নিরবচ্ছিন্ন লিগে পুলিশের নীরব বিপ্লব

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার ফুটবল লিগে (বিপিএল) এবারের আসরটি ব্যতিক্রম। সূচি দিয়েও সেটি পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে, এরপর সেই ফিকশ্চার অনুসরণ হয়েছে প্রায় শতভাগই। শুক্র-শনিবার লিগের খেলা এবং টুর্নামেন্টের ম্যাচ মঙ্গলবার, এই ফরম্যাটে পুরো মৌসুমই ব্যাঘাতহীনভাবে শেষ হয়েছে।
এমন নিরবিচ্ছিন্ন লিগে বাংলাদেশ পুলিশ ফুটবল ক্লাব নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে। মোহামেডান, শেখ রাসেল, শেখ জামালের মতো দলগুলোকে পেছনে ফেলে লিগে তৃতীয় হয়েছে। যা এই ক্লাবটির ফুটবল ইতিহাসের সর্বোচ্চ অর্জন। ২০১৯-২০ মৌসুম থেকে পুলিশ পেশাদার লিগে খেলছে। সত্তর-আশির দশকে তারা প্রথম বিভাগ (তখনকার সর্বোচ্চ স্তর) ফুটবলে অংশ নিলেও শীর্ষ তিনে থাকার রেকর্ড সম্পর্কে জানা যায়নি।
জায়ান্ট কিলার’খ্যাত পুলিশ এখন জায়ান্ট হওয়ার পথে। এবারের লিগ চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংস একটি ম্যাচই হেরেছে, তাও সেটি পুলিশের বিপক্ষেই। দলটির বিপক্ষে হোঁচট খেয়েছে আবাহনী এবং শেখ জামালের মতো ক্লাবও। ২০ ম্যাচের মধ্যে পুলিশ ১০টি জিতেছে, সমান পাঁচটি করে ড্র এবং পরাজিত হয়েছে। মৌসুমজুড়েই ধারাবাহিক ফুটবল খেলেছে পুলিশ। এর ফলে লিগের অধিকাংশ সময় টেবিলের তৃতীয় স্থান ছিল তাদের দখলেই।
পুলিশের এই সাফল্যের কারণ সম্পর্কে দলের ম্যানেজার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু তাহের বলেন, ‘আমরা শৃঙ্খলা ও আন্তরিকতার সঙ্গে দল পরিচালনা করি, এজন্য আমাদের এই সাফল্য। ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে যারা রয়েছি সবাই পুলিশের কর্মকর্তা। অফিসের দায়িত্বের পাশাপাশি আমরা ক্লাবের কাজটিও আন্তরিকতা নিয়ে করি।’
খেলোয়াড়দের পারিবারিক বিষয়ে সাহায্যও পারফরম্যান্সে ভালো করার কারণ হিসেবে মনে করেন এই কর্মকর্তা, ‘অনেক খেলোয়াড়ের পরিবার, আত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধবদের নানা সমস্যা থাকে। আমরা দেশ ও জনগণের জন্য যেমন কাজ করি তেমনি আমাদের খেলোয়াড়দেরও এই সংক্রান্ত সেবা প্রদান করি। ফলে তারা মানসিকভাবে খেলায় পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারে।’
মানসিকভাবে চাঙা থাকার পাশাপাশি খেলোয়াড়দের জন্য বরাদ্দ হয় প্রণোদনাও, ‘আমরা পেশাদার ভাবেই ক্লাব পরিচালনা করার চেষ্টা করি। ভালো পারফরম্যান্স বা জয়লাভ করলে ইনসেন্টিভ দেওয়া হয়। আমাদের দল তৃতীয় হওয়ায় উর্ধ্বতন স্যাররা নিশ্চয়ই কোনো ঘোষণা দেবেন’, যোগ করেন দলটির ম্যানেজার।
বাংলাদেশের ফুটবলে বড় নিয়ামক বিদেশি ফুটবলার। ভেনেজুয়েলার ফুটবলার মরেলোর জোড়া গোলে কিংসকে হারিয়েছিল পুলিশ। প্রতিষ্ঠিত ক্লাবগুলো ভালো মানের বিদেশি আনতে অনেক সময় ব্যর্থ হয়। আবার অনেক দামে বিদেশি এনেও সফল হয় না। সেখানে পুলিশ স্বল্প বাজেটে দুর্দান্ত বিদেশি আনছে বলে মনে করেন ক্লাবটির সাধারণ সম্পাদক ডিআইজি রেজাউল কবির হায়দার, ‘বেশ কয়েকজন এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। সারা বছরই আমরা বিদেশিদের সন্ধানে থাকি। পারফরম্যান্স দেখে আমাদের বাজেট অনুযায়ী একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা করি। আমিই মূলত এটি দেখাশোনা করি, এরপর চুড়ান্ত করি কয়েকজন মিলে।’
শেখ রাসেল, শেখ জামালসহ আরও অনেক ক্লাব বড় বাজেটের দল গড়েও পুলিশের পেছনে অবস্থান করছে। নিজেদের সফলতা সম্পর্কে হায়দার বলেন, ‘আমাদের কোচিং স্টাফের কৃতিত্ব দিতেই হবে। তারা দুর্দান্ত কাজ করে সামনে থেকে, আমরা পেছন থেকে সাহায্য করি। খেলোয়াড়, কোচ ও কর্মকর্তা তিন সমন্বয়ে এই অবস্থান।’
সাফল্যের কারণ সম্পর্কে নিজেদের একটি সুবিধার কথাও বললেন তিনি, ‘আমাদের মাঠ ও ক্যাম্পের সুবিধা রয়েছে। পাশাপাশি আছে জিম ও সুইমিংপুল। এটা অনেক বড় সুবিধা আমাদের জন্য।’
অবকাঠামো সুবিধা থাকলেও আর্থিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে পুলিশ ফুটবল ক্লাবের। ক্লাবটির আর্থিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘আমাদের তেমন তারকা ফুটবলার নেই। সীমিত অর্থের জন্য উঠতি ও সম্ভাবনাময় খেলোয়াড় নেয়া হয়। পেশাদার লিগে খেলতে ব্যয় অনেক বেশি। আমাদের আইজিপি স্যার অত্যন্ত ক্রীড়াপ্রেমী। তিনি আমাদের সব সময় উৎসাহ ও সহযোগিতা করেন। ফুটবল ক্লাবের সভাপতি ডিজি র্যাব স্যার তিনিও সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। আমাদের সীমিত বাজেটের সর্বোচ্চ উপযোগিতা আদায়ের চেষ্টা করি। পাশাপাশি আমাদের অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী ফুটবলকে ভালোবেসে আমাদের দলকে সহায়তা করে থাকে। নিরপেক্ষ ফার্ম দ্বারা আমরা ক্লাবের আয়-ব্যয়ও অডিট করিয়ে থাকি।’
চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে বাংলাদেশ পুলিশ নিজেদের কর্মী দিয়েই দল গড়ত। প্রিমিয়ারে এসেও তাদের প্রায় পঞ্চাশ ভাগ খেলোয়াড় পুলিশ। অন্য সংস্থাগুলো চুক্তিভিক্তিক ও অন্য পদে খেলোয়াড়দের নিয়োগ দিতে পারে। সাধারণ সম্পাদকের মনে করেন পুলিশের এই ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আছে, ‘আমরা খেলোয়াড়দের চাকরিতে নিয়োগ দিতে পারলে অনেক কম ব্যয়ে দল গঠন সম্ভব হতো। আমাদের নিয়ম ও চাকরিবিধিতে খেলোয়াড়দের সরাসরি নিয়োগের নিয়ম নেই। আমাদের উর্ধ্বতন স্যাররা খেলার ব্যাপারে আন্তরিক, এই বিষয়টি বিবেচনা করছেন।’
পুলিশের বর্তমান দলে তিন ধরনের খেলোয়াড়। পুলিশ ফুটবলার, সিভিল খেলোয়াড় ও বিদেশি। তবে সকল খেলোয়াড়ই সমান সুবিধাপ্রাপ্ত, ‘আমাদের দলে তিন ধরনের খেলোয়াড় থাকলেও অনুশীলন, আবাসনসহ সকল বিষয় আমরা সমতা নিশ্চিত করি,’ যোগ করেন সাধারণ সম্পাদক।
প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তৃতীয় হয়েছে পুলিশ। এই অর্জন টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে হায়দার বলেন, ‘আমরা অবশ্যই আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব। খেলাধুলায় ফলাফল বা অবস্থানের জন্য প্রয়োজন ভাগ্যও। সেটা আমাদের সহায় হলে আগামী মৌসুমেও হয়তো সম্ভব হবে।’
পুলিশ ফুটবল দল দেশের সর্বোচ্চ স্তরে খেলবে এমন স্বপ্ন প্রথম দেখেছিলেন পুলিশের সাবেক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা শেখ মারুফ হাসান। তিনিই পুলিশ ফুটবল দলকে নতুন রূপে গড়ার দায়িত্ব নেন। দ্বিতীয় বিভাগ থেকে ধাপে ধাপে দলটিকে তিনি প্রিমিয়ারে এনেছেন। পুলিশ ফুটবল দলের এই অবস্থানে বেশ তৃপ্ত অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা ও ফুটবল সংগঠক, ‘পুলিশ ভালো ফুটবল খেলবে এবং পরবর্তীতে তারা জাতীয় দলে খেলতে পারবে এটাই আমার লক্ষ্য ছিল। সেটা অনেকটাই পূরণ হয়েছে। ফুটবলাঙ্গনে পুলিশ এখন একটি প্রতিষ্ঠিত নাম।’
পুলিশ ফুটবল ক্লাবের ঐতিহাসিক অবস্থানের পেছনে মারুফকে বিশেষ ধন্যবাদ বর্তমান জানিয়েছেন সাধারণ সম্পাদকের, ‘স্যারই ফুটবল নিয়ে বাস্তবিক অর্থে স্বপ্ন দেখেছিলেন। শুরুর দিকে তার চেষ্টার ফলই আমাদের আজকের অবস্থান।’
এজেড/এএইচএস