নারী নই, আমি সাংবাদিক

বিশ্বকাপ মানেই সাংবাদিকদের রাজ্যের ব্যস্ততা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেই সকাল থেকে মধ্যরাত অব্দি খবরের পেছনে ছোটা। অন্য সবার মতোই সমানভাবে দৌড়াচ্ছেন স্পেনের ৫৪ বছর বয়সী মহিলা সাংবাদিক ক্রিস্টিনা কুবেরো আলকালডে । প্রেস কনফারেন্স, অনুশীলন ভেন্যু, স্টেডিয়াম সর্বত্রই তার সরব উপস্থিতি।
স্পেনের বার্সেলোনার এই মহিলার ক্রীড়া সাংবাদিকের সাংবাদিকতা শুরু ১৭ বছর বয়স থেকেই। ‘মুন্দো দেপরোতিভ’ স্পোর্টস পত্রিকাতে তার লেখালেখি শুরু। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থাতেই পেশাদার ক্রীড়া সাংবাদিক হয়ে ওঠা। সময়ের সঙ্গে নিজেকে পরিণত করেছেন ক্রমেই। দেশ, মহাদেশের গন্ডি পেরিয়েছেন ধারাবাহিকভাবে। ১৯৯৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বকাপ দিয়ে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা কাভারের অভিষেক। সেই স্মৃতি এখনও তার হৃদয়পটে, ‘আমি একমাত্র নারী ক্রীড়া সাংবাদিক ছিলাম। সকলের কাছ থেকেই দারুণ সহযোগিতা পেয়েছি।’ তিন দশকের ব্যবধানে কাতার বিশ্বকাপে এখন নারী সংবাদকর্মীর সংখ্যা শতাধিক (রিপোর্টার, ফটোগ্রাফার, ক্যামেরাপারসন সব মিলিয়ে)।
একটি বিশ্বকাপে একমাত্র নারী সাংবাদিক হিসেবে উপস্থিতির চেয়ে তার কাছে আরেকটি ঘটনা ছিল সবচেয়ে বড়, ‘প্রায় দুই দশক আগে সৌদি আরবের স্টেডিয়ামে আমিই প্রথম নারী হিসেবে প্রবেশ করেছিলাম। এটা আমার ক্যারিয়ারের অন্যতম বড় ঘটনা হিসেবে মনে করি।’
৩৮ বছরের ক্রীড়া সাংবাদিকতা জীবনে তিনি ৮ টি ফুটবল বিশ্বকাপ, অলিম্পিক, ২৫ টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল, ৭ টি ইউরো কাপ, চারটি কোপা আমেরিকা কাভার করেছেন। ফুটবল বিশ্বে তিনি অত্যন্ত পরিচিত মুখ। অনেক কিংবদন্তি ফুটবলার ও ব্যক্তিত্ব তার পরিবারেরই অংশ, ‘আমি নিজেকে সাংবাদিক মনে করি, নারী নয়। পেশা এবং ক্রীড়া কমিউনিটিও আমাকে নারী নয়, সাংবাদিক হিসেবেই মূল্যায়ন করে। পেশাগত দায়িত্ব পালনে আমি সবার সমানই সহযোগিতা পেয়েছি। অনেকের সঙ্গেই আমার অত্যন্ত ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। যেমন ব্রাজিলের রোনালদো আমার ভাই-ই।’
ব্রাজিলের রোনালোদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জন্যই তার ক্যারিয়ারের সেরা তিন মুহুর্তের মধ্যে রোনালদোর কাপ জয়ের স্মৃতিটিও রাখলেন, ‘১৯৯২ সালে আমার শহর বার্সেলোনায় অলিম্পিক হয়েছিল। নিজ শহরে অলিম্পিক কাভার করা ছিল অন্য রকম অভিজ্ঞতা। ২০০২ সালে আমার বন্ধু রোনালদো বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয় তাই সেই বিশ্বকাপটাও আমার জন্য বিশেষ স্মরণীয়। এরপর ২০১০ সালে নিজ দেশ স্পেনের বিশ্বকাপ জয়টা রাখব।’
ক্রিস্টিনারা চার ভাই বোন। একমাত্র তিনিই এই পেশায় এসেছেন। সেই ১৭ বছর বয়সে যখন ক্রীড়া নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন তখন পরিবার থেকে উৎসাহ পেয়েছিলেন, ‘আমার বাবা-মা ক্রীড়া ও সাংবাদিকতা কোনটার সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন না। এরপরও আমি যখন এই পেশার দিকে ধাবিত হই তখন তারা বেশ উৎসাহই দিয়েছেন।’
‘মুন্দো দেপরোতিভ’ পত্রিকায় তিনি সহ আরও চারজন সহকর্মী ছিলেন। সেই চার জনের মধ্যে তিনি ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল কাভার করার সুযোগ পান। এই প্রসঙ্গে তার অভিমত, ‘আমি খেলাধূলা বিশেষ করে ফুটবল প্রচন্ড ভালোবাসি। আমার কাজের ওপর অফিস ও কর্তৃপক্ষ আস্থা রাখতে পেরেছে এজন্যই বোধহয় আমাকে এই সুযোগ দিয়েছে। এর প্রকৃত উত্তর তারাই দিতে পারবে।’
২৭ বছর বয়সে বিয়ের পিড়িতে বসেন এই নারী ক্রীড়া সাংবাদিক। এখন তার ১৩ বছরের এক সন্তানও রয়েছে। ক্রীড়া সাংবাদিকতায় পরিবার রেখে দেশের বাইরে ঘুরাকেই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন, ‘পরিবারের বাইরে থাকাটা চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ করে বিশ্বকাপ ও অলিম্পিকের মতো আসরে প্রায় এক মাসের মতোই সময় লাগে। এটা নারীদের জন্য বেশি চ্যালেঞ্জ।’ সেই চ্যালেঞ্জ এখন ক্রিস্টিনার পরিবারের জন্য সহজাত হয়ে উঠেছে, ‘আমার পরিবার এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমার স্বামী বাস্কেটবল কোচ। সে আমার এই পেশা দারুণ উপভোগ করে। আমার ছেলেও তার মায়ের কাজে গর্বিত।’
টানা ৮ বিশ্বকাপ কাভার করায় ২৯ নভেম্বর আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সংস্থা থেকে তিনি সম্মানিত হয়েছেন। তিন দশকের বেশি ক্রীড়া সাংবাদিকতায় যুক্ত থাকায় নারী সাংবাদিকদের বিভিন্ন সেমিনার, সভায় তিনি বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন বিশ্ব জুড়ে। তার নিজ দেশ স্পেনে সাংবাদিকতা এবং ক্রীড়া উভয় ক্ষেত্রে ক্রিস্টিনা যেন একটা ‘প্রতিষ্ঠান’!
এজেড/এনইআর