ক্রিকেট দুনিয়ার কালো অধ্যায়
১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিক। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী এক সংগঠন অপহরণ করে ৯ ইসরায়েলি অ্যাথলেটকে। উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে সেদিন প্রাণ হারান ১১ জন ইসরায়েলি, ৫ জন ফিলিস্তিনি এবং ১ জার্মান পুলিশ। ক্রীড়াজগতে মর্মান্তিক সব ঘটনার মাঝে অন্যতম কালো অধ্যায় হয়ে ছিল এই ঘটনা।
ঠিক তেমনই এক ঘটনা দেখা গিয়েছিল ২০০৯ সালে। পাকিস্তানের লাহোরে সন্ত্রাসী হামলার কবলে পড়ে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট দলের টিম বাস। ১২ জন সন্ত্রাসীর একটি গ্রুপ হামলা চায় আম্পায়ার এবং সফরকারী দলকে বহন করা গাড়ি লক্ষ্য করে। দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজের শেষ ম্যাচের তৃতীয় দিনের খেলা ছিল সেদিন।
দুইদিনেই জয়ের সুবাস পেতে থাকা শ্রীলঙ্কা সেদিন লাহো্রের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের উদ্দেশে বেরিয়েছিল ফুরফুরে মেজাজে। তবে সব পণ্ড হয়ে যায় এই সন্ত্রাসী হামলায়। পাকিস্তানেও ক্রিকেট হয়ে পড়ে নির্বাসিত। এরপর থেকে আজও পাকিস্তান সফর নিয়ে আছে নানা জল্পনা-কল্পনা।
কী হয়েছিল সেদিন?
পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার সেই ম্যাচে আম্পায়ারের ভূমিকায় ছিলেন এহসান রাজা এবং ম্যাচ রেফারির দায়িত্বে ক্রিস ব্রড। আচমকা গোলাগুলি শুরু হলে ঘটনাস্থলেই মারা যান সেই মিনিবাসের চালক। গাড়ির মেঝেই শুয়ে পড়েন প্রত্যেকেই। কিন্তু, আগত বিদেশীদের বাঁচাতে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন পাকিস্তানি আম্পায়ার এহসান রাজা। দুইবার বুলেট আঘাত করে তাকে।
আরও পড়ুন
প্রাণে বেঁচে গেলেও সেদিন দেশের সম্মান বাঁচাতে গিয়ে নিজের একটি ফুসফুসই হারিয়ে ফেলেন এহসান রাজা। এখন পর্যন্ত তিনি বেঁচে আছেন এক ফুসফুস নিয়ে। গুলি হজমের পর ক্রিস ব্রডই অনবরত তার রক্ত বন্ধের কাজ করে গিয়েছিলেন। যে কারণে আজও ব্রডের প্রতি কৃতজ্ঞ এহসান রাজা।
এই সিরিজ যদিও আয়োজনের কথাই ছিল না। এই সিরিজের কয়েক মাস আগে মুম্বাইয়ের তাজ হোটেলে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা ঘটে। সেই সময় শ্রীলঙ্কার ভারত সফরে আসার কথা ছিল। কিন্তু তাজ হোটেলের সেই জঙ্গি হামলার জেরে সেই সিরিজ বাতিল করে দেয় বিসিসিআই। এর পরিবর্তে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ড পাকিস্তান সফরে পাঠায় দলকে। সেখানেই জঙ্গি হামলার শিকার হতে হয় শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের।
হামলাকারীরা শ্রীলঙ্কান টিম বাসে রকেট-চালিত গ্রেনেড ছুঁড়েছিল। তবে সেদিন লঙ্কান বাসের চালক মেহের মোহাম্মদ খলিল অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন। অবিরাম গুলির মধ্যেই পুরো গতিতে বাস চালিয়ে নিয়ে যান নিরাপদ দূরত্বে। বাসের নিচেও গ্রেনেড ছুড়ে মেরেছিলো হামলাকারীরা। কিন্তু মেহের মোহাম্মদ খলিলের দ্রুতগতির কারণে বিস্ফোরণের আগেই নিরাপদে যায় লঙ্কান টিম বাস। শ্রীলঙ্কান দলকে নিয়ে চলে যান গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের ভেতরে। তবে সেদিন ছজন ক্রিকেটার আহত হয়েছিলেন।
শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের মধ্যে আহত হন থিলান সামারাবিরা, চামিন্দা ভাস, মাহেলা জয়াবর্ধনে, কুমার সাঙ্গাকারা, থারাঙ্গা পারানভিতানা, অজন্তা মেন্ডিস ও সুরাঙ্গা লাকমল। হাসপাতালে নেওয়া হয় দুজনকে। জরুরী ভিত্তিতে লঙ্কায় নিয়ে যাওয়া হয় পুরো দলকে।
পাকিস্তান ক্রিকেটে প্রভাব কী ছিল
পাকিস্তান ক্রিকেট কার্যত এলোমেলো হয়ে যায় লাহোরের এই হামলার পর। নির্বাসিত হয়ে পড়ে দেশটির ক্রিকেট। পাকিস্তানকে এরপর থেকে হোম সিরিজের জন্য যেতে হয়েছে ইংল্যান্ড, আরব আমিরাত কিংবা শ্রীলঙ্কায়।
পাকিস্তানের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠে যায়। বিদেশি ক্রিকেট দলকে নিরাপত্তা দিতে না পারায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে পাকিস্তান সরকার। বন্ধ হয়ে যায় বিভিন্ন দলের সফর। ২০১৫ সালে জিম্বাবুয়ে আবার সফর করে পাকিস্তানে। এরপরেই আবার চার বছরের জন্য বন্ধ থাকে পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আয়োজন।
সেই অচলাবস্থা থেকে পাকিস্তানকে ফের উদ্ধার করেছিল শ্রীলঙ্কাই। ১০ বছর পর ২০১৯-এ পাকিস্তানে পা রাখে শ্রীলঙ্কা দল। সেই সফরে তিনটি করে একদিনের ম্যাচ ও টি-২০ ম্যাচ খেলে। এরপর থেকেই দেশটিতে আয়োজন হতে থাকে ক্রিকেটের আয়োজন। ২০২৩ সালে এসে এশিয়া কাপের আয়োজন করে তারা।
তবে এখনো পাকিস্তান সফরে যায়নি ভারত। এশিয়া কাপের উদ্দেশেও সেখানে পা রাখেনি টিম ইন্ডিয়া। যার কারণে এশিয়া কাপও আয়োজিত হয় হাইব্রিড মডেলে। যৌথ আয়োজক দেশ শ্রীলঙ্কাতেই হয়েছিল বেশিরভাগ ম্যাচ।
জেএ