‘পরবর্তী সাকিব-তামিম খুঁজে পাওয়া অসম্ভব’
২০১২ সালে বাংলাদেশকে এশিয়া কাপটা প্রায় জিতিয়েই দিয়েছিলেন কোচ স্টুয়ার্ট ল। ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ২ রানের হার এখনো পোড়ায় টাইগার ক্রিকেটের ভক্তদের। প্রায় একযুগ পর সেই পোড়া ক্ষতে হালকা প্রলেপ পড়েছে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কল্যাণে। দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত যুব এশিয়া কাপ জয় করে এসেছে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল। আর এবারেও কোচের দায়িত্বে সেই স্টুয়ার্ট ল।
ল-এর অধীনেই প্রথমবার বাংলাদেশ এশিয়া কাপের ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছিল। সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিমদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন এই অস্ট্রেলিয়ান কোচ। খুব অল্প সময়ের জন্য কোচ হলেও ক্রিকেট ভক্তদের কাছে স্টুয়ার্ট ল-এর নামটা এখনও বেশ আপন।
অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপ জেতার পর অজি এই কোচের সঙ্গে আলাপ হয় ঢাকাপোস্ট-এর। যেখানে উঠে এসেছে সাকিব-তামিম প্রসঙ্গ। কথা হয়েছে নতুন তারকাদের বড় নাম হয়ে ওঠা প্রসঙ্গেও। শুনিয়েছেন বিশ্বকাপ জয়ের প্রত্যাশাও। ঢাকাপোস্টের সাকিব শাওনের সঙ্গে তার আলোচনা তুলে ধরা হলো পাঠকদের উদ্দেশে।
ঢাকাপোস্ট: আপনার অধীনে বাংলাদেশ প্রথমবার এশিয়া কাপের চ্যাম্পিয়ন। কীভাবে এলো এই সাফল্য?
স্টুয়ার্ট ল: এশিয়া কাপ পর্বটা ভালোই ছিল। আমরা কিভাবে খেলব সেই পরিকল্পনা থেকে শুরু করেছি। মানে আগের সিরিজে ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করেছি। নিশ্চিত করেছি, আমাদের পক্ষে যা যা করা সম্ভব, তার সবটাই আমরা করব, যেন ভুলগুলো ঠিক করে নেওয়া যায়।
খেলোয়াড়দের সঙ্গে মিটিং হয়েছে, যেসব পরিকল্পনা করা হয়েছে, আমরা তা বাস্তবায়ন করেছি। এগুলোই ফলাফল নির্ধারণ করে দিয়েছিল। তাই সবমিলিয়ে ক্যাম্পেইন ভালোই ছিল।
ঢাকাপোস্ট: বিশ্বকাপের প্রস্তুতিপর্ব বলা হচ্ছিল এই আসরকে (যুব এশিয়া কাপ)। ছেলেদের প্রতি কী বার্তা দিয়েছেন এই আসরে?
স্টুয়ার্ট ল: আপনি বলতেই পারেন এটা আমাদের জন্য (বিশ্বকাপের আগে) প্রস্তুতি ছিল। দলের মধ্যে কম্বিনেশন যাচাই করে নেওয়ার চেষ্টা ছিল। বিভিন্ন ধরণের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে খেলা হয়েছে, তাই এটা খুবই ভালো অভিজ্ঞতা ছিল। আমি শেষ ১৮ মাস এখানে আছি। প্রথম ১২ মাস ছিল বাছাইয়ের পর্ব, সুযোগ গ্রহণ করা। সেইসঙ্গে তরুণ ক্রিকেটারদের উন্নতি ঘটানো। সেইসঙ্গে তাদের কঠিন পরিস্থিতি থেকে জয় আনার প্রক্রিয়া শেখানো।
এখন ওরা জানে, যখন ভয় পাওয়ার মত পরিস্থিতি আসবে, তখন ভয় না পেয়ে নির্ভার থাকতে হবে। কেবল মূলকাজ ঠিক রাখতে হবে আর যা কিছু করা দরকার, সেটাই করতে হবে, নিজেদের সেরা ক্রিকেটই খেলতে হবে। তাই এশিয়া কাপ আমাদের জন্য খুব খুব ভাল একটা দিক ছিল। আর সেটা জিতে আসা ছিল অবিশ্বাস্য। অন্যদিক থেকে ভাবলে, জয়টা আমাদের প্রাপ্য ছিল।
ঢাকাপোস্ট: অনেকটা দিন ধরেই এই ছেলেদের সঙ্গে আছেন। কীভাবে দেখছেন এই দলটাকে?
স্টুয়ার্ট ল: এই ছেলেদের সঙ্গে আমি ১৮ মাস বা তারচেয়ে বেশি সময় ধরে আছি। আর স্কোয়াডে থাকা প্রত্যেকেই উন্নতি করেছে। সেটা কেবল ক্রিকেটীয় দিক থেকে না বরং শারিরীক শক্তিমত্তার দিক থেকেও। তাদের এখনো অনেক কিছুই শেখার আছে। এখনো শেখা শেষ হয়নি, সেটা যেকোন দিক বিবেচনাতেই বলছি। আর তাদের প্রতি আমার বার্তা হলো, আমরা প্রতিদিন শিখে যাব। প্রতিদিনই আমরা ভাল করার চেষ্টা করব।
আরও পড়ুন
আর আমি বলব, তাদের বেশ ভাল উন্নতি হয়েছে। শারিরীকভাবে ভাল করেছে, শক্তিশালী হয়েছে। যেটা তাদের মানসিকভাবেও শক্ত হতে সাহায্য করেছে। আর এখন যেহেতু ওরা জানে, কিভাবে ব্যাটিংয়ে একটা ইনিংস সাজাতে হয়, আর একইসঙ্গে বল হাতেও আগ্রাসী হয়েছে। স্কোয়াডে থাকা সকলের প্রতি এবং স্টাফদের প্রতিও বক্তব্য, দলের প্রয়োজন সবার আগে প্রাধান্য পাবে। মানসিকভাবে আমরা সকলেই বেশ শক্ত।
ঢাকাপোস্ট: আপনি এর আগে সাকিব আর তামিমের সঙ্গে কাজ করেছেন। কী মনে হয়, এই দল থেকে বাংলাদেশ পরবর্তী সাকিব কিংবা তামিমকে খুঁজে পাবে?
স্টুয়ার্ট ল: আমরা জানি, সকলেই নতুন সাকিব আর নতুন তামিমের অপেক্ষা করছে। অস্ট্রেলিয়া নতুন শেন ওয়ার্ন খুঁজছে। ইংল্যান্ড অনেকদিন থেকেই নতুন ইয়ান বোথাম খোজার চেষ্টা করছে। আমি মনে করি, এসব খেলোয়াড় নিজ নিজ জায়গায় অসাধারণ। আমি মনে করি না, আরও একজন সাকিব আসবে, এটা একেবারেই নিশ্চিত। সে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এবং সারাবিশ্বের ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটে অস্বাভাবিক সফল একজন খেলোয়াড়।
তামিম তো বাংলাদেশ না, বিশ্বের অন্যতম সেরা ওপেনার। কখনো কখনো সে সেরা হওয়ার কাছাকাছি ছিল। তাই আমার মনে হয়, এই দুজন খেলোয়ার নিজেদের জায়গায় অনন্য। তাদের পরবর্তী কাউকে পাওয়া অসম্ভব।
সাকিব একেবারেই আলাদা। সে জানে কিভাবে বাইরের সমালোচনা বাদ দিয়ে নিজের কাজটা করে যেতে হয়। আর এটা সময় এবং অভিজ্ঞতার সাথে সাথে আসে। সেটা ওর মাঝে ১৮-১৯ বছর বয়সে ছিল না। সে ধীরে ধীরে এটা রপ্ত করেছে আর বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার হয়ে উঠেছে।
আমার মনে হয়, আমাদের এমন খেলোয়াড় খুঁজে বের করতে হবে, যারা ওই পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করতে চাইবে। দলগত হিসেবে আমার মনে হয়, আমরা সেটা করতে পারব। তারা এখনই আরেকটি গল্প লিখতে প্রস্তুত। তবে আমাদের এমন খেলোয়াড় আছে, যারা বাংলাদেশের সেরা খেলোয়াড় হতে পারে।
ঢাকাপোস্ট: বলছিলেন সাকিবের কথা। আপনি তার কোচ ছিলেন। আপনার মতে সাকিব কেন এতগুলো বছর ধরে বিশ্বসেরা ক্রিকেটার, যেখানে বাকিরা ভরসাই হারিয়ে ফেলে?
স্টুয়ার্ট ল: একটা বিষয়, প্রত্যাশা একজনের ক্যারিয়ারকে এগিয়ে নিতে পারে। আর প্রত্যাশা হতে হবে বাস্তবসম্মত। সেটা কখনো অবাস্তব হতে পারে না। আর আমাদের সময়, আপনার হাতে খেলোয়াড় আছে, যাদের কাছ থেকে আপনি ভাল কিছু চান আর তাদের সেই মানের পারফর্মের জন্য ক্রিকেটের সঠিক ধারণা আছে। আর তাদের খুব কম বয়সে বড় ম্যাচের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হতো। আর সেটা তাদের মানসিকভাবে প্রভাব ফেলতে পারতো। একইসঙ্গে শারীরিক দিক থেকেও।
আর ক্রিকেটে আমরা সবাই জানি, এটা একটা মানসিক খেলা। প্রত্যাশা সামর্থ্যের চেয়েও অনেক বেশি থাকে। আর এটা কোনো না কোনো পর্যায়ে ব্যর্থতা ডেকে আনে। আর সত্যি বলতে সাকিব একেবারেই আলাদা। সে জানে কিভাবে বাইরের সমালোচনা বাদ দিয়ে নিজের কাজটা করে যেতে হয়। আর এটা সময় এবং অভিজ্ঞতার সাথে সাথে আসে। সেটা ওর মাঝে ১৮-১৯ বছর বয়সে ছিল না। সে ধীরে ধীরে এটা রপ্ত করেছে আর বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার হয়ে উঠেছে। তাদেরকে প্রত্যাশা বাস্তবিক পর্যায়ে রাখতে হবে। যে অতিমানবীয় কিছু করতে পারবে না, তার কাছ থেকে আপনার অতিমানবীয় কিছু প্রত্যাশা রাখা উচিত না।
ঢাকাপোস্ট: শিরোপা জয়ের পর বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপনের সঙ্গে কী কথা হয়েছে?
স্টুয়ার্ট ল: আমি শিরোপা জয়ের পর বিসিবি সভাপতির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাইনি। দল ঢাকায় আসার পরেই একটা ডিনার পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি, এটা বিসিবি প্রেসিডেন্ট এবং বিসিবির পক্ষ থেকে দারুণ একটা উদ্যোগ। আমি নিশ্চিত, সামনে আমি তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাবো। আমি এই মুহূর্তে ছুটিতে আছি।
ঢাকাপোস্ট: বাংলাদেশ কি আবার চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে?
স্টুয়ার্ট ল: এই প্রশ্নটা আমি প্রচুর পাই। আমরা কি আবার চ্যাম্পিয়ন হতে পারব? বাংলাদেশের আবার চ্যাম্পিয়ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে আমরা এখন থেকেই যদি চিন্তা করি, আমরা জিতব বা জিততে পারব, সেটা আমাদের জন্য ভাল হবে না। আমার কাজ ছেলেদের মাঠে ফিট রাখা এবং বাকিদের সবার মাঠের খেলায় ভরসা রাখা। একবার যদি মূল কাজ ঠিকঠাক করতে পারি, সেটা ক্রিকেট স্কিল এবং মানসিক স্কিলের দিক থেকে আমরা আরও ভাল করব।
আমরা গ্রুপ পর্বের ম্যাচ থেকে জয়ের প্রক্রিয়া শুরু করব। ট্রফি জয়ের চিন্তা করার আগে আমাদের নিজেদের সব কাজ ঠিকভাবে শেষ করতে হবে। যেমনটা আমরা এশিয়া কাপে করেছি। আমরা প্রতিপক্ষ নিয়ে চিন্তা না করে, আমাদের কী করণীয় তা নিয়েই আলাপ করেছি।
ঢাকাপোস্ট: আশিকুর রহমান শিবলী, মারুফ মৃধা এবং অধিনায়ক রাব্বি ছিল আপনার দলে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ হিসেবে তাদের কীভাবে দেখছেন?
স্টুয়ার্ট ল: আপনি তিনজনের কথা বলেছেন। তারা তিনজনেই দারুণ টুর্নামেন্ট পার করেছে। শিবলী নিশ্চিতভাবেই টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়। আর এটাও অঘটন ছিল না। এটা রাতারাতি আসেনি। কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসস্যের মাধ্যমে এই ফলাফল এসেছে। তাকে উইকেটরক্ষকের দাইয়িত্বটাও নিতে হয়েছে। আমি সবসময় তার ব্যাটিংয়ের ভক্ত। সে প্রচুর প্রশ্ন করে, অনেক জানতে চায়। তাই এটা অস্বাভাবিক ছিল না। তাই তার উপর চোখ রাখতেই হবে।
অধিনায়ক রাব্বি সম্ভবত সবচেয়ে অভিজ্ঞ। ঘরোয়াতে আর সবার চেয়ে বেশি ক্রিকেট খেলে। দলে তার মত একজন থাকা দারুণ কিছু। দারুণ ফিল্ডিং করে, বোলিংয়ে উইকেট পায় নিয়মিত। আর যখন ব্যাট করে, তার ভাল কিছু শট আছে। সে বাউন্ডারি বের করতে জানে।
পেস বোলার মারুফের কথা বলেছেন। সে নতুন বলে উইকেট নিয়েছে। যেটা আমাদের লক্ষ্য ছিল। এটা অপরপাশ থেকে তৈরি হওয়া চাপের ফলাফল। ইমন অন্যপাশ থেকে দারুণ বল করেছে। সে হুয়ত তার প্রাপ্য উইকেট পায়নি। সে দারুণ বল করেছে। রানের গতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। আর যখন জুটি হিসেবে এমন কিছু পাবেন, কেউ না কেউ এর সুবিধা আদায় করবে। মারুফ এই টুর্নামেন্টে উইকেট পেয়েছে, হয়ত পরেরবার ইমন তেমন পাবে।
এসএইচ/জেএ