বাংলাদেশের ‘প্রথম’ সেঞ্চুরির ৪০ বছর
ইউসুফ রহমান বাবু এখন যেন অনেকটা কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া নাম। সত্তর-আশির দশকের এই তারকা ক্রীড়াবিদের রয়েছে অনন্য এক কীর্তি। বিদেশি দল ও বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরি এসেছিল তার ব্যাট থেকেই। তাই স্বীকৃত কোনো ওয়ানডে, টেস্ট না খেলেও তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অনবদ্য এক চরিত্র।
১৯৮২ সালের ৯ জুলাই ইংল্যান্ডের বোর্নভিলে পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে আইসিসি ট্রফিতে ১১৫ রানের ইনিংস খেলেছিলেন ইউসুফ বাবু। ইউসুফ বাবু যখন আউট হন তখন বাংলাদেশ ১৭০ রানে ১ উইকেট। সেখান থেকে ২২৪ রানে অলআউট। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী সেই ম্যাচ পাপুয়া নিউগিনি তিন উইকেটে জিতে নেয়। নিজের ঐতিহাসিক সেঞ্চুরির চার দশক পর এখনো ম্যাচ হারের বেদনা তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে, ‘স্কোরাররা আমাদের ছয়, চার নোট করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিল। সবার ধারণা ছিল আমরা ৩০০ প্লাস করব। সেই ইনিংস আকস্মিকভাবে ২২৫ রানে থেমে যায়, শেষ পর্যন্ত হেরেও যাই।’
নিজের সেঞ্চুরি করে হারার পাশাপাশি বাংলাদেশের বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ মিস হওয়ার আফসোস এখনও বয়ে বেড়ান তিনি, ‘১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ খেলার দারুণ সম্ভাবনা ছিল। প্রথম দিকে দারুণ ছন্দে ছিল দল। গ্রুপের শেষ ম্যাচ বারমুডার কাছে হেরে সব ওলটপালট। সে ম্যাচে না হারলে ফাইনাল খেলা অসম্ভব ছিল না। ফাইনালে উঠলেই বিশ্বকাপ।’
১৯৮২ আইসিস ট্রফি ছিল ইউসুফ বাবুর ক্যারিয়ারে সোনালী সময়। পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে সেঞ্চুরির আগে সেই ইংল্যান্ড সফরেই আরেকটি সেঞ্চুরি করেছিলেন। প্রস্তুতি ম্যাচে রুশউইক সিসির বিপক্ষে ১৩ জুন ১১২ রানের অপরাজিত ইংনিস খেলেন। ৪৫ ওভারের সেই ম্যাচে অবশ্য বাংলাদেশ জিতেছিল ৭৮ রানে। পাপুয়া নিউগিনির ম্যাচটি আইসিসি ট্রফির হওয়ায় সেই ম্যাচটিকে বিদেশি দলের বিপক্ষে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের প্রথম শতক ধরা হয়।
ইংলিশ কন্ডিশনে সেই সময়ে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরি দেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে বিশেষ এক জায়গা দখল করে রেখেছে। তবে সেই ইতিহাস সংরক্ষণ ও মর্যাদায় নজর নেই দেশের ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের। প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি মেহরাব হোসেন অপির, প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি আমিনুল ইসলাম বুলবুলের। তেমনি ইউসুফ বাবুর সেই শতক বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রথম বিদেশের মাটিতে বিদেশি দলের বিপক্ষে। এই সেঞ্চুরি ঐতিহাসিক হলেও আলোচনার বাইরে।
এ নিয়ে খানিকটা আক্ষেপ থাকলেও এখন বিষয়টি গা সওয়া হয়ে গেছে তার, ‘আমি কখনো আমার স্বীকৃতি চাইব না। এটা তো বোর্ডের দায়িত্ব দেশের ক্রিকেটের সকল ইতিহাস ও ঐতিহ্য স্মরণ করা।’
১৯৮৬ সালে এশিয়া কাপে বাংলাদেশ দলের ওয়ানডে অভিষেক হলেও আট বছর আগে এমসিসির সঙ্গে খেলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যাত্রা শুরু। ৮২ আইসিসি ট্রফির মতো বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অভিষেকেও বিশেষ কীর্তি বাবুর। খেলেছিলেন ৭৮ রানের অনবদ্য ইনিংস। বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর চোখে এখনো লেগে রয়েছে সেই ইনিংস, ‘লম্বা সুঠাম ইংলিশ বোলারদের ইউসুফ বাবু ভাই যেভাবে সাবলীল ও আগ্রাসী ভঙিমায় খেলেছেন, সেটা এক কথায় অসাধারণ।’ ওই ইনিংসের পর থেকেই মূলত ইউসুফ বাবু রীতিমতো তারকা হয়ে ওঠেন।
সেই ম্যাচে বাবু মিডল অর্ডারে ব্যাট করলেও পরবর্তীতে ওপেনিংয়ে ব্যাট করেছেন। ৮২ আইসিসি ট্রফিতে ওপেনিংয়ে ব্যাট করে ৭০০’রও বেশি রান করেছেন ৷ স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ক্রিকেটে সেরা ক্রিকেটারদের মধ্যে অন্যতম ইউসুফ রহমান বাবু। জাতীয় দলে খেলেছেন দাপটের সঙ্গে। যোগ্যতা-সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ দলের অধিনায়কত্ব করা হয়নি তার। এ নিয়ে আক্ষেপ থাকলেও সেই সময়ের স্মৃতি স্মরণে অনীহা তার।
ফর্ম ও ফিটনেস থাকতেই জাতীয় দল থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। ১৯৮৬ সালে বোর্ড তাকে অবসর ভেঙে আবার জাতীয় দলে ফেরার অনুরোধ করে। তিনি সেই সময় একটি শিপিং কোম্পানি চাকরি করছেন। জাতীয় দলে ফেরার জন্য বোর্ড থেকে তার কোম্পানিকে চিঠি দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিল। বোর্ড চিঠি দিলেও সেই চিঠির ভাষা তাকে আশাহত করে। ফলে আর জাতীয় দলে ফেরা হয়নি এবং স্বীকৃত ওয়ানডেও খেলা হয়নি এই কৃতি ক্রিকেটারের।
ক্রিকেট ও বাস্কেটবল একসঙ্গেই চালিয়েছেন অনেক দিন। সত্তর দশকে ঘরোয়া বাস্কেটবল লিগে স্পার্সের হয়ে খেলেছেন। সেই সময় জাতীয় দলের বাস্কেটবল খেলা কম হওয়ায় ক্রিকেটের দিকেই শেষের দিকে ঝুঁকে পড়েন, ‘বেশ আগ্রহ নিয়েই বাস্কেটবল খেলতাম। আগ্রহ থাকতাম জাতীয় দলে খেলা কখন হবে। ক্যাম্পও করেছি মাঝে মধ্যে। ’৭৭ সাল পর্যন্ত বাস্কেটবল জাতীয় দলের খেলা হয়নি। ৭৭ সালে ক্রিকেটে এমসিসি আসল। এরপর থেকে ক্রিকেটেই বেশি ঝুঁকে পড়ি।’ স্বাধীনতার পরে জাতীয় দলে খেলা না হলেও আগে পশ্চিম পাকিস্তানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ব পাকিস্তানের হয়ে বাস্কেটবল খেলতে গিয়েছেন৷
বাবুর ওয়ানডে অভিষেক না হলেও তার অনুজ সামিউর রহমান ২ টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন। সদ্য প্রয়াত সামিউর রহমানের ছেলে রিয়াজুর রহমান রোহানের এই বিষয়ে খানিকটা আক্ষেপ রয়েছে, ‘বাংলাদেশ ১৯৮৬ সাল থেকে ওয়ানডে খেলছে। কিন্তু এর আগেও তো বাংলাদেশ দল ছিল। সেই সময়ের ক্রিকেটারদের পরিচয়ের ক্ষেত্রে অনেক সময় শুধু ২-৩টি ওয়ানডে খেলার কথা উল্লেখ করা হয় কিন্তু তাদের অনেকেই প্রায় এক দশকের বেশি সময় জাতীয় দলে ছিলেন। এটিও ক্যারিয়ার বর্ণনায় সময় উল্লেখ করা প্রয়োজন।’
ক্রীড়াঙ্গনে ইউসুফ রহমান বাবুর পরিচিতি ক্রিকেটার হলেও খেলাধূলায় তার প্রথম প্রেম বাস্কেটবল। ক্রিকেটারের পাশাপাশি বাস্কেটবল খেলোয়াড় পরিচয় দিতেও তার অনেক গর্ববোধ, ‘সত্যিকার অর্থে ক্রিকেট আমাকে অনেক মানুষের কাছে পরিচিত করেছে। তবে আমার প্রিয় খেলা বাস্কেটবল এবং বলতে গেলে বাস্কেটবলই ছিল ভালোবাসা।’
ক্রিকেট ও বাস্কেটবল একসঙ্গেই চালিয়েছেন অনেক দিন। সত্তর দশকে ঘরোয়া বাস্কেটবল লিগে স্পার্সের হয়ে খেলেছেন। সেই সময় জাতীয় দলের বাস্কেটবল খেলা কম হওয়ায় ক্রিকেটের দিকেই শেষের দিকে ঝুঁকে পড়েন, ‘বেশ আগ্রহ নিয়েই বাস্কেটবল খেলতাম। আগ্রহ থাকতাম জাতীয় দলে খেলা কখন হবে। ক্যাম্পও করেছি মাঝে মধ্যে। ’৭৭ সাল পর্যন্ত বাস্কেটবল জাতীয় দলের খেলা হয়নি। ৭৭ সালে ক্রিকেটে এমসিসি আসল। এরপর থেকে ক্রিকেটেই বেশি ঝুঁকে পড়ি।’ স্বাধীনতার পরে জাতীয় দলে খেলা না হলেও আগে পশ্চিম পাকিস্তানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ব পাকিস্তানের হয়ে বাস্কেটবল খেলতে গিয়েছেন৷
সাবেক এই ক্রিকেটার এত ভালো বাস্কেটবল খেলোয়াড় ছিলেন যে তাকে দেশের অন্যতম সেরা বাস্কেটবল খেলোয়াড়ও বলা হতো। তবে তার দৃষ্টিতে সেরা অন্য জন, ‘নওশের হাসান অসম্ভব মানের খেলোয়াড় ছিলেন। তার সমকক্ষ সেই সময় কেউ ছিল না।’ বাস্কেটবলের কারণে বাবু ক্রিকেটে অন্যদের চেয়ে আলাদা হয়েছে, ‘আমার ব্যাটিং ও কিপিং দুটোই ছিল আক্রমণাত্নক। বাস্কেটবলের অ্যাটাকিং মনোভাবটাই আমি ক্রিকেটে কাজে লাগিয়েছি। যা হয়তো সেই সময় আমাকে খানিকটা স্বাতন্ত্র্য এনে দিয়েছে।’
খেলোয়াড় হিসেবে অবসর নেয়ার পর ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হননি। ১৯৮৮ সালে প্রিয় খেলা বাস্কেটবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। তার সময়ের সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করলেন এভাবে, ‘জেনারেল সাদেক (এনএসসির চেয়ারম্যান) আমাকে অনুরোধ করেছিলেন ফেডারেশনের দায়িত্ব নিতে। সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে স্পন্সর জোগাড় করে টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছিলাম। বাংলাদেশ দলকে বিদেশেও পাঠিয়েছিলাম।’ তার মেয়াদ কালে বাংলাদেশ এশিয়ান বাস্কেটবল চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেছিল।
বাস্কেটবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক দুই বছর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর দেশের ক্রীড়াঙ্গন থেকে বিচ্ছিন্নই হয়ে যান তিনি। আমেরিকার একটি আন্তর্জাতিক এক শিপিং কোম্পানিতে চাকরি নেন। ক্রীড়াবিদদের মধ্যে শিপিংয়ে চাকরি ও সেই সময় বিদেশে চাকরি করার ক্ষেত্রে তিনিই প্রথম, ‘খেলোয়াড় থাকাবস্থায় আমি শিপিংয়ে কাজ করেছি। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আমাকে আমেরিকা থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমার যোগ্যতা-সামর্থ্য তাদের মিলে যাওয়ায় এবং সুযোগ সুবিধা আমার পছন্দ হওয়ায় আমেরিকাতেই স্থায়ী হই।’ এখনও তিনি আমেরিকাতেই রয়েছেন। মাঝে মধ্যে দেশে বেড়াতে আসেন৷
সাবেক এই ক্রিকেটার এত ভালো বাস্কেটবল খেলোয়াড় ছিলেন যে তাকে দেশের অন্যতম সেরা বাস্কেটবল খেলোয়াড়ও বলা হতো। তবে তার দৃষ্টিতে সেরা অন্য জন, ‘নওশের হাসান অসম্ভব মানের খেলোয়াড় ছিলেন। তার সমকক্ষ সেই সময় কেউ ছিল না।’ বাস্কেটবলের কারণে বাবু ক্রিকেটে অন্যদের চেয়ে আলাদা হয়েছে, ‘আমার ব্যাটিং ও কিপিং দুটোই ছিল আক্রমণাত্নক। বাস্কেটবলের অ্যাটাকিং মনোভাবটাই আমি ক্রিকেটে কাজে লাগিয়েছি। যা হয়তো সেই সময় আমাকে খানিকটা স্বাতন্ত্র্য এনে দিয়েছে।’
ইংরেজি দক্ষতা খুব ভালো হওয়ায় আমেরিকায় তিনি দারুণভাবে মানিয়ে নেন৷ তার ইংরেজি দক্ষতায় আমেরিকানরা অনেক সময় বিস্মিত হতেন, ‘আমার ইংরেজি উচ্চারণ, লেখার ধরন সবই আমেরিকানের মতো। ছোট বেলা থেকে আমি ইংরেজি বই উপন্যাস পড়েছি। ফলে ইংরেজি আমার কাছে অত্যন্ত সহজাত।’ তিনি তার দেখা ক্রিকেট নিয়ে একটি বই লিখেছেন। সেই বইও ইংরেজিতে লেখা।
ইউসুফ রহমান সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। তার বাবা মতিউর রহমান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিভাগের পরিচালক। বাংলাদেশে ক্রীড়াবিদ তৈরির জন্য আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন মতিউর রহমান। বাবার সাথে বিকেএসপির অনেক পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনার সঙ্গে তিনিও জড়িত ছিলেন।
ক্রিকেট, বাস্কেটবল খেলার পাশাপাশি মাঝে মধ্যে সালাউদ্দিন, বাদশাদের (আজাদ বয়েজে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেছেন একসাথে) সঙ্গে আবাহনীতে ফুটবলও অনুশীলন করেছেন। এত খেলাধুলার মধ্যেও পড়াশোনা ঠিকই ছিল, ‘বাবা সব সময় পড়াশোনার দিক খেয়াল রাখতেন। আমিও চেষ্টা করতাম ভালো করে পড়াশোনা করতে।’
বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন অনেক অগ্রসর হলেও ক্রিকেটারদের পড়াশোনা ঘাটতির বিষয়টি তার চোখে বিশেষভাবে পড়ছে, ‘একাডেমিক শিক্ষা জরুরি। সকল ক্রিকেটার শিক্ষিত হয়ে আসবে না। বোর্ডকে একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে খেলোয়াড়দের শিক্ষিত করে তুলতে হবে।’ বেশ কয়েক বছর আগে এই বিষয়ে বোর্ডকে একটি মডেল প্রস্তাবনাও দিয়েছিলেন তিনি।
নিজের প্রিয় খেলা বাস্কেটবল এখন অস্তিত্বের সংকটে। সুদূর আমেরিকায় থাকলেও মন কাঁদে বাস্কেটবলের জন্য, ‘এক সময় ক্রিকেটের চেয়ে বাস্কেটবল জনপ্রিয় ছিল। সেই খেলা এখন নেতৃত্ব সংকট ও পরিকল্পনাহীনতাই খুব সংকটে ভাবতেই খারাপ লাগে।’
এজেড/এনইউ/এটি