রেফারিদের বকেয়া কোটি, বিশেষজ্ঞের পেছনেই ব্যয় অর্ধ কোটি!
রেফারিদের বকেয়া বাংলাদেশের ফুটবলে চিরাচরিত বিষয়। এক মৌসুম পেরিয়ে আরেক মৌসুমের মাঝপথে রেফারিদের সম্মানী প্রদান করা ঘরোয়া ফুটবলে অলিখিত রীতি। বাফুফের কাছে রেফারিদের পাওনা কোটি টাকা। রেফারিদের কাছে ফেডারেশনের বড় অঙ্কের দেনা থাকলেও বিদেশি রেফারি বিশেষজ্ঞের পেছনে গত আট মাসে প্রায় অর্ধ কোটি ব্যয় করেছে ঠিকই।
নিজ দেশের রেফারিদের বকেয়া অন্যদিকে বিদেশি বিশেষজ্ঞকে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা বেতন দিচ্ছে ফেডারেশন। বিষয়টি রেফারিদের মধ্যে অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। সাবেক ফিফা রেফারি মনসুর আজাদ এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘ফিফার গাইডলাইনে হয়তো ফেডারেশন বিদেশি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়েছে। তার জন্য বিশেষ বরাদ্দও থাকতে পারে কিন্তু যারা লিগে বাঁশি বাজান তাদের সম্মানীর বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন সর্বাগ্রে। রেফারিদের বকেয়া রেখে রেফারিং উন্নয়ন সম্ভব নয়।’
এই বছরের ১২ জানুয়ারি ভারতের সাবেক ফিফা রেফারি গৌতম করকে দুই বছরের জন্য বাংলাদেশের রেফারি বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে ফেডারেশন। ইতোমধ্যে আট মাস অতিবাহিত হয়েছে। রেফারিদের বকেয়ার বিষয়টি তিনিও অবহিত। রেফারিং উন্নয়নে এটিও একটি বাধা হিসেবে মনে করে বলেন,‘অবশ্যই পেমেন্ট একটি ফ্যাক্টর। এটি প্রশাসনিক বিষয়। ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি তারা এর সঠিক ও প্রকৃত উত্তর দিতে পারবেন।’
তিনি গত কয়েক মাস নিয়মিত সম্মানী পেয়েছেন কিন্তু যারা মাঠে বাঁশি বাজিয়েছেন তারা পাননি। এই বিষয় নিয়ে তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি এর কারণ সম্পর্কে বলেন, ‘আসলে এটি আমার আওতার মধ্যে পড়ে না। আমি রেফারিং উন্নয়নে বিভিন্ন প্রোগ্রাম দিচ্ছি, কাজ করছি। আগামীকাল থেকে শুরু হচ্ছে রেফারি এসোসর কোর্স। কাজ নিয়েই আমি ব্যস্ত।’
গত আট মাসে ভারতীয় এই রেফারি বিশেষজ্ঞের কর্মকান্ড নিয়েও প্রশ্ন উঠছে ফুটবলাঙ্গনে। তিনি আসার পর বিভিন্ন পর্যায়ে কয়েকটি কোর্স করিয়েছেন। সেই কোর্সের জন্য বিদেশি ইন্সট্রাকটর নিয়ে আসেন। সেই ইন্সট্রাকটর কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের চেয়ে নিম্নমানের। রেফারি বিশেষজ্ঞ থাকা সত্ত্বেও আবার বিদেশি নিম্নমানের ইন্সট্রাকটর এনে ফেডারেশনের বাড়তি খরচ করানোয় তার কর্মকান্ড প্রশ্নের মুখে পড়েছে। সদ্য বিদায়ী ট্যাকনিক্যাল ডাইরেক্টর পল স্মলির সমালোচনা থাকলেও তিনি নিজেই কোচিং কোর্স পরিচালনা করতে পারতেন। যার ফলে বাফুফের বিদেশি ইন্সট্রাকটর ব্যয় লাগতো না।
অনেক রেফারির মতে, সারা বিশ্বে ফেডারেশনগুলোতে রেফারি বিশেষজ্ঞ নিয়োগে প্রাধান্য দেওয়া হয় ফিফা-এএফসির ইন্সট্রাকটর। এদের মাধ্যমে রেফারিরা ট্যাকনিক্যালি উন্নত হয়। গৌতম ফিফা-এএফসির ম্যাচ কমিশনার। তার প্রশাসনিক দক্ষতা বেশি ট্যাকনিক্যালের তুলনায়। তবে এই মতের সঙ্গে দ্বিমত গৌতমের, ‘১৯৮২ সাল থেকে আমি রেফারিংয়ে সঙ্গে জড়িত। আমার সর্বশেষ পরিচিতি ম্যাচ কমিশনার হলেও রেফারিজ ইন্সট্রাকটর হিসেবে কাজ করারও অভিজ্ঞতা রয়েছে। সর্বভারতীয় ফেডারেশনের অতিরিক্ত সম্পাদকও ছিলাম।’
আট মাস যাবত তিনি বাংলাদেশে কর্মরত কিন্তু দেশের শীর্ষ রেফারিদের নিয়ে এখনো বসেননি। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম সংস্কার চলায় প্রিমিয়ার লিগের অধিকাংশ ম্যাচ ঢাকার বাইরেই অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার বাইরেও তিনি তেমন উপস্থিত থাকেন না। বর্তমান-সাবেক ফিফা রেফারি অনেকের সঙ্গেই নানা বিষয়ে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে গৌতমের। তবে তার বক্তব্য ও পর্যবেক্ষণ ,‘আমার সঙ্গে বাংলাদেশের সব রেফারিরই যোগাযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে রেফারির রোল মডেল নেই। যাকে দেখে অন্যরা অনুপ্রাণিত হবে। ’
তৈয়ব হাসান বাবু বাংলাদেশের রেফারিং জগতের কিংবদন্তি। তিনি এশিয়ার শীর্ষ পর্যায়ে রেফারিং করেছেন। তবে তাকে রোল মডেল হিসেবে মানতে নারাজ গৌতম,‘তিনি অবশ্যই ভালো তবে সেটা অতীত। বর্তমানে সব সময় দুই-একজন থাকতে হয়। রেফারিংয়ে দশ বছরকে এক প্রজন্ম ধরা হয়। জয়া চাকমা ও সালমা নারীদের জন্য আইকন। তবে জয়া এলিটে না থাকায় সালমার ম্যাচ সংখ্যাও কম।’
গত আট মাসে রেফারি বিশেষজ্ঞের পেছনে সব মিলিয়ে প্রায় অর্ধ কোটি ব্যয় হয়েছে। এত অর্থ ব্যয় করে বাংলাদেশের ফুটবলের প্রাপ্তি তেমন কিছু দেখছেন না অনেকেই। বাফুফের রেফারিজ কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম মুর্শেদী বিদেশি রেফারি বিশেষজ্ঞ প্রসঙ্গে বলেন,‘তিনি তার মতো কাজ করছেন। আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। তার কর্মকান্ড ও পারফরম্যান্স অবশ্যই পর্যালোচনা হবে। প্রয়োজনে নির্বাহী সভাতেও তাকে নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি।’
এজেড/এফআই