জাতীয় লিগে নিম্নমানের আম্পায়ারিং, যা বলছে কোচ-বিসিবি
ভারতের মাটিতে চলছে ওয়ানডে বিশ্বকাপ আসর। তার মধ্যেই বাংলাদেশে চলছে ২৫তম জাতীয় ক্রিকেট লিগ (এনসিএল)। যেখানে বরাবরের মতো এবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে দেশের আম্পায়াররা। এনসিএলে ঘটেছে একাধিক বিতর্কিত ঘটনা এবং হয়েছে বাজে আম্পায়ারিংও। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভিডিওসহ প্রতিবাদ জানাচ্ছেন দলগুলোর কোচরা।
চলমান জাতীয় ক্রিকেট লিগে বিশেষ একটি দলকে সুবিধা দিতে মরিয়া দেশীয় আম্পায়াররা– এই অভিযোগও উঠেছে। গতকাল (শনিবার) বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক রাজিন সালেহ ক্ষোভ প্রকাশ করে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন, যার সঙ্গে মিল রেখে তিনি আজ ভিডিও প্রকাশ করেছেন। বর্তমানে সিলেট বিভাগের প্রধান কোচের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
ঘরোয়া ক্রিকেটে একাধিক ম্যাচে আম্পায়ারের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের ভিডিও ফুটেজ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। চট্টগ্রাম এবং খুলনা বিভাগের একটি ম্যাচ চলছিল। বোলার আল-আমিন হোসেনের বলে স্লিপে ক্যাচ তুলে দেন ইয়াসির আলী রাব্বি। ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজেই স্পষ্ট মাটিতে পড়ার আগেই নিয়ম অনুযায়ী বৈধ ক্যাচ নিয়েছেন ফিল্ডার। খুলনা বিভাগ উইকেট পাওয়ার উল্লাসে মত্ত। তবে স্ট্রাইকে থাকা ইয়াসির রাব্বি নিজের অবস্থানে অনড়। আম্পায়ারও কোন সংকেত দিলেন না আউটের।
একইম্যাচের আরেকটি চিত্র। নাহিদুল ইসলামের বলে শর্ট ফিল্ডারের হাতে ক্যাচ। খুলনার খেলোয়াড়রা যখন উল্লাসে মত্ত, তখন চট্টগ্রামের নাইম নিজের হাত দিয়ে ইশারা করছেন বল ক্রিজে ড্রপ খেয়ে ফিল্ডারের কাছে গেছে। এবারও আম্পায়ার সায় দিলেন চট্টগ্রামের পক্ষে। তাতে আরও একবার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান খুলনার ক্রিকেটাররা।
আম্পায়ারদের এরকম বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা পোস্টকে অনেক বছরের জমানো ক্ষোভ জানিয়ে রাজিন বলেন, ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট এভাবে কখনও আগাবে না। পিছিয়ে পড়ার কারণ এটাই। আজকে আমাদের বলার কেউ নেই, কেউ কথা বলছে না। কেউ যদি ২০ শতাংশ বা ৫০ শতাংশও বলে তাকে জরিমানা করছে। এত নিন্মমানের আম্পায়ারিং, তবুও কথা বলার কেউ নেই।’
সৈয়দ রাসেলের দাবি– আমরা তাদের কাছ থেকে পক্ষ-বিপক্ষ চাই না, চাই সঠিক আম্পায়ারিং। এই তর্ক-বিতর্ক একদিনে শেষ হবে না, তারাও মানুষ। এজন্য প্রযুক্তি দরকার, ম্যাচ ব্রডকাস্টিংয়ের আওতায় আনতে হবে। যখন ব্রডকাস্ট থাকবে, তখন ডিসিশনগুলো সবাই মানতে বাধ্য হবে। এমন ঘটনা সবসময় হয়।
বাজে আম্পায়ারিংয়ের কারণে ক্রিকেটারদের ক্যারিয়ার হুমকিতে বলে মনে করেন রাজিন, ‘আমার একটা খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার তো শেষ হয়ে যাচ্ছে। একটা ইয়ং ছেলে একটা ম্যাচে সুযোগ পেল, দেখা গেল দুই ইনিংসেই সে বাজেভাবে আউট। তার আর ক্যারিয়ার কোথায়? তাকে সুযোগ দেওয়া হবে কি আর?’
রাজিনের অভিযোগ বিশেষ দলকে সুযোগ দিতে এমন করছেন আম্পায়াররা, ‘এত নিন্মমানের ম্যাচ পরিচালনা হলে বাংলাদেশ ক্রিকেট কখনও আগাবে না। না আম্পায়ারিং আগাবে, না খেলোয়াড়, এটা নামে মাত্র খেলা হচ্ছে। জাতীয় লিগ হচ্ছে দায়সারা। যা ইচ্ছে তাই চলছে, বাংলাদেশের ক্রিকেট কি শুধু বিশ্বকাপে, আর কিছু নেই? অন্য ক্রিকেট টুর্নামেন্ট যা আছে সবই নিন্মমানের। ঢাকাকে জেতানোর জন্য অনেক কিছু হচ্ছে, সবকিছুতেই তারা সুযোগ পাচ্ছে।’
এদিকে জাতীয় দলের আরেক সাবেক পেসার সৈয়দ রাসেলও এ নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন। তিনি বর্তমানে প্রধান কোচের দায়িত্ব পালন করছেন খুলনার হয়ে। রাসেল গতকাল আম্পায়ারদের নিয়ে প্রথমে দুটি ভিডিও প্রকাশ করেন। সেখানেই জানান ক্ষোভের কথা। এরপর ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও তার কণ্ঠে ক্ষোভের আগুন, ‘আমার দলের বিপক্ষে নয়, সব দলের বিপক্ষেই সিদ্ধান্ত গেছে। আমরা তাদের কাছ থেকে পক্ষ-বিপক্ষ চাই না, চাই সঠিক আম্পায়ারিং। এই তর্ক-বিতর্ক একদিনে শেষ হবে না, তারাও মানুষ। এর জন্য প্রযুক্তি দরকার, ম্যাচ ব্রডকাস্টিংয়ের আওতায় আনতে হবে। যখন ব্রডকাস্ট থাকবে, তখন ডিসিশনগুলো সবাই মানতে বাধ্য হবে। আসলে এটা সবসময় হয়, ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া কেবল ক্ষোভ থেকেই।’
রাসেলের দাবি— পরিচর্যা আগায় নয়, গোড়ায় করতে হবে। ঘরোয়া ক্রিকেটের উন্নতি আগের জায়গাতেই আটকে আছে বলে মত সাবেক এই পেসারের, ‘অনেক সময় এরকম ঘটনা ইচ্ছাকৃত কেউ করে না। তবে যারা ভুক্তভোগী তাদের এমন কিছুই মনে হবে। এরপর কিছু বলা বা প্রতিক্রিয়া দেখানো হলে ম্যাচ শেষে ফাইন করা হয় এবং পয়েন্ট কাটে। এর একটা সমাধান হওয়া উচিৎ। আমরা আগের জায়গাতে পড়ে আছি। উন্নতি করতে চাই, তবে সেই উন্নতি করতে গাছের গোড়ায় পানি দিতে হয়, আগায় না। আমরা আগেও ৮ উইকেটে হারতাম, এখনো সেভাবেই হারি।’
আরও পড়ুন
কোচদের এমন হতাশার বক্তব্যের পর বিসিবির আম্পায়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান ইফতেখার আহমেদ মিঠুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। জবাবে তিনি ভিডিও ফুটেজ দেখে বিসিবি অনুসন্ধান করবে বলে জানান। ঢাকা পোস্টকে মিঠু বলেন, ‘আম্পায়ারদের যে ভুল হচ্ছে সেটা নিয়ে তারা মতামত দিতেই পারে। ভুল তো হতেই পারে, এখন কথা হচ্ছে এটা প্রতিনিয়ত হচ্ছে কি না। এখনকার চেয়ে ৩-৪ বছর আগে আরও খারাপ অবস্থা ছিল, কনফিডেন্স লেভেলও ভালো ছিল না আম্পায়ারদের। এখন প্রথম কথা হচ্ছে যদি এমন কিছু পাই তাহলে এনামুল হক মনি বা সেলিম সাহেদদের দিয়ে অনুসন্ধান করাবো।’
সৈয়দ রাসেলের পোস্ট করা সেই ফুটেজ দেখেছেন মিঠু, ‘এখন আমি দেখেছি ওই ভিডিও। আমার দায়িত্ব— ভিডিও ফুটেজ দেখে যে কমিটি আছে তাদের দিয়ে মতামত নেওয়া। এখন রাসেলের ভিডিও দেখে বলেছি আমি অনুসন্ধান করতে। আম্পায়ারদের যদি দরকার হয়, আবারও ট্রেনিং করানো হবে। এখন আমার পক্ষে বলা কঠিন তারা ঠিক করেছে, কি ভুল করেছে। আমাদের ফাস্ট, সেকেন্ড বা থার্ড ডিভিশনে কিছু ক্যামেরা রয়েছে, যা দ্বারা আমি দেখতে পারি। আমার কাছে তো ডিআরএস নাই। তারপরও আমি অনুসন্ধান করতে বলেছি। এটা না করলে কার ভুল সেটা তো বের হবে না।’
রাজিনের অভিযোগ- বিশেষ দলকে সুযোগ দিতে এমন করছেন আম্পায়াররা, ‘এত নিন্মমানের ম্যাচ পরিচালনা হলে বাংলাদেশ ক্রিকেট কখনও আগাবে না। না আম্পায়ারিং আগাবে, না খেলোয়াড়, এটা নামে মাত্র খেলা হচ্ছে। জাতীয় লিগ হচ্ছে দায়সারা। যা ইচ্ছে তাই চলছে, বাংলাদেশের ক্রিকেট কি শুধু বিশ্বকাপে, আর কিছু নেই? অন্য ক্রিকেট টুর্নামেন্ট যা আছে সবই নিন্মমানের। ঢাকাকে জেতানোর জন্য অনেক কিছু হচ্ছে, সবকিছুতেই তারা সুযোগ পাচ্ছে।’
জাতীয় লিগে কখনও ডিআরএস দেখা যাবে কি না এমন প্রশ্নে মিঠু বলেন, ‘আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। যদি প্রযুক্তি থাকত তাহলে এখনই ভুল বা সঠিক কি না বলে দিতে পারতাম।’ ডিআরএস এবং ব্রডকাস্ট নিয়ে কোচ ও ক্রিকেটারদের অনেকদিনের দাবি। এ বিষয়ে মিঠু বললেন, ‘এটা তো আমার ওপর না, আমার কাছে তারা আবদার করতে পারে। এরপর আমি বিসিবিকে বলতে পারব আমার জায়গা থেকে।’
এর আগে ২০২১ সালে মোহামেডানের জার্সিতে স্টাম্পে লাথি মেরে এবং স্টাম্প উপড়ে ফেলে ঘরোয়া ক্রিকেটের আম্পায়ারিংয়ের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন দেশের ক্রিকেটের বড় তারকা সাকিব আল হাসান। সে সময় তাকে বড় অঙ্কের টাকা জরিমানাও করা হয়েছিল। সেবার বেশ বড় রকমের ঝড় সইতে হয়েছিল দেশের আম্পায়ারদের। যদিও তাতে সামগ্রিক কোনো পরিবর্তন আসেনি। যার রেশ চলছে এখনও!
এসএইচ/এএইচএস