ইমরান-দেবাশীষ : ক্রীড়াঙ্গনের দুই দশকের দুই সেবক
খেলাধুলার সঙ্গে আঘাত, ইনজুরির সম্পর্ক ওতপ্রোত। গত দুই দশকে ইনজুরি আক্রান্ত দেশের অসংখ্য ক্রীড়াবিদের আস্থার দুটি নাম আলী ইমরান ও দেবাশীষ চৌধুরী। এই দুই চিকিৎসক দেশের দুই বড় খেলা ফুটবল, ক্রিকেটে সেবা দিচ্ছেন অনেক দিন। ফুটবল ক্রিকেটের বাইরেও আরো অনেক খেলায় আঘাতপ্রাপ্ত ক্রীড়াবিদদের নির্ভরতার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন ইমরান ও দেবাশীষ।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের ক্রীড়া নানা খাতে বিকশিত হলেও ক্রীড়া চিকিৎসা, ক্রীড়া মেডিসিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দিকটি আলোর বাইরে থেকেছে বরাবরই। কনক কান্তি বড়ুয়া, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, রশীদ উদ্দীন সহ আরো অনেক বিশিষ্ট চিকিৎসক ক্রীড়াঙ্গনে তাদের ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে যুক্ত থাকলেও পরবর্তীতে পেশাগত ব্যস্ততায় আর সেভাবে সময় দিতে পারেননি। ওমর ফারুক ক্রীড়াঙ্গনের ডাক্তার হিসেবে বেশ পরিচিতি পেয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর ক্রীড়াঙ্গনে এক বড় ধাক্কা আসে। দেবাশীষ ও ইমরানের সেবায় সেই ধাক্কা খুব বেশি টের পায়নি ক্রীড়াসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
১৯৯৮ সাল থেকে ক্রীড়াঙ্গনে সম্পৃক্ততা শুরু ইমরানের। ইমরান ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে দুই দশকের বেশি সময় থাকলেও তার ক্রীড়াঙ্গনে আবির্ভাব ক্রিকেটের মাধ্যমে, ‘মেডিকেলে পড়াশোনা করলেও ফুটবলের ভক্ত ছিলাম অনেক। কাজিন ফুটবলার (ওয়ারী ক্লাবের তারকা ফুটবলার লোভন) হওয়ায় ক্লাবপাড়া ও স্টেডিয়ামে যাতায়াত ছিল অনেক। ক্রীড়াঙ্গনে সম্পৃক্ত হওয়ার ইচ্ছে আগে থেকেই। ১৯৯৮ সালে মিনি বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টে সিনিয়র স্যাররা মেডিকেল টিমে রাখায় সেই সুযোগ পাই। তখন ক্রিকেট ফুটবল দুই সংস্থাই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। হারুন ভাই তখন ফুটবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। তিনি ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অনুরোধ জানান। এরপর থেকে ফুটবলের সঙ্গেই রয়েছি।’ -বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।
দেবাশীষের ক্রীড়াঙ্গনের আসার গল্পটা বেশ বৈচিত্র্যময়। সিলেট মেডিকেল থেকে এমবিবিএস করার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলে ১৯৯৮ সালে ফিজিক্যাল মেডিসিনের উপর ট্রেনিং করেন। সেই ট্রেনিংয়ের এক পর্যায়ে বাইরে উচ্চ শিক্ষার আগ্রহ জন্মায় দেবাশীষের। ইংল্যান্ডের কুইন মেরী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্পোর্টস ফিজিশিয়ান হওয়ার ডিগ্রি নেন। দুই যুগ আগে এই বিষয়ে লন্ডনে গিয়ে পড়াশোনা করতে পেরেছেন পারিবারিক কারণেই, ‘আমার পরিবার পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন। বিশেষ করে বাবা বলেছিলেন, ‘তোমাকে লন্ডন পড়াবো, যেই বিষয়ে পড়ো। তখন গতানুগতিক বিষয় না পড়ে ব্যতিক্রম বিষয় পড়লাম’ -বলেন দেবাশীষ।
২০০০ সালে মাস্টার্স শেষ করে দেশে ফিরে পড়েন এক শূন্যতায়। বাংলাদেশে এই বিষয়ে নেই তেমন কর্মক্ষেত্র ও সচেতনতা। খালাতো ভাইয়ের পরামর্শে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ততকালীন ভারপ্রাপ্ত সচিব (বর্তমান মন্ত্রী পরিষদ সচিব) খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের কাছে যান পরামর্শ নিতে। আনোয়ারুল ইসলামের সঙ্গে আলোচনার পরই জানতে পারেন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগ পুনর্গঠিত হচ্ছে।
২০০১ সালে বিকেএসপির ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগে শুরু হয় তার পেশাগত জীবন। ২০০১-০৮ পর্যন্ত তিনি বিকেএসপিতে কর্মরত ছিলেন। সেই সময় ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করা ফারুকুল ইসলাম দেবাশীষের অবদান সম্পর্কে বলেন, ‘সে বাংলাদেশের ক্রীড়ার বিশেষ সম্পদ। ইনজুরি ব্যবস্থাপনা, পুর্নবাসন, স্পোর্টস মেডিসিন সব বিষয়ে অত্যন্ত দক্ষ। তার সময়ে বিকেএসপির শিক্ষার্থীরা অনেক উপকৃত হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ফেডারেশনকেও অনেক সহায়তা করেছে।’
২০০৮ সালের পর দেবাশীষ বিকেএসপি ছেড়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে যোগদান করেন। তার নেতৃত্বে বিসিবির মেডিক্যাল টিম এখন বেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিসিবির মেডিক্যাল বিভাগের পাশাপাশি নিজস্ব একটি চেম্বারও পরিচালনা করছেন৷ দেবাশীষ এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। তার এই ক্যারিয়ারের পেছনে বিকেএসপির সেই সময়কে অবদান দেন অনেক, ‘বিকেএসপি আসলেই দেশের ক্রীড়াঙ্গনের কাজের সবচেয়ে বড় জায়গা। আমার ক্যারিয়ারের হাতেখড়ি বিকেএসপিরই। দেবাশীষ হয়ে উঠার পেছনে বিকেএসপির অবদান অনেক।’
আলী ইমরানের দৃষ্টিতে বড় কৃতিত্ব দেবাশীষের নিজেরই, ‘ক্রীড়া ফিজিশিয়ান হিসেবে পেশা প্রতিষ্ঠা করা খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। দেবাশীষ সেই চ্যালেঞ্জ উতরে নতুনদের পথ দেখাচ্ছে। ক্রীড়াঙ্গনে দেবাশীষ যেভাবে ভূমিকা রাখছে তা অবিস্মরণীয়।’
দেবাশীষ অবশ্য ইমরানের অবদানকে বড় করে দেখছেন, ‘বিকেএসপিতে জব করেছি, এখন বিসিবিতেও। এটাই আমার পেশা। ইমরান ভাই দেশের শীর্ষ মেডিকেলের শিক্ষক। শিক্ষকতা, প্র্যাকটিসের পাশাপাশি ক্রীড়াঙ্গনকে ভালোবেসে সময় দিচ্ছেন বছরের পর বছর। তার অবদানও অনেক।’
দেবাশীষ দুই যুগ আগে ঝুঁকি নিয়ে সফল হলেও এখনো উত্তরসূরিদের পথ দেখেন কঠিন, ‘কাজের ক্ষেত্র এখনো সেভাবে তৈরি হয়নি। বিসিবি, বিকেএসপি ছাড়া অন্য কোনো ফেডারেশনের স্পোর্টস ফিজিশিয়ান রাখার সক্ষমতা নেই। ফলে পেশা হিসেবে নেয়ার সুযোগ খুবই সীমিত।’ বাংলাদেশে পূর্নাঙ্গ পেশা হিসেবে নেয়া স্পোর্টস ফিজিশিয়ান মাত্র ৩ জন। দেবাশীষের বিসিবির সহকর্মী ডা. মনজুর ও বিকেএসপির ডা. সামির।
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে সাকিব, তামিম, এমিলিরা যেমন পরিচিত মুখ তেমনি দেবাশীষ-ইমরানরাও। এই বিষয়ে দেবাশীষের মিশ্র প্রতিক্রিয়া, ‘এক দিক থেকে ভালো লাগে ক্রীড়াঙ্গনের অনেকেই আমার কাছে আসে। আবার এক দিক থেকে খারাপ লাগে এ রকম আরো দেবাশীষ থাকা প্রয়োজন ছিল। জাতীয় দল, সিনিয়র ক্রীড়াবিদরা হয়তো আমার কাছে আসেন। কিন্তু জুনিয়র পর্যায়ে, গ্রামের একজন মেধাবী ক্রীড়াবিদের ক্যারিয়ার হয়তো শুরুতেই হোঁচট খায় ইনজুরি ব্যবস্থা সঠিক না হওয়ায়।’
ক্রীড়াবিদদের অনেকেই জানেন না ব্যথা পেলে কোন চিকিৎসকের কাছে যাবেন। ফলে অনেক সময় ক্রীড়াবিদরা ভুল চিকিৎসার শিকার হওয়ার ঘটনা ঘটে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ক্রীড়ামনস্কতা বৃদ্ধি ছাড়া কোনো বিকল্প দেখছেন না দেবাশীষ, ‘ক্রীড়া সম্পূর্ণ বিজ্ঞান নির্ভর। এটা আমাদের গ্রহণ করতে হবে। আমরা জাতি হিসেবে ক্রীড়াপাগল। খেলাধুলা করছি, আনন্দ পাচ্ছি। কয়েকটি খেলায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শীর্ষে যেতে হলে ক্রীড়ামনস্কতা বাড়াতে হবে। ক্রীড়ামনস্ক সমাজ গড়ে উঠলে পুষ্টি, স্বাস্থ্য, ইনজুরি ব্যবস্থাও একটা সিস্টেমে পড়বে।’ রুম্মন বিন ওয়ালী সাব্বির, জসিমউদ্দিন জোসী সহ আরো অনেক তারকা ক্রীড়াবিদের ক্যারিয়ার আরো একটু দীর্ঘ হতো সেই সময় ইনজুরি ব্যবস্থাপনা উন্নত হলে।
বাংলাদেশ স্পোর্টস মেডিসিন এসোসিয়েশন ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠা হলেও দেশের ক্রীড়াঙ্গনে সেভাবে ভুমিকা রাখতে পারেনি। ইমরান বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের মেডিক্যাল কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান ছাড়াও বাংলাদেশ স্পোর্টস মেডিসিন এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন সম্প্রতি। তিনি ক্রীড়াবিদের জন্য স্পোর্টস মেডিসিন ক্লিনিক করার স্বপ্ন দেখেন, ‘বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য এটি খুবই অপরিহার্য। স্পোর্টস মেডিসিন এসোসিয়েশন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ে এটি করার পরিকল্পনা রয়েছে।’ দেবাশীষ স্পোর্টস মেডিসিন এসোসিয়েশনের সঙ্গে আগে সম্পৃক্ত না থাকলেও ইমরানের কমিটিতে নির্বাহী সদস্য হিসেবে আছেন।
দেশের গন্ডি পেরিয়ে ইমরান এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের এলিট মেডিক্যাল কমিটি, বিশ্ব ব্যাডমিন্টন ফেডারেশন ও আইসিসির ডোপিং কন্ট্রোল অফিসার হিসেবে কাজ করছেন। ক্রীড়া ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজ করা ইমরান বাংলাদেশের স্পোর্টস মেডিসিন এসোসিয়েশনকেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেয়ার স্বপ্ন দেখেন।
এজেড/এটি