মেসি-বেনজেমার স্বপ্নপূরণের বছরে বিষাদে ডুবিয়ে গেলেন পেলে
লিওনেল মেসি ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে সুযোগটা পেয়েছিলেন। তবে সেবার একটুর জন্য হাত ফসকে গিয়েছিল সোনার হরিণটা। এর অনেক আগে থেকেই অবশ্য বলে আসছিলেন, বিশ্বকাপ নামের সোনার হরিণটা জিততে চান; মারাকানায় যখন খুব কাছে গিয়েও পারলেন না, তখন থেকে তার আফসোসটা জোরালোই হচ্ছিল। একবার তো বলেও দিয়েছিলেন, সব অর্জনের বিনিময়ে হলেও একটা বিশ্বকাপ জিততে চাইতেন! সে আজন্ম সাধের, আজন্ম আক্ষেপের পরিসমাপ্তি ঘটেছে এ বছর; এই ২০২২ এ এসে, যখন তিনি অপেক্ষায় আছেন অবসরের!
মেসি তার ক্যারিয়ারের যে অর্জনের সবক’টা দিয়ে বাজি ধরতে চেয়েছিলেন, সে ব্যালন ডি’অরই আবার কারও কারও কাছে পরম আরাধ্য এক বস্তু। মেসির মতো কৈশোর-তারুণ্যে নয় অবশ্য, কারিম বেনজেমা ব্যালন ডি’অর জিততে চেয়েছিলেন ৩০ পেরোনোর পর, যে বয়সে ফুটবলাররা ফুরিয়ে-বুড়িয়ে যেতে শুরু করেন। বেনজেমা বুড়োলেন না, চার বছরের মাথায়, এই ২০২২ সালে এসে সে স্বপ্নটাকে সত্যি করেই ছাড়লেন। তার এই স্বপ্নপূরণের বছরের শেষটা অবশ্য হয়েছে ‘চোটের’ কারণে বিশ্বকাপ খেলতে না পারার বিষাদে।
তবে বছর শেষে তার চেয়ে বড় বিষাদে ডুবেছে ফুটবল। তর্কসাপেক্ষে সর্বকালের সেরা ফুটবলার পেলে যে চলে গেছেন ধরার মায়া কাটিয়ে! ফুটবলের রাজার মৃত্যুতে ফুটবল তো বটেই, গোটা বিশ্বই যেন ডুবে গেছে বিষাদের অতলে।
আরও পড়ুন >>> পেলেও পারলেন না মৃত্যুকে ডজ দিতে
এছাড়া বছরে যা হয়েছে, তা যেন সব নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ই! রিয়াল মাদ্রিদ ঘরে তুলেছে তাদের ১৪তম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা। শেষ ৮ বছরে যা তাদের ৫ম শিরোপা। তবে এবারের শিরোপাটা যেভাবে জিতেছে রিয়াল, তাতে তার মাহাত্ম্য বেড়ে গেছে বহু গুণে। দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে সেমিফাইনাল, প্রত্যেকটা রাউন্ডেই জিতেছে পিছিয়ে পড়ে দারুণ প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখে। এরপর দারুণ এক ফাইনালে লিভারপুলকে হতাশায় পুড়িয়ে পুনরুদ্ধার করেছে ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট।
বছর শেষে তার চেয়ে বড় বিষাদে ডুবেছে ফুটবল। তর্কসাপেক্ষে সর্বকালের সেরা ফুটবলার পেলে যে চলে গেছেন ধরার মায়া কাটিয়ে! ফুটবলের রাজার মৃত্যুতে ফুটবল তো বটেই, গোটা বিশ্বই যেন ডুবে গেছে বিষাদের অতলে।
রিয়াল ঘরোয়া লিগেও ছিল অদম্য। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনা থেকে ১৩ পয়েন্টে এগিয়ে থেকে জিতেছে লা লিগা শিরোপা। ওদিকে বার্সা পুড়েছে শিরোপাহীনতার আক্ষেপে। বছরের শুরুতে ইউরোপা থেকে ছিটকে গেছে, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে এবারও কিছু করতে পারেনি জাভি হার্নান্দেজের দল, আবারও খেলতে হচ্ছে ইউরোপাতে। সিটি জিতেছে প্রিমিয়ার লিগ, বায়ার্ন মিউনিখের ঘরে উঠেছে বুন্ডেসলিগা ট্রফি, পিএসজি আবারও হয়েছে ফ্রান্সের সেরা দল; এ সবও অবশ্য রুটিনই।
অধিবর্ষ নয়, এমন জোড় সংখ্যক বছরের মাঝামাঝিতে গোটা বিশ্ব মেতে ওঠে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থের’ উন্মাদনায়। তবে এবার এই ধারায় ছেদ পড়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের বুকে হওয়ায় বিশ্বকাপটা অনুষ্ঠিত হয়েছে নভেম্বর-ডিসেম্বরে।
তাই বলে জুন-জুলাইয়ে ভক্ত-সমর্থকদের লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা বা নেইমারের ব্রাজিলকে দেখার সাধ অপূর্ণ থাকেনি। নেইমাররা নেমেছেন প্রীতি ম্যাচে, আর আর্জেন্টিনা জিতেছে আরও একটা শিরোপা। ইউরো ২০২০ এর বিজয়ী ইতালিকে হারিয়ে ‘লা ফিনালিসিমা’ জেতে আর্জেন্টিনা, মেসির ট্রফি কেসে যোগ হয় আরও এক আন্তর্জাতিক শিরোপা।
আরও পড়ুন >>> ফুটবল তারকারা যেভাবে উঠে এসেছেন
তবে নতুন ক্লাব পিএসজির হয়ে লিগ জেতা বা জাতীয় দলের হয়ে ফিনালিসিমা, দুটোর কোনোটিই মেসিকে ব্যালন ডি’অরের ফেভারিট করতে পারেনি। মৌসুমের একটা বড় অংশ জুড়েই যে তিনি ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে!
অধিবর্ষ নয়, এমন জোড় সংখ্যক বছরের মাঝামাঝিতে গোটা বিশ্ব মেতে ওঠে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থের’ উন্মাদনায়। তবে এবার এই ধারায় ছেদ পড়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের বুকে হওয়ায় বিশ্বকাপটা অনুষ্ঠিত হয়েছে নভেম্বর-ডিসেম্বরে।
মেসি শেষ মৌসুমে ছিলেন ‘সাধারণ মানুষ’ হয়ে। তার অতিমানব অবতারটা যেন শেষ এক মৌসুমের জন্য নিজের করে নিয়েছিলেন বেনজেমা। রিয়াল মাদ্রিদ যে অবিস্মরণীয় এক চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতল, তার মূল কুশীলব তো ছিলেন তিনিই! যার ফলে ব্যালন ডি’অরের ঘোষণা আসার অনেক আগেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল তার জেতাটা। গত ৩০ অক্টোবর অবশেষে এসেছে সে ঘোষণা, বেনজেমা বনেছেন গ্রহের সেরা ফুটবলার।
মেসি অবশ্য শিগগিরই ফিরেছেন স্বরূপে। তার ফর্মের চূড়ান্তটাই দেখেছে কাতার বিশ্বকাপ। গোল করেছেন ৭টি, করিয়েছেন আরও তিনটি। অগণিতবার নিজের কারিশমা দেখিয়েছেন। ইতিহাসের সেরা ফাইনালে কিলিয়ান এমবাপের ফ্রান্সকে হারিয়ে পেয়ে গেছেন অধরা সেই সোনার হরিণের দেখাও। তবে এই মঞ্চে থাকতে পারতেন কারিম বেনজেমাও। চোট সেটা হতে দেয়নি। যে কারণে ধ্রুপদী ফাইনালে মেসি-এমবাপেদের সঙ্গে দেখা মেলেনি বেনজেমার।
আরও পড়ুন >>> অর্থনীতির বিশ্বকাপ!
তবে বছরের শেষে যা ঘটল, গোটা ফুটবল বিশ্বই তাতে ডুবে গেছে বিষাদের অতল গহ্বরে। ফুটবলের রাজা পেলে অনেক দিন ধরেই ক্যানসারের সঙ্গে লড়ছিলেন প্রাণপণ। বিদায়ী ডিসেম্বরের শুরুতে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল প্যালিয়াটিভ কেয়ারে, তখনই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, যে কোনো এক সময় আসতে পারে পেলের বিদায়ের খবর।
সে দুঃসংবাদটা এলো বছরের একেবারে শেষে এসে। বছর শেষের একদিন আগে ফুটবলকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে তিনি চলে গেছেন মৃত্যু নামক অমোঘ সত্যের প্রাচীর পেরিয়ে। তাতে বিশ্ব ফুটবলের নানা রঙের ২০২২ সালটা শেষ হয়েছে বিষাদের কালো চাদরে মুড়িয়ে।
এনইউ/এটি