এশিয়ান গেমস: স্বর্ণজয়ী টেনিস খেলোয়াড়ের কারিগর বাংলাদেশি
এশিয়ান গেমসের স্বর্ণজয়ী ক্রীড়াবিদের ‘গুরু’ বাংলাদেশি কোচ। ভুল পড়েননি, সঠিকই পড়েছেন। হাংজু এশিয়ান গেমসে নারী টেনিস এককের চ্যাম্পিয়ন জাং ছিং ওয়েনের বাল্যগুরু বাংলাদেশি টেনিস কোচ আক্তার হোসেন। বেইজিংয়ে আক্তারের কাছে ২০১৩-১৮ সাল পর্যন্ত টেনিস দীক্ষা নিয়েছিলেন জাং। বেইজিংয়ে টেনিসের বেসিক শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি জাং ছিংয়ের চীনের বাইরেও অনেক টুর্নামেন্টের কোচ ছিলেন আক্তার।
টেনিস বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা হলেও বাংলাদেশে তেমন প্রচার-প্রসার নেই। বাংলাদেশে প্রচার-প্রসার না থাকলেও বাংলাদেশি কোচরা চীনে দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন। জাং ছিং ওয়েনের মতো বৈশ্বিক তারকা তৈরি করছেন। নিজের শিষ্য এখন এশিয়ার সেরা নারী টেনিস খেলোয়াড় এতে বেশ তৃপ্ত বাংলাদেশি কোচ আক্তার, ‘আমার এক সময়ের শিষ্য এশিয়ান গেমসে স্বর্ণ জিতেছে। এর চেয়ে খুশি বা প্রাপ্তি বাংলাদেশের একজন কোচের আর কি হতে পারে।’
জাং ছিং ওয়েন এশিয়ান গেমসের নারী এককের সেরা হওয়ার আগে উইমল্বডনেও সেমিফাইনাল খেলেছিলেন। বিশ্ব টেনিসের শীর্ষ বিশ নারীদের মধ্যে আক্তারের শিষ্য একজন। এমন একজন টেনিস তারকা বাংলাদেশি কোচের দীক্ষা নিলেন কিভাবে সেটা জানালেন আক্তার, ‘বেইজিংয়ে আমি একটা ক্লাবে কোচিং করাতাম সেখানে জাং ছিং টেনিস শিখেছে। তার সাড়ে ১১ বছর বয়স থেকে ১৬ পর্যন্ত আমার তত্ত্বাবধানে ছিল।’
এরপর জাং বেশ কয়েকজন কোচের অধীনে অনুশীলন করলেও প্রাথমিক ভিত্তি বাংলাদেশি কোচের অধীনেই। এশিয়ান গেমসে স্বর্ণ জিতে জাং তাঁর ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে গুরু আক্তারকে এই প্রতিবেদকের কাছে স্মরণ করলেন এভাবে, 'আমার টেনিসের ভিত আক্তার স্যারের হাতে। পেশাদার বড় খেলোয়াড় হওয়ার পথও তার হাত ধরে। আমার আজকের অবস্থান ও অর্জনে তাঁরদ অবদান অনেক। '
চীনের বেইজিংয়ে আক্তার যে ক্লাবে কাজ করতেন সেখানে ছিলেন জাস্টিন হেনিনের কোচ কার্লোস রদ্রিগেজ। উপদেষ্টা/প্রধান কোচরা একাডেমি/কোচিংয়ে খেলোয়াড়দের অন্য কোচদের মধ্যে ভাগ করে দেন। কার্লোস রদ্রিগেজ জাং-কে আক্তারের অধীনে দিয়েছিলেন। আমেরিকার জুনিয়র দু’টি টুর্নামেন্ট বিশ্বের মধ্যে নামকরা। ওই টুর্নামেন্টের শীর্ষ স্থানধারীরা পরিবর্তে বিশ্ব টেনিসে প্রতিষ্ঠিত নাম হয়। সেই টুর্নামেন্টে আক্তার একাধিকবার জাং ছীংয়ের কোচ হয়ে গিয়েছিলেন।
টেনিসে জুনিয়র পর্যায়ের এই টুর্নামেন্টগুলো খেলোয়াড়দের নিজেদেরই বহন করতে হয়। জাংয়ের অভিভাবক মেয়ের সঙ্গে কোচ হিসেবে আক্তারকেই প্রেরণ করেছেন। জাংয়ের টেনিসে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে আক্তারের অবদানের কথা বিভিন্ন সময় স্বীকার করেছে তার পরিবার। এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটিই ব্যক্তিগত পদক। ১৯৮৬ সালে সিউল এশিয়াডে বক্সার মোশাররফ জিতেছিলেন ব্রোঞ্জ। সেই দেশের একজন কোচ অন্য দেশের স্বর্ণজয়ী ক্রীড়াবিদের কারিগর। এটা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য বিশেষ এক গর্ব ও বড় ঘটনা।
চীনে গুয়াংজু, সাংহাই, বেইজিংসহ আরো কয়েকটি প্রদেশ মিলিয়ে ৩০ জনের কাছাকাছি বাংলাদেশি টেনিস কোচ রয়েছেন। এই কোচদের মধ্যে বিকেএসপির সাবেক শিক্ষার্থী আক্তার নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়েছেন। চীনের অনেক প্রদেশে বাংলাদেশের ক্রীড়া সংক্রান্ত আলোচনায় আগেভাগেই আসে আক্তারের নাম।
চীনে যত সংখ্যক ভালো মানের বাংলাদেশি কোচ রয়েছেন বাংলাদেশেও এত নেই। এর কারণ সম্পর্কে আক্তার বলেন, ‘চীনে আমরা সম্মানী যেমন পাই, সম্মানও যথেষ্ট। বাংলাদেশে অনেক কোচকে মার্কারী হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। এখানে আমাদের মেধার যেমন কদর তেমনি পরিশ্রমেরও দাম যথেষ্ট।’
বাংলাদেশের অনেক খেলায় নারী কোচ সংকট। দেশেই যখন অনেক নারী কোচ কাজের সুযোগ পান না। সেখানে চীনে বাংলাদেশি নারী কোচ রয়েছেন কয়েকজন। বিকেএসপির প্রথম নারী ব্যাচের শিক্ষার্থী রুমা কয়েকবার বাংলাদেশের জাতীয় টেনিস চ্যাম্পিয়ন। তিনি এখন চীনের সাংহাইয়ে বেশ সুনামের সঙ্গেই কোচিং করাচ্ছেন, ‘এখানে বাচ্চাদের টেনিস শেখানোর জন্য অভিভাবক ও কোচিং একাডেমিগুলো নারীদের একটু প্রাধান্য দেয় কারণ নারীরা একটু বেশি ধৈয্য নিয়ে বাচ্চাদের শেখাতে পারে’-বলেন রুমা।
২০০৫ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থী মুরাদ, আক্তার ও মিজান চীনে কোচিং করাতে আসেন। এরপর ধীরে ধীরে আরো অনেকে এসেছেন। চীনে আগমন ও থিতু হওয়া সম্পর্কে মিজান বলেন,‘আমরা একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে চীনে আসি। ২০০৫ সালে তিন মাসের একটি প্রজেক্টে আসি। সেই প্রজেক্টে ট্রেনিংয়ের পর আমরা ধীরে ধীরে নিজেকে চীনে প্রতিষ্ঠিত করি।’
আগে বাংলাদেশি টেনিস কোচরা অন্য দেশের টেনিস একাডেমিতে কাজ করতেন। এখন বাংলাদেশিরাই টেনিস কোচিং একাডেমি দিয়েছেন। সেখানে দেশি-বিদেশি অনেকেই কাজ করে। গুয়াংজুতে রিজভী ও সাংহাইয়ে শাহনেওয়াজের একাডেমি এখন বেশ প্রতিষ্ঠিত।
মিজান-আক্তাররা চীনে রয়েছেন প্রায় দেড় যুগ। চীনের টেনিসে কাজের সুবাদে বিশ্বের অনেক দেশেই গিয়েছেন। টেনিসে আরো উন্নত দেশগুলোতে স্থানান্তরিত না হওয়ার কারণ সম্পর্কে মিজান বলেন,‘ এখানে আমরা সেটেল। অনেকে পরিবারও এনেছে। নতুন জায়গায় গেলে নতুন করে নিজেকে চেনানো, ভাষা সংস্কৃতিরও ব্যাপার রয়েছে। তাই এখানেই ভালো লাগছে।’
চীনের টেনিসে যারা কাজ করছেন তারা বেশ উন্নত মানের কোচ। এখানে বেশ ভালো থাকলেও বাংলাদেশ নিয়ে ঠিকই আফসোস রয়েছে,‘টেনিসের কাজে যখন অন্য দেশে যাই তখনই মনে বাজে ইশ বাংলাদেশ যদি খেলত বা বাংলাদেশের কেউ যদি এখানে আসত। বাংলাদেশের ফেডারেশন, সরকারসহ সব পক্ষের সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন’-বলেন আক্তার। ২০১৭ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আইটিএফ কাপে চীনের খেলোয়াড় নিয়ে চ্যাম্পিয়ন করে আনার কৃতিত্বও রয়েছে আক্তারের।
এজেড/এফআই