অস্ট্রেলিয়ান স্পোর্টস জাদুঘর : ইতিহাস বিস্ময় আর মুগ্ধতার মেলবন্ধন
মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে এসে বিপাকেই পড়েছিলাম সেদিন, ঘুরছিলাম অনেকটা ছন্নছাড়ার মতো। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, কিছু করারও ছিল না। আমার এদিক-সেদিক পায়চারি করাটা নজরে পড়ল সেখানকার এক কর্মীর। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে জানতে চাইল, 'তোমার জন্য কী করতে পারি?' বললাম, বৃষ্টির জন্য বের হতে পারছি না, হাতে পর্যাপ্ত সময়, কী করব ভাবছি। একটা হাসি দিয়ে বলল- 'এমসিজিতে সময় কাটানোর তো অনেক রাস্তা আছে। তুমি চাইলে এখানকার স্পোর্টস মিউজিয়ামটা ঘুরে আসতে পারো।'
গলায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড। তারপরও নিরাপত্তাকর্মী পথটা আগলে ধরলেন। আগে টিকিট কাটতে হবে। ৩০ ডলার খরচ করে সেই মিউজিয়ামে যাব কি না দ্বিধায় থেকেও শেষ অবধি গেলাম এবং ফিরলাম রাজ্যের এক বিস্ময় নিয়ে।
এটি স্রেফ একটা জাদুঘর নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু। অবশ্য মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের আঙিনায় পা দিলে যে কেউ এমনিতেই মুগ্ধ হতে বাধ্য। চারপাশে সবুজের আনন্দ মেলা যেন, মাঝখানটাতে ক্রিকেটের স্বর্গোদ্যান! মেলবোর্ন ক্রিকেট স্টেডিয়ামের বিশালত্বই মুগ্ধ করতে বাধ্য দর্শনার্থীকে। আমি নিজেও প্রথমবারের মতো পা দিয়ে চমকে উঠেছিলাম- এত বড় হতে পারে ক্রিকেট মাঠ?
মজার ব্যাপার হলো- শুধু ম্যাচ থাকলেই যে এখানে দর্শক আসে তা কিন্তু নয়। মেলবোর্ন ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ম্যাচ না থাকলেও শত শত দর্শনার্থী আসে মাঠ পরিদর্শনের জন্য। আর সেটা অবশ্য দর্শনীর বিনিময়ে। স্কুল পড়ুয়াদেরই চোখে পড়ল বেশি। সঙ্গে নানা বয়সীরাও আছেন। পর্যটকদের দলকে মাঠের কোনায় নিয়ে গাইড তুলে ধরেন এই মাঠের বিশালত্ব।
তবে মাঠে দেখেই কেউ ফিরে আসলে নিশ্চিত ঠকবেন। আমি নিজেও হতে যাচ্ছিলাম সেই পথের পথিক। যদি না বৃষ্টি আগলে দাঁড়াত পথ আর স্টেডিয়ামের আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা সেই কর্মীটি যদি না বলতেন।
যেমনটা বলছিলাম, যাদুঘরে প্রবেশের ফি প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ৩০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার। কিন্তু গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি প্রবেশ করা মাত্র বিস্ময়ের যে ঘোরে আপনি পড়বেন- তাতে ওই পয়সা উসুল শুরুতেই। কী আছে এই স্পোর্টস জাদুঘরে এই প্রশ্ন না করে বলা উচিত কী নেই সেখানে?
অস্ট্রেলিয়ান ক্রীড়া ইতিহাসের সব উজ্বল স্মারক রয়েছে এখানে। যার দলিল তো আছেই, সঙ্গে থ্রিডিতেও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সেই গল্প। নতুন প্রজন্মের দর্শনার্থীদের কথা ভেবে প্রযুক্তির দারুণ ব্যবহার করা হয়েছে প্রতিটি ধাপে। তবে পুরোনো সংগ্রহগুলোই বেশি টানল আমাকে। চোখের সামনে যেন অমূল্য সব মণি-মাণিক্য!
দেখা মিলল স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের ব্যাট, শার্ট, ব্লেজার, জুতো। এই পোশাকেই ব্যাট হাতে ঝড় তুলেছিলেন কিংবদন্তি। একটু দূরে দেখা মিলল আরেক কিংবদন্তিতুল্য ক্রিকেটার স্টিভ ওয়াহর ওয়ানডে ক্যাপ। এই ভিক্টোরিয়ারই ক্রিকেটার কিথ মিলার। তাকে তো আলাদা করে দেখতেই হয়। তার সুয়েটার আর প্যাড সংরক্ষণ করা হয়েছে জাদুঘরে।
অস্ট্রেলিয়ার ক্রীড়াঙ্গনের যত সাফল্যগাথা সেসব নানা সময় পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। নিজে সংবাদমকর্মী বলে সেসবেও চোখ পড়ল। যেমন একটা পত্রিকায় দেখতে পেলাম সাদাকালো ছবি, যেখানে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের সেই ঐতিহাসিক উৎসবের ছবি- ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপ হাতে নিয়ে অধিনায়ক অ্যালান বোর্ডারের মুখে রাজ্য জয়ের হাসি।
মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের বাইরে শেন ওয়ার্নের স্ট্যাচু তো রীতিমতো পর্যটক আর আর ক্রিকেটপ্রেমীদের আগ্রহের তুঙ্গে। এই বছরের মার্চেই হঠাৎ না ফেরার দেশে চলে যাওয়া কিংবদন্তিতুল্য এই স্পিনারকে ভাল করেই ধরে রেখেছে অস্ট্রেলিয়ান স্পোর্টস মিউজিয়াম। অবশ্য এই ভিক্টোরিয়া তো ওয়ার্নেরই রাজ্য। দেয়ালের প্রজেকশনের ভিডিও স্লাইডে ওয়ার্ন যেভাবে কথা বলছেন, দেখে মনে হচ্ছে যেন চোখের সামনে কথা বলছেন!
মেলবোর্ন ওয়ার্নের শহর। আর এই মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের অনেক স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন তিনি। মেলবোর্নের ড্রেসিংরুমের সঙ্গে ভালোবাসা, এই এমসিজির একটি ওয়ানডে ম্যাচে অধিনায়কত্ব, ইংল্যান্ড সফরে মাইক গ্যাটিংকে নিজের প্রথম বলেই রাউন্ড দ্য লেগ বোল্ড করার সেই শতাব্দী সেরা ডেলিভারির সচিত্র গল্প শুনে মুগ্ধতা বাড়ল।
টেস্ট ইতিহাসের শতবর্ষ উদযাপনের ছবিটারও দেখা মিলল। যেখানে দেখা গেল স্যার ডনকেও। বডি লাইন সিরিজের দুই আলোচিত চরিত্র হ্যারাল্ড লারউড-ভোসের থেকে দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে স্যার ডন ব্র্যাডম্যান।
শুধু কি ক্রিকেট? অস্ট্রেলিয়ার ফুটি, রাগবি, টেনিস, সাইক্লিং, অ্যাথলেটিক্স, সাঁতার, গলফ- প্রায় সব খেলার কিংবদন্তি আর মহাতারকাদের পরিচিতিটাও এখানে একনজরে দেখে ফেললাম। ক্যাথি ফ্রিম্যানের সেই বিখ্যাত স্বর্ণজয়ী দৌড়ের ভিডিও আর বিশাল পর্দার সামনে বসে অস্ট্রেলিয়ার সব ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলোও ভেসে উঠল চোখের সামনে।
জাদুঘরটিকে ন্যাশনাল স্পোর্টস মিউজিয়াম কেন বলা হয় তার উত্তরটা পেয়ে গেলাম ঘন্টাখানেকের মধ্যে। ১৭.১ মিলিয়ন ডলার খরচ করে নতুন করে নির্মাণ করার জন্য ২০১৯ সালের আগস্টে বন্ধ করা হয় এই জাদুঘর। তারপর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফের চালু করা হয়।
মিউজিয়ামের শুরুটা হয়েছিল আরও আগে। সেই ১৯৮৬ সালের ২২ নভেম্বর।
সত্যিকার অর্থেই এটি কোনো সাধারণ জাদুঘর নয়। ইন্টার-একটিভ প্রদর্শনী থেকে শুরু করে খেলাধুলার চ্যালেঞ্জ, অস্ট্রেলিয়ান স্পোর্টস জাদুঘর অভিজ্ঞতার অনন্য এক দুয়ার। নতুন সব প্রযুক্তি আপনাকে নিয়ে যাবে অতীতের অন্য এক জগতে। তাইতো প্রায় প্রতিদিনই ভিক্টোরিয়ার নানা প্রান্ত থেকে স্কুল পড়ুয়ারা ছুটে আসে এখানে। দেশের ক্রীড়া ইতিহাস জেনে মুগ্ধ হয়ে ফিরে যায় তারা!
গত কয়েকদিন ধরেই মেলবোর্নের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আছি। চারপাশে যেন সৌন্দর্যের পসরা সাজানো। এখানকার মানুষজনও শান্ত, সৌম্য; তেমন তাড়াহুড়ো নেই কারও মধ্যে। নিজের মতো করে জীবন উদযাপনে ব্যস্ত সবাই। এটা এই শহরের আরেকটা সৌন্দর্য।
অস্ট্রেলিয়ার এই ন্যাশনাল স্পোর্টস মিউজিয়াম দেখে কেমন যেন একটা আক্ষেপও বাড়ল। আমাদেরও তো আছে অনেক কীর্তি। বলার মতো অনেক অর্জনে সমৃদ্ধ লাল-সবুজের ক্রীড়া ইতিহাস। অথচ একটা স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলেরই সবকিছু সংরক্ষণ করা হয়ে ওঠে না ঠিকঠাক! নতুন প্রজন্ম জানতে পারে না তাদের রয়েছে গর্ব করার মতো কিছু। অথচ ইচ্ছে থাকলেই কিন্তু উপায় হতো।
এটি/এনইআর/জেএস