সব ছাপিয়ে আলোচনায় সোহাগ কাণ্ড
মাঠ ও মাঠের বাইরে বাংলাদেশের ফুটবলে ঘটনাবহুল একটি বছর কাটছে। তবে সকল সাফল্য-ব্যর্থতা ছাপিয়ে বাফুফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগকে দেওয়া ফিফার নিষেধাজ্ঞা–ই ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ফুটবলে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়।
গত ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের দিন ফিফা বাফুফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সোহাগকে ২ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে। ফিফা বাফুফের আর্থিক বিষয়াদির ওপর কয়েক বছর তদন্ত করে সোহাগের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা আনে। ২০১৩ সাল থেকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা সোহাগের এই নিষেধাজ্ঞায় কেঁপে ওঠে পুরো ক্রীড়াঙ্গন।
সোহাগের নিষেধাজ্ঞায় বাফুফেতেও লাগে বড় ধাক্কা। ফিফার প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বাফুফে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ফিফার প্রতিবেদনে নাম থাকা কয়েকজন স্টাফকে কয়েক দফা জেরা করে তদন্ত কমিটি। বাফুফের তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন প্রকাশের আগেই অভিযুক্তরা একে একে ফেডারেশন ছাড়েন। তদন্ত কমিটি সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনকে প্রতিবেদন দিলেও সেই প্রতিবেদন নির্বাহী সভায় উত্থাপন হয়েছে কয়েক মাস পর। নির্বাহী সভায় উঠলেও সেই প্রতিবেদন নিয়ে এখনও আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি ফেডারেশন।
সোহাগ কাণ্ডের পরবর্তী পরিস্থিতি
অন্যদিকে, আর্থিক বিষয়াদি নিয়ে ব্যারিস্টার সুমন দুদকে একটি আবেদন করেন। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে একটি মামলা হয় হাইকোর্টে। সেই মামলায় স্বাক্ষ্য দিতে হয়েছে বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনকেও। আবার ব্যারিস্টার সুমনসহ আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে বাফুফে সভাপতি পাল্টা মামলা করেন। যার ফলশ্রুতিতে এই বছরের কয়েক মাস ফুটবল ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের আদালত পাড়ায় দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে।
সোহাগ কাণ্ডের তিন দিন পরই সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের ব্যক্তিগত সচিব (পিএস) ইমরান হোসেন তুষার বাফুফের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন। যদিও তিন মাস পর সাধারণ সম্পাদকের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের কথা ছিল। কিন্তু বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে বাফুফের নির্বাহী কমিটি পারফরম্যান্সে সন্তুষ্ট হয়ে ছয় মাস পর ইমরান হোসেন তুষারকেই স্থায়ীভাবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মনোনীত করে।
ঘটনাবহুল নারী ফুটবল
সোহাগ কাণ্ডের সপ্তাহ দুয়েক আগেই বাফুফেতে কাঁপন ধরেছিল। মার্চে মিয়ানমারে অলিম্পিক বাছাইয়ে সাবিনাদের পাঠায়নি ফুটবল ফেডারেশন। ফেডারেশনের আর্থিক অনটনের কারণে সাফ চ্যাম্পিয়নদের খেলতে না পাঠানোর ঘটনায় তখন তীব্র সমালোচনাও হয়েছিল। এই ঘটনার রেশ ধরে দেশের দুই শীর্ষ ক্রীড়া সংস্থা বাফুফে ও বিসিবি সভাপতির বাকযুদ্ধও ছিল কয়েক দিন।
আরও পড়ুন
২০২২ সালে সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন সাবিনা খাতুনরা। এই বছরটি তাদের অবশ্য খুব ভালো যায়নি। বছরের বেশিরভাগ সময়ই গিয়েছে আন্দোলন-সংগ্রামে। সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ফেডারেশনের দুই শীর্ষ কর্তা অর্ধকোটি টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। পুরস্কার, নিয়মিত বেতন-বকেয়াসহ নানা ইস্যুতে অনুশীলন বর্জন করেছিলেন সাবিনারা। অভিমানে সাবিনাদের গুরু গোলাম রব্বানী ছোটনও কোচের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। নানা নাটকের পর ফেডারেশন ছাড়েন ব্রিটিশ টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পল স্মলিও।
এত নাটকীয়তার মধ্যে জাতীয় দলের সাবেক কোচ সাইফুল বারী টিটুর আর্বিভাব হয় নারী ফুটবলে। টিটুর অধীনে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মতো অংশ নেয়। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জাপানের গ্রুপে পড়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন সাবিনারা। নেপালকে হারিয়ে সাফ জেতা সাবিনারা এই বছর তিন বার নেপালকে পেয়েও হারাতে পারেনি।
জাতীয় দলের মতো সাবিনাদের ঘরোয়া ফুটবলেও হয়েছে অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা। নারী ফুটবলের ফ্রাঞ্চাইজি লিগ আয়োজনের ঘোষণা দিয়েও বাস্তবায়ন না হওয়ায় অনেক ক্ষোভ সাবিনাদের। অন্যদিকে বসুন্ধরা কিংসও নারী লিগে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে এসব নারী ফুটবলাররা গভীর সংকটে পড়েছেন।
পুরুষ ফুটবলের ইতিবাচক বছর
জামাল ভূঁইয়াদের জন্য এই বছরটি ছিল বেশ ইতিবাচকই। ১৪ বছর পর সাফের সেমিফাইনালে খেলেছে বাংলাদেশ। স্প্যানিশ কোচ হ্যাভিয়ের ক্যাবরেরার অধীনে বাংলাদেশ বেশ সুন্দর ফুটবলের নজির দেখিয়েছে। সাফ ছাড়াও বিশ্বকাপ বাছাইয়ে নিজেদের মাটিতে লেবাননকে রুখে দেয় লাল-সবুজ বাহিনী। যার ধারাবাহিকতায় ক্যাবরেরার পারফরম্যান্সে সন্তুষ্ট হয়ে বাফুফে তার মেয়াদ আরও এক বছর বৃদ্ধি করেছে।
দলীয় পারফরম্যান্স ছাড়াও ব্যক্তিগত অর্জন ও প্রাপ্তি রয়েছে ফুটবলে। বাংলাদেশের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আর্জেন্টিনার লিগে খেলছেন। যদিও এই লিগে তার অংশগ্রহণ নিয়ে দেশীয় ক্লাব শেখ রাসেলের সঙ্গে টানাপোড়েন ছিল অনেক। এই বছর অভিষেক হওয়া তরুণ ফুটবলার মোরসালিন ইতোমধ্যে জাতীয় দলের জার্সিতে কয়েকটি গোল করেছেন। এরপর থেকেই তাকে বিবেচনা করা হচ্ছে বাংলাদেশের ফুটবলে নতুন আশার আলো হিসেবে।
মার্টিনেজ-রোনালদিনহোর আগমন
বাফুফে ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা না থাকলেও এই বছর বাংলাদেশে এসেছিলেন বিশ্ব ফুটবলের দুই ব্যক্তিত্ব। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জেতানো গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজের পর এসেছিলেন ব্রাজিলের রোনালদিনহোও। ব্যক্তিগত পর্যায়ে দুই সফরে আলোচনার চেয়ে সমালোচনাই হয়েছে বেশি।
কিংসের ইতিহাস, মদকাণ্ডে নিষিদ্ধ ফুটবলার
ঘরোয়া ফুটবলে ২০২৩ কিংসের ইতিহাসের বছরও। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে টানা চার বার লিগ শিরোপার কৃতিত্ব নেই কারও। ২০১৮ সালে প্রিমিয়ার লিগে আসা বসুন্ধরা কিংস অল্প সময়ের মধ্যেই এই কৃতিত্ব অর্জন করেছে। বছরের মাঝামাঝিতে প্রিমিয়ার লিগ শিরোপার পাশাপাশি শেষদিকে অনুষ্ঠিত নতুন মৌসুমের স্বাধীনতা কাপেও চ্যাম্পিয়ন শিরোপা অক্ষুণ্ন রেখেছে কিংস।
বসুন্ধরা কিংস দেশের শ্রেষ্ঠত্বের গণ্ডি পেরিয়ে দক্ষিণ এশিয়াতেও সেরা হওয়ার দৌড়ে ছিল। ভারতের ওড়িষার বিপক্ষে ড্র করতে পারলেই এএফসি কাপে দক্ষিণ এশিয়ার গ্রুপসেরা হয়ে পরবর্তী ধাপে খেলত কিংস। ওই ম্যাচে রেফারির একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্তে কিংসের স্বপ্নভঙ্গ হয়। যদিও এএফসি কাপে কিংস ভারতের ঐতিহ্যবাহী ও শক্তিশালী মোহনবাগানকে পরাজিত করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এর আগে এএফসি কাপে মোহনবাগানকে হারানোর রেকর্ড নেই বাংলাদেশের কোনো ক্লাবের। ইতিহাস ঘটানো এএফসি কাপেই ন্যাক্করজনক ঘটনাও ঘটেছে কিংসের। মালদ্বীপ থেকে ফিরে আসার পথে কিংসের ফুটবলাররা মদ বহন করেন। যার দায়ে তদন্ত করে জিকো, তপু, মোরসালিন, রিমন ও সবুজকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয় ক্লাব কর্তৃপক্ষ। সবুজ বাদে বাকি চার জনের শাস্তি প্রত্যাহার হওয়ায় তারা এখন দলের সঙ্গে রয়েছেন।
১৪ বছর পর মোহামেডানের শিরোপা
২০২৩ সালটি ঐতিহ্যবাহী ক্লাব মোহামেডানের প্রত্যাবর্তনের বছরও। প্রায় এক দশক ফুটবলে শিরোপাখরায় থাকা মোহামেডান এই বছরেই দুটি টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলেছে। গত মৌসুমে (এই বছরের মে মাস) ১৪ বছর পর ফেডারেশন কাপের চ্যাম্পিয়ন হয় তারা। জনপ্রিয় ক্লাবের সেই ট্রফি জয় ক্রীড়াঙ্গনে নব জাগরণ তৈরি করেছিল। এই মাসে নতুন মৌসুমের প্রথম টুর্নামেন্ট স্বাধীনতা কাপের ফাইনালেও উঠেছিল সাদা-কালো জার্সিধারীরা। তবে দশ জনের কিংসকে পেয়েও মোহামেডান জিততে পারেনি।
দুর্নীতির দায়ে নিষিদ্ধ বিকেএসপি
ঘরোয়া ফুটবলে জুনিয়র লিগগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। এবার সেই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত খোদ বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি)। খেলোয়াড় জালিয়াতির জন্য বাফুফে এক বছরের জন্য বিকেএসপিকে নিষিদ্ধ করেছে। বিকেএসপি’র কোচের এই খেলোয়াড় জালিয়াতিতে দায় থাকলেও, বাফুফের ডিসিপ্লিনারি কমিটির সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে!
আরও পড়ুন
পাওয়া-না পাওয়ার বয়সভিত্তিক ফুটবল
বয়সভিত্তিক পর্যায়ে বাংলাদেশের সাফল্য এই বছর মাত্র একটি। কমলাপুর স্টেডিয়ামে সাফ নারী অনূর্ধ্ব-২০ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এছাড়া সাফ অ-১৭ টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেছিল শক্তিশালী রাশিয়া। তাই বাংলাদেশ নারী দল সাফ অ-১৭ টুর্নামেন্টে রানার্সআপ হয়। গত দুই আসরে এএফসি অ-১৬ টুর্নামেন্টে নারী দল মূল পর্বে খেলেছিল। এবার মূল পর্বে উঠতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ।
এবার বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতায় পুরুষদের কোনো শিরোপা নেই। সাফ অ-১৬ টুর্নামেন্টে ভূটানে বাংলাদেশ ভারতের বিপক্ষে হারে এবং অ-১৯ টুর্নামেন্টে কাঠমান্ডুতে সেমিফাইনালেই উঠতে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ।
বয়সভিত্তিক পর্যায়ে বাফুফে দারুণ এক উদ্যোগ নিয়েছে বছরের শেষ মাসে। ১৭০ একাডেমি নিয়ে ফিফার অর্থায়নে টুর্নামেন্ট করছে দেশের ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এমন উদ্যোগ বাংলাদেশের ফুটবলে এবারই প্রথম।
এজেড/এএইচএস