তামিমে লাভ, তামিমেই ক্ষতি!
'আমায় ডেকো না ফেরানো যাবে না' লাকি আখন্দের জনপ্রিয় এই গানের সাথে কি কোনো কিছুর মিল পাচ্ছেন? ভেবে দেখুন তো বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটার তামিম ইকবালের সঙ্গে কি কোনো মিল এই লাইনটার। অবশ্য নাও মিল পেতে পারেন তবে আসন্ন বিশ্বকাপের দল ঘোষণা কিন্তু শেষ। ঘোষিত দলে সুযোগ পাননি খান সাহেব।
এখন কোনো কিছুর মাধ্যমে দর্শকরা হাজার ডাকলেও আর তামিমকে ফেরানো যাবে না। বুধবার ভারতে যাওয়ার বিমানে বিকেল ৪টায় দেশ ছাড়বে টাইগাররা। সেই বিমানে তো যাওয়ার কথা ছিল দেশসেরা ওপেনারেরও। তবে কি থেকে কি হয়ে গেল যে বিশ্বকাপ থেকেই বাদ গেলেন তামিম। অবশ্য তামিমের দলে না থাকায় সাধারণ দর্শকরা ভিলেনের কাতারে ফেলছেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান এবং কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে।
তামিমের লাভ-ক্ষতির খতিয়ান
তামিম খেললে লাভের দিকও রয়েছে আবার ক্ষতির দিকও রয়েছে। এই ওপেনার নিজের মুখেই জানিয়েছেন তিনি ফিট নন, রয়েছে পিঠে অস্বস্তি। যে কারণে বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে বড় কিছু হলে দলের ভারসম্যতে বাঁধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে! এদিকে যদি তামিম খেলতেন তাহলে দলের ওপেনিং অভিজ্ঞতায় টইটম্বুর থাকতো। তবে সেটা অবশ্য হয়নি।
তামিমের দলে থাকায় সবচেয়ে লাভ ওপেনিং জুটিতে স্থিরতা। জাতীয় দলে তামিমের বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা তানজিদ তামিম নিতান্তই তরুণ। ৪ ম্যাচের অভিজ্ঞতা নিয়েই যাচ্ছেন বিশ্বকাপের বড় মঞ্চে। অপর ওপেনার লিটন দাস আছেন রানখরায়। কিউইদের বিপক্ষে সিরিজের ২য় ওয়ানডে ম্যাচে রান না পেয়ে মানসিক বিষণ্ণতায় ভুগেছেন তিনি। সিরিজের শেষ ম্যাচে ছিলেন বিশ্রামেও।
তবে তামিম থাকলে একটা ঝুঁকি থেকেই যেতো। তামিম হঠাৎ ছিটকে গেলে দলের ভারসাম্য কিছুটা হলেও নষ্ট হতো। ব্যাকাপ ওপেনার রাখতে গিয়ে দলের পেস বোলিং ইউনিটেও হারাতে হতো শক্তি। সেই দিক বিবেচনা করেও হয়ত টিম ম্যানেজমেন্ট অর্ধ-ফিট তামিমকে দলে রাখতে চায়নি।
কোথায় শুরু ঘটনাপ্রবাহ
এবার তাহলে ফ্লাশ ব্যাকে চলতি বছরের জুলাই মাসে (৬ তারিখ) ফিরে যাওয়া যাক একটু। আগেরদিন (৫ জুলাই) আফগানিস্তানের কাছে বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচ হেরে ওয়ানডে সিরিজ শুরু করেছিল বাংলাদেশ। এর পরদিন (৬ জুলাই) বেলা গড়াতেই ক্রীড়াঙ্গনে হৈ-চৈ ফেলে দেয় তামিম ইকবালের সংবাদ সম্মেলনের খবর। ফলে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের দিকেই পুরো ক্রিকেট মহলের মনোযোগ চলে যায়। তাদেরই ঘরের সন্তান তামিম গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘোষণা নিয়েই হাজির হবেন, সেটি বাতাসের বেগে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তিনি যে ঘোষণা দিয়েছেন তাতে হতবাক পুরো জাতি।
তবে সেই অবসর কাণ্ড থেকে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে ২৮ ঘন্টা পর আবারো ক্রিকেট ফেরার খবর জানান তামিম। সে সময় বড় ভূমিকা ছিল মাশরাফি বিন মুর্তজার। পরবর্তীতে কিছুদিন বিশ্রাম, এরপর লন্ডন থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরেন তামিম। দিন কয়েক পর আগস্টের ৩ তারিখ সরে দাঁড়ান ওয়ানডে অধিনায়কের দায়িত্ব থেকেও। এর ৮ দিন পর নতুন করে দলের দায়িত্ব নেন সাকিব আল হাসান। পরে গণমাধ্যমে খবর এসেছে দীর্ঘ এই সময়ে অধিনায়ক সাকিব বা প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের সাথে কোনো কথাই হয়নি তামিমের।
তামিমের প্রত্যাবর্তন
তামিমের খেলার খবরে ফেরা যাক এখন। তামিমের ফিটনেস ফিরে আসায় সদ্য শেষ হওয়া নিউজিল্যান্ড সিরিজ দিয়ে আবারো দলে ফেরেন এই ওপেনার। তবে প্রথম ম্যাচে ব্যাট করার সুযোগ হারান বৃষ্টিতে। এরপরের ম্যাচে করেন ৪৪ রান।
আর শেষ ম্যাচে খেলেননি হালকা চোট থাকায়। কেননা পিঠের সেই চোট আবারো ভর করেছে তামিমের। মূলত এই চোটের কথা জানানোর পর থেকেই আবারো গুঞ্জন শুরু হয় চারদিকে। সোমবার রাতে এমন কথাও জানা গিয়েছে যে বিশ্বকাপে ৫ ম্যাচ খেলার জন্য শর্ত দিয়েছেন তামিম। তবে দল ঘোষণার পর প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু বলেছেন এসব কথা ভিত্তিহীন। কোনো শর্তই দেননি এই ওপেনার।
আরও পড়ুন>> তামিমের ‘৫’ ম্যাচ খেলার শর্ত ভিত্তিহীন বলছেন নান্নু
গতকাল জানা গিয়েছিল সাকিবের বিশ্বকাপ দলে কোনো হাফ ফিট খেলোয়াড়ের জায়গা হবে না। এমনকি জানা গিয়েছে হাফ ফিট খেলোয়াড় থাকলে অধিনায়কত্বই করবেন না সাকিব! তবে শেষ পর্যন্ত ফুল ফিট খেলোয়াড় নিয়েই দল ঘোষণা করেছে বিসিবি। এর আগে দুপুরে বিসিবিতে আসেন মাশরাফি, পাপনের ডাকে সাড়া দিয়ে। সেখানে কি কথা হয়েছে সেটাও অজানা।
কে কী বলছেন?
দল ঘোষণার পর অবশ্য তামিমের না থাকা নিয়ে ব্যাখা দিয়েছেন প্রধান নির্বাচক নান্নু, 'আপনারা তো বিশ্বকাপের স্কোয়াড পেয়েছেন। তামিমের অনেকদিন ধরে ইনজুরি কনসার্ন। এটা নিয়ে লড়াই করছিল। প্রথম ম্যাচ খেলার পর অভিযোগ এসেছে চোট নিয়ে। ইনজুরি চিন্তা করে তামিমকে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে রাখা হয়নি। টিম ম্যানেজম্যান্টের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। আলোচনা করে ঝুঁকি নেই। বিশ্বকাপ লম্বা টুর্নামেন্ট, এটা বিবেচনায় রাখা হয়েছে। ’
এই সিদ্ধান্ত সবার সঙ্গে আলোচনা করেই নেওয়া হয়েছে জানিয়ে নান্নু বলেন, ‘ম্যানেজম্যান্টের সঙ্গে আলোচনা করেই স্কোয়াড তৈরি করা হয়েছে। তামিমের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছে। সার্বিকভাবে সবার সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয়েছে। সবাই মিলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মেডিকেল থেকে না জেনে সিদ্ধান্ত নেইনি। ’
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে হারের পর অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়া নাজমুল হোসেন শান্ত তামিমের বিশ্বকাপ দলে না থাকা নিয়ে বলছিলেন, ‘দল ভালো হয়েছে। তামিম ভাইয়ের সঙ্গে খেলেছি। অনেক কিছু শিখেছি। বাংলাদেশ দলকে অনেক কিছু দিয়েছেন। অবশ্যই অনেক মিস করব।’
প্রধান নির্বাচকের সঙ্গে এসেছিলেন দায়িত্বে থাকা আরো দুই নির্বাচক আব্দুর রাজ্জাক ও হাবিবুল বাশার সুমন। তারা সবাই-ই তাদের সময়ে দল নির্বাচনে নিজেদের বাদ পড়ার পর ‘অবিচারের’ অভিযোগ তুলেছিলেন। তামিমের বেলায়ও কি ‘অবিচার’ হয়েছে?
এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাচক হাবিবুল বাশার সুমন বলেন, ‘দল নির্বাচনে যখন বসি। দায়িত্ব থাকে সেরা দল বের করার। আমাদের মনে তামিমকে নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে অবিচারের ব্যাপারটা মাথায় আসেনি। ওর ক্ষমতা নিয়ে আমাদের কোনো সংশয় নেই, আমরা চেয়েছি সুস্থ-সবল তামিমকে পেতে। আমাদের শেষ মুহূর্ত অবধি ভাবতে হয়েছে তাকে নিয়ে।’
তামিমের শেষ নাকি শেষের শুরু?
তবে কি শেষ হয়ে গেল বাংলাদেশ ক্রিকেট থেকে তামিম অধ্যায়! অবশ্য গোল বলের ক্রিকেটে তো এটা বলা মুশকিল। তামিমের ক্ষেত্রেও তাই, আবারো হয়তো ফিরবেন নয়তো না। লেখার প্রথমে শুরু করা একটা গানের মতো শেষটাও করছি সেই গান দিয়েই। অঞ্জন দত্তের গাওয়া গানের লাইনের মতো 'ফিরে আসব আমি তোমার পাড়ার, তুমি থেকো দাঁড়িয়ে তোমার বারান্দায়।' মিরপুর কিংবা চট্টগ্রামের সবুজ গালিচা নিশ্চয় সেই গানের লাইনের মতো অপেক্ষায় থাকবেন তামিমের!
দেশের ক্রিকেটের সর্বাধিক রানের মালিকের এমন পরিণতি অবশ্য মানতেই পারছেন না অনেকে। যে কারণে মিরপুর মাঠেও মঙ্গলবার স্লোগানে স্লোগানে ছিলেন তামিম। ভক্তদের চাওয়া ফিরবেন তামিম, তবে কিভাবে ফিরবেন রাস্তা তো কঠিন! সেই উত্তর না হয় সময়ের কাছেই তোলা থাক।
এসএইচ/জেএ