ফুটবলের পথে কি আজাদের হকিও!
ফুটবলাঙ্গনে কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া এক নাম আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ফুটবলের কোনো স্তরেই নেই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি। ক্রিকেটে প্রথম বিভাগ, হকি, কাবাডি ও ভলিবলে প্রিমিয়ারে অংশ নেয় আজাদ স্পোর্টিং। এই চার খেলার মধ্যে আজাদের বিশেষ পরিচিতি হকিতে। সেই হকির দলবদলে এবার অংশগ্রহণ না করায় ক্রীড়াঙ্গনের সংশয়—ফুটবলের পথেই কি আজাদের হকি!
আজাদ স্পোর্টিংয়ের হকি মানেই ইউসুফ আলী। খেলোয়াড়-সংগঠক হিসেবে ক্লাবের সঙ্গে তার সম্পর্ক ৫০ বছরের। সেই ইউসুফ এখন ক্লাবের হকি থেকে দূরে, 'আমি এবার আজাদ স্পোর্টিংয়ের হকির সঙ্গে জড়িত নই।’ আজাদ ও ইউসুফ সমার্থক শব্দ! সেই ইউসুফের কণ্ঠে এমনটি শুনে বিস্মিত হওয়ার অবস্থা। বিচ্ছিন্নতার কিছু আচ পাওয়া গেল পরের মন্তব্যে, 'দীর্ঘদিন আমি দল গঠন ও পরিচালনা করেছি। আমি ক্লাবের (হকি ফেডারেশনের ) কাউন্সিলর না, যিনি কাউন্সিলর মূলত দল গঠনের দায়িত্ব তার।’
আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ক্রীড়াঙ্গনে পরিচিতি প্রবীণ ক্রীড়া সংগঠক ও পুষ্টিবিজ্ঞানী মজিবর রহমানের। তিনি হকি ফেডারেশনের ক্লাবের কাউন্সিলরও। ক্লাবের হকির বিদ্যমান অবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, 'আমার বয়স এখন ৮৪ বছর। বার্ধক্য এবং অসুস্থতার জন্য ক্লাবে সেভাবে যেতে পারি না এখন। তাই মান্নান সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছে।'
দলবদলে অংশগ্রহণে না করা এবং ক্লাব অন্তঃপ্রাণ ইউসুফের দূরে থাকার প্রসঙ্গে মান্নানের বক্তব্য, 'নির্দিষ্ট সময়ে দলবদল করতে না পারা আমাদের ব্যর্থতা অস্বীকার করছি না। তবে আমাদের সংকটের কথা উল্লেখ করে ফেডারেশনে দলবদল পেছানোর চিঠি দিয়েছিলাম। ইউসুফ ভাই আজাদ ক্লাবের সঙ্গে আছেন ও থাকবেন।’ গত তিন দশক আজাদ স্পোর্টিংয়ের হকি অনেকটা এক হাতেই সামলেছেন ইউসুফ। খেলোয়াড় জোগাড় করা, সম্মানী প্রদান করা সবই করেছেন নিবেদিতপ্রাণ এই সংগঠক। শুধু হকি নয়, ক্লাবের প্রায় সব কিছুতেই ছিল ইউসুফের সরাসরি সম্পৃক্ততা। হকি ফেডারেশনের ২০১৯ সালের পর গত নির্বাচনেও আজাদ স্পোর্র্টিং ক্লাবের কাউন্সিলরশীপ পাননি ইউসুফ। কাউন্সিলরশীপ ছাড়াও ক্লাবের কাছ থেকে প্রকৃত মূল্যায়ন না পেয়ে ইউসুফ অভিমানে দূরে মূলত।
ইউসুফের ক্লাবের প্রতি বিমুখতায় আজাদ স্পোর্টিংয়ের হকি বড় সংকটে। আজাদের ইতিহাসে কখনো দলবদলে অংশ না নেওয়ার রেকর্ড নেই। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন ক্লাবের কর্মকর্তা ও বর্ষীয়ান ক্রীড়া সংগঠক ফারুকুল ইসলাম, 'কিছু দিন আগে ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি আনিস ভাই (জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের প্রথম সচিব ) ইন্তেকাল করেছেন। তিনি যদি দেখে যেতেন আজাদ হকি দলবদলে নেই খুব কষ্ট পেতেন। ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের এমন বিষয়টি অবশ্যই দুঃখজনক।’
আজাদের দলবদলে অংশগ্রহণ না করা বাংলাদেশের হকির জন্য অত্যন্ত সংকটপূর্ণ মনে করেন হকির সাবেক তারকা রফিকুল ইসলাম কামাল, 'আমার ক্যারিয়ারের প্রথম ক্লাব আজাদ স্পোর্টিং। আমি সহ আরো অনেক খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার শুরু আজাদের মাধ্যমে। হকির আতুড়ঘর হিসেবে বিবেচিত এই ক্লাবটি দলবদলে অংশগ্রহণ না করা হকির জন্য বড় সংকটই।'
ফুটবল ও অন্য অনেক খেলায় দলবদলের সময়ের মধ্যে কোনো দল অংশগ্রহণ না করলে ঐ ক্লাব অংশগ্রহণ করবে না ধরা হয়। হকিতে অবশ্য ভিন্ন বিষয়। দলবদলে অংশগ্রহণ না করলেও খেলার সুযোগ থাকে আগের মৌসুমের খেলোয়াড়রা যদি অন্য ক্লাবে না যায় সেই খেলোয়াড় এবং নতুন খেলোয়াড় (কোনো ক্লাবে নিবন্ধিত নয়) নিয়ে। যদিও পেশাদার দৃষ্টিভঙ্গিতে এটি গ্রহণযোগ্য ও বৈধ নয়।
দলবদল না করলেও তাই আসন্ন লিগে অংশগ্রহণের সুযোগ অবশ্য রয়েছে প্রাচীন এই ক্লাবটির। সীমিত সেই সুযোগ ব্যবহার করেই লিগে অংশগ্রহণ করতে চান ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এমএ মান্নান, 'দলবদল করতে পারিনি আর্থিক ও নানা সংকটের কারণে। গত বার লিগ খেলা খেলোয়াড় এবং বিকেএসপি’র খেলোয়াড় নিয়ে আমরা দল গঠন করব।’
আজাদ স্পোর্টিং নানা সংকটের মধ্যে প্রিমিয়ার লিগ হকিতে টিকে রয়েছে। শেষ মুহূর্তে নামকওয়াস্তের দল গড়লে রেলিগেশন এড়ানোই কষ্টদায়ক হবে। দলগঠনে উদাসীনতায় শঙ্কা উঠেছে ফুটবলের মতো হকিতেও কি হারিয়ে যাবে আজাদ? ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মান্নান অবশ্য অভয় দিলেন, 'আমরা হকি লিগে অবশ্যই অংশগ্রহণ করব এবং টিকেও থাকব। হকিতে অবশ্যই আজাদ স্পোর্টিং থাকবে।’
আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি বিসিবির অন্যতম পরিচালক এনায়েত হোসেন সিরাজ। আবাহনী, মোহামেডানের মতো আজাদ স্পোর্টিংকে লিমিটেড কোম্পানির প্রস্তাব দিয়েছিলেন এই সংগঠক। এই প্রসঙ্গে ক্লাবের কর্মকর্তা ফারুকুল ইসলাম বলেন, 'বছর দেড়েক আগে এক সভায় সভাপতি আলোচনা করে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এরপর আর সভা হয়নি এবং অগ্রগতি জানতে পারিনি।’
অন্য সব ক্লাবের মতো আর্থিক সংকট আজাদেরও। নেই নিজস্ব কোনো আয়ের ব্যবস্থা। কর্মকর্তাদের আর্থিক অনুদানই মূল চালিকা শক্তি। তাই আরামবাগ এলাকায় আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের টেন্টের জৌলুস দিনকে দিন কমছে। এরপরও ক্লাবটি এখনও মর্যাদার জায়গায় আছে দাবি অনেক দিন সাধারণ সম্পাদক থাকা মজিবর রহমানের, 'ক্লাব পাড়ায় ক্যাসিনোর মতো কান্ড ঘটেছে। আমাদের ক্লাবে এসব কিছু নেই। মাঠে সাফল্য সেভাবে না থাকলেও ইতিহাস-ঐতিহ্য আমরা সমুন্নত রেখেছি শত কষ্টের মধ্যেও।’
১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আজাদ স্পোর্টিং পাকিস্তান আমলে ফুটবলে ছিল শিরোপার লড়াইয়ে। ১৯৫৮ সালে মারী-রণজিৎ দাশের আজাদ ঢাকা লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়। অনেক ফুটবল বিশেষজ্ঞ এবং প্রবীণ ফুটবলারদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশি ফুটবলারদের মধ্যে মারী এবং রণজিৎ দাশ সেরা স্ট্রাইকার ও গোলরক্ষক। স্বাধীনতার পর আজাদ তারকাখচিত ক্লাবের পরিবর্তে তারকা তৈরির ক্লাবে পরিণত হয়। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে খেলোয়াড়, কোচ, সংগঠক সকল কিছুরই কারখানা হিসেবে পরিচিত। ফুটবলার আব্দুস সালাম মুর্শেদীর ক্রীড়াঙ্গনে পদার্পণ আজাদ স্পোর্টিং থেকেই। ফুটবলার, ব্যবসায়ী থেকে সালাম মুর্শেদী এখন হ্যাটট্টিক সংসদ সদস্য। এরপরও নানা আড্ডায় আজাদের স্মৃতি তুলে ধরেন এভাবৎ, 'খুলনা থেকে ট্র্যাঙ্ক নিয়ে আজাদ স্পোর্টিংয়ে উঠে ছিলাম।’
ভলিবলেও ছিল এক সময় আজাদের দাপট। সাবেক ফুটবলার ও ভলিবল খেলোয়াড় মোস্তফা কামাল সেই স্মৃতি স্মরণ করলেন, 'আজাদ স্পোর্টিংয়ের অন্যতম ঐতিহ্য ভলিবল। এক সময় আমাদের ক্লাব হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়নও ছিল। রওশন আরা ছবির মতো কৃতি অ্যাথলেট আমাদের ক্লাব থেকে অ্যাথলেটিক্সে অংশ নিত।’ ফুটবলের মতো অ্যাথলেটিক্সও বিলুপ্ত। ক্রিকেট, কাবাডি ও ভলিবল টিকে থাকলেও হকির এবারের ঘটনা ক্রীড়াঙ্গনে আজাদকে নিয়ে নতুন শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে।
এজেড/এইচজেএস