয় সরকার ট্যাক্স বাবদ কেটে রাখবে ২০ শতাংশ। সেক্ষেত্রে আর বাকি থাকছে ১ কোটি ২ লাখ ৮৫ হাজার ৭১২ রুপি। অবশ্য এই টাকাটাও পুরোটা পাবেন না তিনি।
আইপিএলের গাইডলাইন অনুযায়ী, একজন খেলোয়াড় যত টাকা পাবেন এর ২০ শতাংশ দিতে হবে খেলোয়াড়ের সংশ্লিষ্ট বোর্ডকে। অর্থাৎ ২০ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। সেক্ষেত্রে ৯টি ম্যাচ খেলে মুস্তাফিজ নিজে পাবেন ৮২ লাখ ২৮ হাজার ৫৬৫ রুপি। এর সঙ্গে অবশ্য ম্যাচ ফি, ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কারসহ বাড়তি আরও কিছু টাকা যোগ হবে।
এফআই/জেএ