অবসাদে সাফজয়ী সাবিনারা, সংকটে নারী ফুটবল
নারী ফুটবলে যত সংকট
# এপ্রিল মাসের সম্মানী এখনো বকেয়া, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর প্রতিশ্রুতি দিলেও বাড়েনি সম্মানী
# আট মাসে একটি ম্যাচও খেলতে পারেনি মেয়েরা, দেশের বাইরের লিগে খেলার অনুমতি মেলেনি
# দেশি-বিদেশি কোচের সম্মানী ও কর্তৃত্বে বৈষম্য
হঠাৎ করে সব ওলট-পালট। সাজানো-গোছানো নারী ফুটবলে চরম অস্থিরতা। প্রধান কোচ ছোটনের পদত্যাগ ও দলের অন্যতম স্ট্রাইকার সিরাত জাহান স্বপ্নার আকস্মিক অবসর নাড়িয়ে দিয়েছে পুরো ক্রীড়াঙ্গনকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গতকাল (শনিবার) বিকেলে বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফদের নিয়ে বসেছিলেন।
সালাউদ্দিনের সঙ্গে বৈঠকে নানা সমস্যার কথা জানিয়েছেন ফুটবলাররা। সবকিছু শুনে সালাউদ্দিন আরও কিছুদিন ধৈর্য ধরতে বলেছেন। আগের সেই কথারই নাকি পুনরাবৃত্তি করেছেন বাফুফে সভাপতি- ‘একটি ফান্ডের জন্য চেষ্টা করছি, ফান্ড পেলে সব চাহিদা পূরণ করা হবে।’ সালাউদ্দিনের এমন আশ্বাস সাবিনারা গত আট মাসে কয়েকবারই শুনেছেন। এখন আর তারা সেই আশ্বাসে খুব বেশি ভরসা করতে পারছেন না।
মে মাস শেষ হতে চললেও এপ্রিলের বেতন এখনো পাননি ফুটবলাররা। চলতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার এপ্রিলের বেতন পাওয়ার কথা রয়েছে। নারী ফুটবলারদের বেতনও খুব অল্প অঙ্কের। অধিনায়ক সাবিনা সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা পান। বাকিদের অধিকাংশ ১০ হাজার করেই পাচ্ছেন আগের মতো। সাফ জয়ের পর এই সম্মানী বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবায়ন হয়নি এখনো।
নারী ফুটবলাররা আগে বেশ চনমনে অনুশীলন করতেন। বাফুফে ভবনে থাকত হাসির রোল। এখন সেখানে ভর করেছে নিস্তব্ধতা। ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেকে অনুশীলনে যাচ্ছেন। কেউ জানেন না কবে, কখন আবার ম্যাচ খেলতে পারবেন। দক্ষিণ এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন হয়েও আট মাস খেলার বাইরে তারা।
সানজিদা, কৃষ্ণা ও মারিয়াদের এই ফুটবল ফেডারেশনই গড়ে তুলেছে। ফুটবলের মাধ্যমে তারা সামাজিক পরিচিতি পেয়েছেন, পারিবারিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। তাদের জীবনের এই বাঁক বদলে ফুটবল ফেডারেশনের যেমন অবদান রয়েছে তেমনি ফুটবল ফেডারেশনকে সাফল্য দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন এই সানজিদারাই। সময়ের সঙ্গে তাদের চাহিদারও পরিবর্তন হয়েছে। এত সাফল্যের পর মাত্র ১০-১৫ হাজার টাকার সম্মানীতে তাদের কীভাবে চলে?
আরও পড়ুন: ‘দেশি কোচদের মূল্য নেই’
সম্মানীর স্বল্পতা এবং সেই সম্মানীও অনিয়মিত হওয়ায় ক্ষোভ তো রয়েছেই, এর চেয়েও বড় ক্ষোভ সাবিনাদের খেলতে না পারার। একাধিক ফুটবলার নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা খেলার জন্য অনেক দিন থেকে অধীর আগ্রহে বসে আছি। একবার ফ্রেন্ডলি ম্যাচ বাতিল হলো। পরে অলিম্পিক বাছাইয়ে পাঠানো হলো না। এরপর অনেকের দেশের বাইরে খেলার প্রস্তাব ছিল সেটাও যেতে দেওয়য় হয়নি দেশে ফ্রাঞ্চাইজি লিগ হবে বলে। সেটারও এখনো কোনো নিশ্চয়তা নেই।’
নারী ফুটবলাররা আগে বেশ চনমনে অনুশীলন করতেন। বাফুফে ভবনে থাকত হাসির রোল। এখন সেখানে ভর করেছে নিস্তব্ধতা। ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেকে অনুশীলনে যাচ্ছেন। কেউ জানেন না কবে, কখন আবার ম্যাচ খেলতে পারবেন। দক্ষিণ এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন হয়েও আট মাস খেলার বাইরে তারা। অন্যদিকে ভারত, পাকিস্তান, ভুটান, নেপাল একাধিক প্রীতি ম্যাচ খেলেছে এবং টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেছে।
সাবিনারা খেলতে না পেরে এবং আর্থিক বিষয়ে অবসাদে ভুগছেন আর কোচরা রয়েছেন ব্রিটিশ টেকনিক্যাল ডাইরেক্টর পল স্মলিকে নিয়ে অস্বস্তিতে। নারী ফুটবলের জন্য নিবেদিত প্রাণ গোলাম রব্বানী ছোটন ও মাহবুবুর রহমান লিটুর চেয়ে টেকনিক্যাল ডাইরেক্টর পল স্মলির প্রতি বেশি আস্থা বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের।
নারী ফুটবল দক্ষিণ এশিয়ার সেরা হওয়ার পেছনে বাফুফের পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের পর এই স্থবিরতার জন্য এখন বাফুফে প্রশ্নবিদ্ধ। এই বিষয়ে নারী ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ বলেন, ‘অন্তত দুটি প্রীতি ম্যাচ খেলার জন্য সব প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। আকস্মিক কারণে প্রতিপক্ষ অপারগতা প্রকাশ করে। প্রতিপক্ষের শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্তের কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। জুলাইয়ের উইন্ডোতে দুটি ম্যাচ খেলা হবে মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে।’
আরও পড়ুন: অসন্তোষ নিয়ে কোচের দায়িত্ব ছাড়ছেন ছোটন
সাবিনারা খেলতে না পেরে এবং আর্থিক বিষয়ে অবসাদে ভুগছেন আর কোচরা রয়েছেন ব্রিটিশ টেকনিক্যাল ডাইরেক্টর পল স্মলিকে নিয়ে অস্বস্তিতে। নারী ফুটবলের জন্য নিবেদিত প্রাণ গোলাম রব্বানী ছোটন ও মাহবুবুর রহমান লিটুর চেয়ে টেকনিক্যাল ডাইরেক্টর পল স্মলির প্রতি বেশি আস্থা বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের। কিছুদিন আগে পল বাফুফে ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন কাজের পরিবেশ নেই বলে। সভাপতি তাকে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। বাফুফের নীতি নির্ধারকদের পলের প্রতি অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতায় অনেকে মনঃক্ষুন্ন।
টেকনিক্যাল ডাইরেক্টর পল স্মলি সাম্প্রতিক সময়ে ছোটন-লিটুদের অনেক ভুল ধরছেন বলে শোনা যায়। বিশেষ করে মেয়েদের সামনেই নাকি অনেক সময় পল কোচদের সমালোচনা করেন। যা তাদের আত্নসম্মানে বাঁধছে। পল ছুটি কাটিয়ে ১৪ মে’র পর দেশে আসলেও অনুশীলন করাচ্ছেন না। পল অনুশীলন না করালেও তার অনুগত ট্রেইনার ইভান রাজলভ তার হয়ে নজরদারি করছেন বলে জানা যায়। ইভানের আচার-আচরণে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে দেশি কোচিং স্টাফে। পল শুধু কোচিং বিষয়ে নজরদারি করেন না। ভবনে থাকা কোচিং স্টাফদের রুমের জিনিসপত্র নিয়েও মন্তব্য করেন। এসব বিষয়ে বাফুফের নারী উইংয়ের চেয়ারম্যানও অবহিত। পল বাফুফে সভাপতির বিশেষ আস্থাভাজন। সভাপতির মতের বাইরে সাধারণত যেতে পারেন না মহিলা উইংয়ের চেয়ারম্যান।
আচার-আচরণ, কর্তৃত্ব ছাড়াও সম্মানীতেও ব্যাপক ব্যবধান পল ও দেশি কোচিং স্টাফদের মধ্যে। সাফ জয়ের আগে ছোটন ও লিটুর বেতন ছিল যথাক্রমে ৮০ ও ৫০ হাজার। যদিও সেটি এখন বেড়ে ছোটনের ১৫০০ ডলার (দেড় লাখের বেশি) আর লিটুর লাখের কাছাকাছি হয়েছে। অথচ তাদের চেয়ে বেশি অর্থ পান ফিটনেস ট্রেইনার ইভানও।
পল শুধু নারী দলের কোচিংয়ে নয়, জাতীয় দলের কোচ নিয়োগের ক্ষেত্রেও ভুমিকা রাখেন। হ্যাভিয়ের পলের মাধ্যমেই বাফুফেতে এসেছেন। ফিটনেস কোচ ইভান রাজলভও তার মাধ্যমে আসা। ফুটবল ফেডারেশনে গুঞ্জন রয়েছে, মিয়ানমারে অলিম্পিক দল না পাঠানোর প্রাথমিক প্রস্তাব নাকি পলেরই দেওয়া। বাফুফে নির্বাহী কমিটির একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সভাপতি প্রশাসনিক বিষয়ে যেমন সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলেন, তেমনি টেকনিক্যাল বিষয়ে পলের ওপর। নির্বাহী কমিটির অধিকাংশ সদস্যের সোহাগের ওপর যেমন অসন্তোষ ছিল তেমনি পলের ওপরও।’
এজেড/এফআই/জেএস