আবদুল মমিন চৌধুরী : ইতিহাসবিদ থাকবেন ক্রিকেট ইতিহাসেও
দেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ আবদুল মমিন চৌধুরী। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত এই অধ্যাপক শুধু বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষকই নন ছিলেন অত্যন্ত ক্রিকেটানুরাগীও। গতকাল রাজধানীর নিজ বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন বিশিষ্ট এই ব্যক্তিত্ব। প্রখ্যাত এই ইতিহাসবিদ জড়িয়ে আছেন দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সঙ্গেও।
আশি-নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের ক্রিকেট বলতে ছিল অনেকটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দল। জাতীয় ক্রিকেটারদের প্রায় সবাই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাই জাতীয় ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় সেই সময় ঢাবির ফাইনাল খেলা অনেকটাই অবধারিতই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট দলের সেই স্বর্ণযুগের ম্যানেজার ছিলেন আবদুল মমিন চৌধুরী।
সত্তর-আশির দশকে দর্শক জনপ্রিয়তায় এগিয়ে ছিল ফুটবল ও হকি। ক্রিকেট ছিল অত্যন্ত অবহেলিত। সেই সময় ক্রিকেটের সেবক ছিলেন অধ্যাপক আব্দুল মুমিন চৌধুরী। ১৯৭৬-৮৯ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট দলের ম্যানেজার হয়ে জেলায়-জেলায় গিয়েছেন। মেধা, নিবেদন ও আন্তরিকতায় হয়েছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলেরও ম্যানেজার। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল নিয়ে গিয়েছিলেন পাকিস্তান সফরে। বাংলাদেশ ওয়ানডে দলের প্রথম অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজম্যান্ট বিভাগের ছাত্র ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় দল উভয় ক্ষেত্রে ম্যানেজার হিসেবে পেয়েছিলেন আব্দুল মমিন চৌধুরিকে, ‘এশিয়া কাপ খেলার আগে বা পরপর আমরা পাকিস্তান সফর করেছিলাম। স্যার আমাদের ম্যানেজার ছিলেন। শৃঙ্খলা ও আন্তরিকার অসাধারণ সমন্বয় ছিল স্যারের। ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা ছিল অনন্য পর্যায়ের ’-বলেন লিপু।
সত্তর-আশির দশকে দর্শক জনপ্রিয়তায় এগিয়ে ছিল ফুটবল ও হকি। ক্রিকেট ছিল অত্যন্ত অবহেলিত। সেই সময় ক্রিকেটের সেবক ছিলেন অধ্যাপক আব্দুল মুমিন চৌধুরী। ১৯৭৬-৮৯ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট দলের ম্যানেজার হয়ে জেলায়-জেলায় গিয়েছেন।
ক্রিকেটারদের প্রতি মমিন চৌধুরীর আন্তরিকতার উদাহরণ দিলেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী এবং সাবেক ক্রিকেটার জালাল ইউনুস, ‘ময়মনসিংহে শীতের সময় জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপের খেলা। স্যার ছিলেন ম্যানেজার। প্রতি রুমে রুমে গরম পানির ব্যবস্থা ছিল না। স্যার নিজ হাতে পানি গরম করে আমার রুমে এসে সকালে ডাকতেন পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে।’
সুদূর আমেরিকা থেকে জাতীয় দলের সাবেক পেসার গোলাম নওশের প্রিন্স স্মরণ করলেন গ্রীষ্মকালের ঘটনা, ‘জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপের কোনো আসর তীব্র গরমে হয়েছিল। মোজা পরে পেস বোলিং করে খুব কষ্ট করছিলাম। স্যার বিষয়টি খেয়াল করছিলেন। পরের ম্যাচেই দেখি স্যার আমার জন্য বরফের ব্যবস্থা করেছেন। স্যারের স্ত্রী নিজে বাসা থেকে আমার জন্য বরফ নিয়ে মাঠে এসেছিলেন।’ মমিন চৌধুরীর পরিবারও ছিল ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত। নিজের ছেলে রনি প্রথম বিভাগ ক্রিকেটার ছিলেন। তার শ্যালক চার্চিল জাতীয় পর্যায়ের ক্রিকেটার। মমিন চৌধুরী নিজেও ক্রিকেট খেলতেন।
জাতীয় দলের সাবেক তারকা ক্রিকেটার সেলিম শাহেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় না দেশের ক্রিকেটে মমিন চৌধুরীর অবদান ও প্রভাব অনেক বলে মন্তব্য করেন,‘আমরা যখন ক্রিকেট খেলেছি তেমন কিছুই পাইনি। শুধু সিঙ্গারা ও কাসার গ্লাসে পানি খেয়ে খেলেছি শুধু ভালোবাসার টানেই। সেই সময় স্যার আমাদের ক্রিকেট খেলতে যেমন উদ্বুদ্ধ করতেন তেমনি সততার শিক্ষাও দিতেন। স্যারের জন্য আমরা আরও ক্রিকেটের প্রতি নিবেদন পেয়েছিলাম। স্যার শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয় বাংলাদেশের ক্রিকেটেও অবদান রেখেছেন। মমিন চৌধুরী স্যারের পর আলী রশীদ (অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক) স্যারও ক্রিকেট নিয়ে কাজ করেছেন।’
এখন জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপে ক্রিকেটাররা লাখ টাকা ফি পান। সত্তর-আশির দশকে দৈনিক ভাতা ছিল মাত্র ৩০ টাকা। সেই দিনের স্মৃতি স্মরণ করলেন জালাল ইউনুস,‘আমাদের পেস বোলারদের খাবার একটু বেশি প্রয়োজন। অন্য সবার মতো আমরাও ৩০ টাকা করে পেতাম। স্যার আমাদের পেসারদের আলাদাভাবে নিজ থেকে ১০ টাকা করে বেশি দিতেন।’
শিক্ষকতার পাশাপাশি ক্রিকেটে অত্যন্ত মনোযোগ ছিল। আমেরিকা থেকে সেই রকম একটি বিষয় বললেন গোলাম নওশের প্রিন্স,‘স্যার টুর্নামেন্ট চলাকালে একটি নির্দিষ্ট প্যান্ট ও শার্ট পড়ে আসতেন। মনে করতেন সেটাই দলের জন্য লাকি।’ এ রকম বিষয়টি বললেন সাবেক ক্রিকেটার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক শওকতুর রহমান চিনু,‘ম্যাচ শুরুর আগে স্যার ব্রিফ করতেন। তখন আমাকে সব সময় ডান পাশে রাখতেন। আমি ডান পাশে বসার পর ম্যাচ জিতেছিলাম। এরপর থেকে যতদিন খেলেছি, আমাকে টিম মিটিংয়ে ডান পাশেই বসতে হতো।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিভাগ ও শওকতুর রহমান চিনু অনেকটা সমার্থক। চার দশকের বেশি সময় চিনুর সঙ্গে ঢাবির শারীরিক শিক্ষা বিভাগের সম্পর্ক। অনেক ক্রীড়াবিদ তার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে এসেছে। সাবেক ক্রিকেটার চিনুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এনেছিলেন এই মমিন চৌধুরী, ‘আমি তখন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে চাকুরি শুরু করেছি। হঠাৎ স্যার রাস্তায় আমাকে দেখে গাড়িতে উঠতে বললেন। গাড়িতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিভাগে যোগ দিতে বললেন। স্যারের প্রস্তাব এবং নিজের ক্যাম্পাস সব কিছু বিবেচনা করে যোগদান করি। স্যার বলেছিলেন, ‘একদিন পরিচালক হবে’। শেষ পর্যন্ত পরিচালক হয়ে অবসর নেই।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেটের প্রাণই ছিলেন মমিন চৌধুরী। ক্রিকেট অন্তঃপ্রাণ মমিন আকস্মিকভাবেই ক্রিকেটের সঙ্গে অলিখিতভাবে বিচ্ছেদ করেন। সেই ঘটনাটি বললেন চিনু,‘নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে আন্ত বিভাগ ক্রিকেট চলছে বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে। সেই ম্যাচের এক ঘটনায় বিক্ষুব্ধরা স্যারের প্রিয় গাড়ি পুড়িয়ে ফেলে। গাড়িটি স্যারের অত্যন্ত প্রিয় ছিল। স্যার এতটাই ব্যথিত হন আর বিশ^বিদ্যালয়ের ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত হননি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত আর না থাকলেও পরবর্তীতে ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করেছেন। ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে ছুটতেন স্টেডিয়ামে। তার ছাত্রদের সংকটে দিতেন পরামর্শ। পরোক্ষভাবে ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের সঙ্গেই ছিলেন।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের অন্যতম পরিচালক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববির সঙ্গে সম্পৃক্ততা অনেক দিনের। ববিও বিশেষভাবে স্মরণ করলেন মমিন চৌধুরীকে,‘স্যারের সঙ্গে নতুন বছরের আগের দিনও কথা হয়েছে। ক্রিকেটের নানা বিষয়ে আলোচনা করলেন। স্যার ক্রিকেটের অত্যন্ত শুভাকাঙ্ক্ষী। আশির দশকে ক্রিকেট বোর্ডের অনেক বিষয়ে সম্পৃক্ততা ছিল স্যারের।’ ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট অনেকের মতে, ১৯৮৫-৮৯ মেয়াদে ক্রিকেট বোর্ডের কমিটিতে ছিলেন মমিন চৌধুরী।
জাতীয় দলের সাবেক ম্যানেজার ও ক্রিকেট অন্তঃপ্রাণ এমন একজনের বিদায়ে ক্রিকেট বোর্ডের কোনো শোক বিজ্ঞপ্তি বা স্মরণ নেই। অথচ ক্রিকেটের সঙ্গে নতুন যুক্ত হওয়ায় অনেকের পরিবারের জন্যও বার্তা দেয় বিসিবি। ক্রিকেট বোর্ডের কয়েকজন পরিচালক ও প্রশাসনে কাজ করছেন মমিন চৌধুরীর অনেক ছাত্রই। আজ বিষয়টি কয়েকজন পরিচালকের দৃষ্টিগোচর হলে শোক বিজ্ঞপ্তির প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
এজেড/এফআই