বিশ্ব ক্রিকেটে ইংল্যান্ড বছর
রাত পোহালেই শেষ হতে যাচ্ছে ২০২২ সাল। বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক ছড়ানো করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ায় চলতি বছর ক্রীড়াক্ষেত্রে চলেছে উৎসব। একের পর এক খেলা যেন লেগেই ছিল। বাদ যায়নি ক্রিকেটও। বছর জুড়েই চলেছে মাঠের লড়াই। উত্থান-পতনের পাশাপাশি তাতে অঘটনের মুখও দেখতে হয়েছে ক্রিকেটপ্রেমীদের। এছাড়া এ বছর ক্রিকেটে এসেছে অনেক নতুন মুখ আর বিদায় নিয়েছেন পুরোনোদের অনেকেই। সবকিছুই যেন মিলেমিশে রঙিন তুলেছিল বিশ্ব ক্রিকেটাঙ্গন।
চলতি বছরে বিশ্ব ক্রিকেট দেখেছে ইংল্যান্ডের ঘুরে দাঁড়ানোর মানসিকতা। একেবারে জিরো থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত বছরটা রাঙিয়েছে ইংলিশরা। ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহের রেকর্ড গড়ার পর টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম দিনে ৫০০ রানের রেকর্ডও গড়েছে এই দলটা। অথচ বছরের শুরুটা ছিল কী জঘন্য!
টেস্ট ক্রিকেটে গত বছরটা বেশ হতাশায় কেটেছে ইংলিশদের। এক বছরে সর্বাধিক টেস্ট হারের লজ্জার রেকর্ডে বাংলাদেশের পাশে নাম লিখিয়েছিল ক্রিকেটের জন্মভূমির দেশ। শেষ পেরেকটা ঠুকে দেয় অস্ট্রেলিয়া, অ্যাশেজে। মর্যাদার লড়াইয়ে জো রুটদের ৪-০ তে হারিয়ে আত্মবিশ্বাসের বাকিটুকুও শেষ করে দেয় অজিরা। কোচের দায়িত্ব ছেড়ে দেন ক্রিস সিলভারউড, কিছুদিনের ব্যবধানে অধিনায়কত্ব ছাড়েন রুটও। এভাবে দুঃস্বপ্নের মতোই শুরু হয় ইংলিশদের নতুন বছর।
ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পটা শুরু সেখান থেকেই। ক্রিকেট থেকে দীর্ঘদিনের বিরতিতে থাকা বেন স্টোকসকে করা হয় ইংলিশদের টেস্ট অধিনায়ক। ব্রেন্ডন ম্যাককালাম আসেন লাল বলের কোচ হয়ে। শুধু তাই নয়, গভার্নিং বডিতেও পরিবর্তন এনেছে দলটি। ইংলিশদের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয় রব কি-এর হাতে। এই তিনে মিলে হুট করেই পরিবর্তন করে দেন টেস্ট দলের চেহারা। বাজবলের নামে টেস্ট ক্রিকেটে আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের সূচনা করে ইংলিশরা।
স্টোকস-ম্যাককালাম দায়িত্ব গ্রহণ করার পর ইংল্যান্ড মোট ১০টি টেস্ট খেলেছে। তাতে একটি মাত্র টেস্টে হেরেছে ইংলিশরা, সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে। বাকি ৯ ম্যাচের মধ্যে ৮টিতেই জয় তুলে নিয়েছে বেন স্টোকসের দল। শুধু তাই নয়, ২০০৫ সালের পর প্রথমবার পাকিস্তান সফরে গিয়ে স্বাগতিকদের হোয়াইটওয়াশ করে ফিরেছে ইংলিশরা।
টেস্টের পর সাদা বলের ক্রিকেটেও নিজেদের চেহারা বদলে ফেলেছিল ইংল্যান্ড। বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ইয়ন মরগান স্বেচ্ছায় অবসর নিলে কাপ্তান হন জস বাটলার। তবে প্রথম অ্যাসাইনমেন্টেই ঘরের মাঠে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সিরিজ হারে বাটলারের দল। এরপর ঘুরে দাঁড়ানোটা যে কী জিনিস, সেটাই প্রমাণ করে দিয়েছে এই দল। বছরের শেষদিকে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড। দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষুদ্রতম ফরম্যাটে বিশ্বকাপ জিতে বছরটাকে পরিপূর্ণ রূপ দেয় ইংলিশরা।
চলতি বছরের ক্রিকেটে উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে থাকবে শ্রীলঙ্কার উত্থান। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া দলটি দেশের ক্রান্তিলগ্নে যেভাবে ঘুরে দাঁড়ালো, সেটা মনে রাখার মতোই। শুরুটা জুন- জুলাইয়ে অস্ট্রেলিয়ার শ্রীলঙ্কা সফর দিয়ে। নাজুক অর্থনীতির কারণে ওই সময়ের দিকে শ্রীলঙ্কান অবস্থা ছিল করুণ। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ পরিচালনা করার মতো অর্থও তাদের ছিল না। দেশের এই করুণ অবস্থায় টি-টুয়েন্টি সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচ হারে দাসুন শানাকার দল।
এরপরই এক অপ্রতিরোধ্য শ্রীলঙ্কাকে দেখে বিশ্ব ক্রিকেট। টি-টোয়েন্টির তৃতীয় ম্যাচে তিন ওভারে ৫৯ রানের লক্ষ্য ১ বল হাতে রেখে জেতার পর ওয়ানডে সিরিজও জিতে নেয় লঙ্কানরা। টেস্ট সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচেও পায় বিশাল জয়। এরপর এশিয়া কাপ। এখানেও বিরাট সাফল্য ধরা দেয়। প্রথম ম্যাচে আফগানদের কাছে বড় ব্যবধানে হেরে এরপর সবগুলো ম্যাচে জিতেছে দাসুন শানাকার দল। দ্বীপ দেশে যায় এশিয়া সেরার মুকুট।
ছোট দলের মধ্যে এ বছর চমক দেখিয়েছে জিম্বাবুয়ে। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর প্রথমবার আইসিসি টুর্নামেন্টে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে তারা। এর চেয়েও আনন্দের বিষয় অস্ট্রেলিয়াতে স্মরণীয় ওয়ানডে জয়। টাউনসভিলের ওই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে রায়ান বার্লের ১০ রানে ৫ উইকেটে ১৪১ রানে আটকে দেয় জিম্বাবুয়ে। জবাবে নিজেরা ৭ উইকেটে ১৪২ রান তোলে। ওয়ানডেতে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে এ নিয়ে দ্বিতীয় জয় পায় জিম্বাবুইয়ানরা।
এছাড়া বাংলাদেশের বিপক্ষেও বহু বছর পর ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সিরিজ জেতে জিম্বাবুইয়ানরা। টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপেও তারা খেলেছে দাপুটে ক্রিকেট। ফাইনালিস্ট পাকিস্তানকে সুপার টুয়েলভে হারিয়েছে তারা। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের এমন উত্থানের নায়ক সিকান্দার রাজা। ব্যাট ও বল হাতে অসাধারণ এক বছর কাটিয়ে বর্ষসেরা ক্রিকেটারের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে বছরটা কেটেছে প্রাপ্তি আর হতাশা মিলিয়ে। মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টে জয় দিয়ে বছরের শুরুটা রাঙিয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ইতিহাস গড়ে প্রথম টেস্ট জিতেছিল টাইগাররা। এরপর সাউথ আফ্রিকার মাটিতে প্রথমবার ওয়ানডে সিরিজ জয়ও ছিল উদযাপনের বেশ বড়সড় এক উপলক্ষ্য। তবে মাঝের দিকে বেশ খাপছাড়া লেগেছে টাইগারদের।
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে ও টি-টুয়েন্টি সিরিজ হারের পর এশিয়া কাপেও গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ বাংলাদেশ। হারের গ্লানি যখন চেপে ধরেছিল, তখন টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে মন দেয় সাকিব আল হাসানের দল। সেখানে দুটি জয় পেলেও কোনো বড় দলকে হারাতে পারেনি টাইগাররা। কিন্তু বছরের শেষটায় আবার ঠিকই ভালো করেছে বাংলাদেশ। ঘরের মাঠে ভারতের পূর্ণশক্তির দলকে ওয়ানডে সিরিজে হারিয়েছে সাকিব-মিরাজরা।
গড়পড়তার চেয়ে ভালোই এক বছর কাটিয়েছে পাকিস্তান। বছরের দুটো মেজর টুর্নামেন্ট, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলেছে বাবর আজমের দল। তবে দুই টুর্নামেন্টেই তরী এসেছে পাকিস্তানের। বছরের শেষটা অবশ্য ভালো যায়নি বাবর-রিজওয়ানদের। ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশের লজ্জায় পড়েছে ১৯৯২ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা।
বড় টুর্নামেন্টে তেমন সাফল্য না পেলেও বছরটা একদম খারাপ কাটেনি নিউজিল্যান্ড ও ভারতের। দুদলই খেলেছে বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল পর্যন্ত। বছর জুড়ে ৮টি টেস্ট খেলে ৫টিতে জিতেছে ভারত। ওয়ানডেতে পরিসংখ্যানটা কিছুটা হতাশাজনক। বিশ্বের অন্যতম সেরা দল বছরে ২৪টি ওয়ানডে খেলে ১০টিতেই হেরেছে। সুখকর ব্যাপার, তিন বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেঞ্চুরি খরায় ভোগা বিরাট কোহলি এ বছর ওয়ানডে ও টি-টুয়েন্টি মিলিয়ে সেঞ্চুরি করেছেন দুটো।
হতাশার বছর কেটেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের। দুই বারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নদের এবার খেলতে হয়েছে বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব। আর সেখান থেকেও উতরোতে পারেনি নিকোলাস পুরানের দল। এছাড়াও এই বছরই আয়ারল্যান্ড ও বাংলাদেশের বিপক্ষে ঘরের মাঠে ওয়ানডে সিরিজ হেরেছে ক্যারিবীয়রা।
সাউথ আফ্রিকার বছরটাও কেটেছে অনেকটা বাজেভাবেই। বছরের শুরুতে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে ও টেস্ট সিরিজ জয় ছাড়া তেমন সাফল্যই নেই তাদের।টি-টয়েন্টি বিশকাপেও জায়গা হয়নি শেষ চারে। এছাড়া বছরের শেষ টেস্ট সিরিজেও অস্ট্রেলিয়ার কাছে বাজেভাবে হেরেছে দলটি।
এনইআর