মসজিদে নববীর লাইব্রেরিতে যা আছে
জ্ঞান অন্বেষণ বা তলবুল ইলম নিঃসন্দেহে অতি মূল্যবান বিষয়। ইসলাম এই জ্ঞান অন্বেষণের মর্যাদা আরো কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সর্বপ্রথম যে ওহি অবতীর্ণ হলো- তা হচ্ছে, (তরজমা) ‘পড় তোমার প্রভুর নামে’। আর আল্লাহ রাসুল (সা.) বললেন, ‘জ্ঞান অন্বেষণ করা (ইলম তলব করা) সকল মুসলিমের উপর ফরজ।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৪)
ইলম তলব করা বা জ্ঞান অর্জন করা সব স্থান ও সময়ের জন্যই ফজিলতের এবং সমান বৈশিষ্ট্যের। তবে এর মর্যাদা একটু বেড়ে যায় যখন তা হয় মসজিদে নববীর মত পবিত্র ও মহিমান্বিত জায়গায়। আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ ব্যাপারে বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার এই মসজিদে আসবে কোনো ভালো বিষয় শিখতে বা শেখাতে সে আল্লাহর রাস্তার একজন মুজাহিদের সমতুল্য। আর যে এছাড়া অন্য কোনো কাজে আসবে সে ওই ব্যক্তির মতো যে অন্যের সম্পদের দিকে তাকিয়ে থাকে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৭; মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৯৪১৯)
মসজিদে নববীর মাকতাবা বা গ্রন্থাগার সে ধরনেরই একটি জ্ঞানকেন্দ্র। মদিনা মুনাওয়ারার এই মাকতাবা অসংখ্য গ্রন্থাগার ও মাকতাবার মাঝে উল্লেখযোগ্য। এখানে এই ঐতিহাসিক গ্রন্থাগারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিয়ে কিছু আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
মসজিদে নববীর লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা
‘খাযাইনুল কুতুবিল আরাবিয়্যাহ’ গ্রন্থের লেখক উল্লেখ করেন যে, মসজিদে নববীর গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৮৮৬ হিজরির ১৩ রমজানের অগ্নিকাণ্ডের আগে। তাই সেই অগ্নিকাণ্ডে এর অনেক মূল্যবান কিতাব ভষ্মিভূত হয়। যে গ্রন্থাগারে এ সমস্ত নুসখা ছিল সেখানে এছাড়াও অসংখ্য মূল্যবান গ্রন্থ এবং বিশেষ করে অসংখ্য মাখতুতাত বা পান্ডুলিপি ছিল। তবে সেই সংগ্রহশালার জন্য গ্রন্থাগার বা মাকতাবার পরিবর্তে তখন অন্য আরেকটি পরিভাষা ব্যবহার করা হতো আর তা হচ্ছে ‘খিযানাতুল কুতুব’। এবং এর পর থেকে ওলামায়ে কেরামের হাত ধরে স্বাভাবিক ভাবে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। পরবর্তীতে সৌদি শাসনামলে ১৩৫২ হিজরিতে তৎকালীন মদিনার ধর্ম ও ওয়াকফ বিষয়ক দায়িত্বশীল উবায়েদ মাদানির পরামর্শে ‘মাকতাবাতুল মাসজিদিন নববী’ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় এই গ্রন্থাগারের মুদীর বা পরিচালক ছিলেন সাইয়্যেদ আহমাদ খায়্যারি।
তবে আগেই বলেছি, এ গ্রন্থাগার অনেক প্রাচীন। এ কারণে গ্রন্থাগারে এমন অনেক কিতাব রয়েছে যার ওয়াকফের তারিখ বর্তমান নামে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠারও অনেক পূর্বের। যেমন শায়খ মুহাম্মদ আল আজিজ আল-ওয়াজির-এর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার, যা মসজিদে নববীর জন্য ওয়াকফ করা হয়েছে ১৩২০ হিজরি সনে। এছাড়া পবিত্র রওজা শরিফেও অসংখ্য ওয়াকফকৃত কিতাব ও পাণ্ডুলিপি এ গ্রন্থাগারে সংযোজন করা হয়েছে, যার ওয়াকফের তারিখও মাকতাবা প্রতিষ্ঠার অনেক আগের।
গ্রন্থাগারের অবস্থান
গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন স্থানে ছিল এর অবস্থান। ২০১০-এর আগ পর্যন্ত গ্রন্থাগারটি মসজিদে নববীর অভ্যন্তরে বাবে ওমর ও বাবে উসমান সংলগ্ন স্থানে দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। আর সে কারণে সাধারণের মুখে মুখে স্থানের কারণে মাকতাবাতু উমর ও মাকতাবাতু উসমান নামে প্রচলিত ছিল। তবে এর একটি সমস্যা ছিল, কিতাবগুলো দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। অর্থাৎ হাদিস, লুগাহ (ভাষা), তারিখসহ (ইতিহাস) কিছু বিষয় ছিল মাকতাবাতু উমারে আর ফিকহ, আদাবসহ অন্য বিষয়গুলো ছিল মাকতাবাতু উসমানে। এতে করে ছাত্র, শিক্ষক, গবেষকসহ সকলের একটু সমস্যা অনুভব হতো। তাই সকলের সুবিধার দিকে লক্ষ্য করে গ্রন্থাগারকে স্থানান্তর করত পশ্চিম দিকে ১২নং গেট সংলগ্ন ছাদের উপর নিয়ে আসা হয় এবং অত্যাধুনিক ব্যবস্থাপনায় সুশৃঙ্খল ও সুবিন্যস্তভাবে সাজানো হয়।
গ্রন্থাগারের বিভিন্ন বিভাগ
(ক) অধ্যয়নকক্ষ : মসজিদে নববীর গ্রন্থাগারের একটি বিভাগ হচ্ছে পুরুষদের জন্য অধ্যয়নকক্ষ। এটি ছাদের উপর অবস্থিত। এতে রয়েছে ৩৫৮টি অত্যাধুনিক সেলফ, ১০০,০০০ পরিমাণ গ্রন্থ এবং গবেষকদের জন্য তিনশত চেয়ার।
(খ) ডিজিটাল গ্রন্থাগার : এতে রয়েছে বিশেষ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কম্পিউটারে অধ্যয়নের সুব্যবস্থা। রয়েছে পান্ডুলিপিসহ অসংখ্য গ্রন্থের বিপুল সমাহার। আর রয়েছে শ্রুতি লাইব্রেরী। যাতে রয়েছে তেলাওয়াত, দুই হারামের জুমার খুৎবার বিশাল সংগ্রহের সাথে সাথে অসংখ্য আলোচনা, দরস ও নসিহত। আর এই ডিজিটাল লাইব্রেরীটি সকলের ব্যবহার উপযোগী করে অনেক পরিপাটি করে সাজানো হয়েছে।
(গ) নির্দিষ্ট অধ্যয়ন কক্ষ : এতে বিশেষ কিছু কিতাব রয়েছে যা একান্ত প্রয়োজনীয় এবং বিশেষ বিশেষ গবেষক ব্যতিত সকলের জন্য যাওয়ার অনুমতি নেই।
(ঘ) সাময়িকী সংগ্রহশালা : এ বিভাগে রয়েছে প্রায় তিন হাজারেরও বেশি সাময়িকী।
(ঙ) দুর্লভ গ্রন্থ বিভাগ : এতে দুর্লভ কিছু কিতাব ও পান্ডুলিপি রয়েছে।
(চ) নারীদের অধ্যয়নকক্ষ : মহিলাদের জন্য মোট ৫টি অধ্যয়নকক্ষ রয়েছে। তিনটি পূর্ব দিকের মহিলাদের নামাযের স্থানে উসমান বিন আফফান নামক ২৪নং গেট সংলগ্ন এবং দুইটি পশ্চিম দিকের নামাযের স্থান ওমর বিন খাত্তাব নামক ১৬নং গেট সংলগ্ন। এই বিভাগটির উদ্বোধন হয় ১৪১৬ হিজরীর জুমাদাল উলার ১ তারিখে।
বিশেষ সংগ্রহশালা
মসজিদে নববীর অভ্যন্তরে বাবে উসমান সংলগ্ন প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় রয়েছে বিশেষ সংগ্রহশালা। এতে রয়েছে কোরআনে কারীম ও অসংখ্য কিতাবের মূল পান্ডুলিপি। এ সমস্ত পান্ডুলিপি মূল নুসখার পাশাপাশি সাথে মাইক্রোফিল্ম ও ডিজিটাল পদ্ধতিতেও সংরক্ষিত রয়েছে। এ সমস্ত কিছুর ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার জন্য রয়েছে কম্পিউটার ও ফটোকপির আধুনিক যন্ত্রপাতি। রয়েছে পান্ডুলিপি সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। দর্শনার্থীদের দেখানোর উদ্দেশ্যে সাজানো আছে ডিসপ্লে টেবিল। যাতে রয়েছে কিছু চমৎকার পান্ডুলিপি এবং কোরআনে কারিমের হস্তলিখিত অতি চমৎকার ছবি। হজের সময় ছাড়াও বিভিন্ন সময় দর্শনার্থীদের জন্য এই সংগ্রহশালা দেখার সুব্যবস্থা আছে।
অডিও লাইব্রেরি বা শ্রুত গ্রন্থাগার
এটি মূলত মসজিদে নববীর ১৭নং দরজার সাথে অবস্থিত। এতে দুই হারামের ইমাম ও খতীব সাহেবদের তেলাওয়াত এবং খুৎবার বিশাল সংগ্রহ রয়েছে। রয়েছে মসজিদে নববীর সমস্ত মাশায়েখের দরস-তাদরিসের (লেকচার) অডিও ভার্সন। এ সবগুলোই সংরক্ষিত আছে ক্যাসেট সিডিসহ আধুনিক সমস্ত মাধ্যমেই। দর্শনার্থী ও প্রদর্শনার্থীদের মসজিদে নববী কেউ যদি এ সমস্ত কিছু সংগ্রহ করতে চায় তাহলে তা কোনো বিনিময় ছাড়াই হাদিয়ার ব্যবস্থা আছে। তবে কেউ সিডি বা ভিডিওতে পেতে চাইলে অথবা হার্ডডিস্কে নিতে চাইলে তা নিজের পক্ষ থেকে সরবরাহ করতে হবে।
শিল্প ও কারিগরী বিভাগ
গ্রন্থাগারের এ বিভাগটি মূলত বিভিন্ন প্রকারের গ্রন্থ, পান্ডুলিপি ও পত্র পত্রিকার বাধাই, পুনঃবাধাই, মেরামতের কাজ করে থাকে। বাধাইয়ের উপর লেখার জন্য রয়েছে হস্তশিল্পীদের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা। ছাত্র-শিক্ষক এবং গবেষকদের সুবিধার জন্য যেকোনো কিতাব বা পান্ডুলিপির ফটোকপি বা পিডিএফও এই বিভাগ আঞ্জাম দিয়ে থাকে। এ বিভাগের অধীনে যে সমস্ত প্রকল্প রয়েছে তা হচ্ছে : * বিভিন্ন প্রকারের বাধাই প্রকল্প। * কিতাব ও পাণ্ডুলিপির মেরামত ও সংরক্ষণ প্রকল্প। * হস্ত ও মেশিনের মাধ্যমে কিতাবে লিখন প্রকল্প। * ফটোকপি প্রকল্প। এ বিভাগটি মসজিদে নববীর ৯নং গেটে মালিক সাউদ বিন আবদুল আজিজ গেট সংলগ্ন।
ক্যাটালগ ও সরবরাহ বিভাগ
এ বিভাগটিও মসজিদে নববীর ৯নং গেট সংলগ্ন। এখানে ক্যাটালগ বিভাগ মূলত সরবরাহকৃত সমস্ত কিতাবের ক্যাটালগ তৈরীর কাজ করে থাকে। এবং এ সমস্ত কিতাবকে কম্পিউটারাইজড করাসহ আধুনিক বিভিন্ন ব্যবস্থাপনায় পাঠকদের জন্য উপস্থাপনের চেষ্টা করে থাকে।
আর সরবরাহ বিভাগটি গ্রন্থাগারের কিতাব সংগ্রহের কাজ করে থাকে। গ্রন্থাগারের জন্য কিতাব সংগ্রহের পদ্ধতিগুলোর একটি হচ্ছে, তার নিজস্ব কিতাব কেনার বাজেটের মাধ্যমে কিতাব ক্রয় করা। তাছাড়া এমন অনেকেই আছেন যারা তার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার অথবা নিজস্ব সংগৃহীত বই কিংবা পত্র-পত্রিকা মসজিদে নববীর জন্য জীবদ্দশায় অথবা মৃত্যু পরবর্তী সময়ে ওয়াক্ফ করে যান। এই বিভাগটি সেই সমস্ত কিতাব সংগ্রহ করে তা গ্রন্থাগারের অধীনে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।
আবার লেখক গবেষকরাও সরাসরি তাদের রচনা, লিখিত গ্রন্থ মসজিদে নববীর গ্রন্থাগারের জন্য হাদিয়া দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশ থেকেও কয়েকজন আলেম ও গবেষকের আরবী ভাষায় লিখিত গ্রন্থ মসজিদে নববীর গ্রন্থাগারের জন্য সরবরাহ করার ব্যবস্থা করেছি। বিশেষত উস্তাযে মুহতারাম মাওলানা আব্দুল মালেক দামাত বারাকাতুহুম ও মাওলানা হিফজুর রহমান সাহেবের কিছু কিতাব সরবরাহ করেছি। এভাবে আরো গ্রন্থ সরবরাহ করার উদ্যোগ নিয়েছি।
মূলত এটি বিশ্বব্যপী নিজের কিতাবের মাধ্যমে তালিবে ইলমদের ফায়দা পৌঁছানোর একটি বিশাল সুযোগ। কিন্তু কেন যেন এ কাজটি এতদিন হয়ে উঠেনি। তাই ইচ্ছা আছে আল্লাহ কবুল করলে ইনশাআল্লাহ আমাদের দেশীয় আলেম গবেষকদের আরবী ভাষায় লিখিত সমস্ত গ্রন্থ সংগ্রহ করে মসজিদে নববীর এই মোবারক গ্রন্থাগারের জন্য সরবরাহ করা।
সংরক্ষণ ও বিতরণ বিভাগ
প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিতাব ছাড়াও একই কিতাবের অতিরিক্ত কপিগুলো সংরক্ষণের জন্য রয়েছে বিশেষ সংরক্ষণ বিভাগ। আবার এই বিভাগের অধীনেই বিশ্বব্যাপী মসজিদ-মাদরাসা ও ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য কিতাব ও কোরআনে কারিম বিতরণের সুব্যবস্থা রয়েছে।
কম্পিউটার বিভাগ
ক্যাটালগ তৈরীর পর কিতাব ও পান্ডুলিপির পরিচিতিকার্ড করে থাকে এই বিভাগ। এবং সাথে সাথে স্ক্যানার-এর মাধ্যমে কিতাব, পান্ডুলিপি ও পত্র-পত্রিকাকে কম্পিউটারে স্থানান্তর করা হয়। যাতে করে পাঠক খুব সহজেই এ থেকে উপকৃত হতে পারে। এছাড়াও রেকর্ডকৃত সমস্ত তেলাওয়াত, খুৎবা, দরস ও আযান এ বিভাগের মাধ্যমে কম্পিউটারে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
অনুবাদ ও গবেষণা বিভাগ
এর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ও আধুনিক প্রসঙ্গের বিভিন্ন মাসআলার গবেষণা কার্য পরিচালনা করা হয়। অন্যান্য ভাষা থেকে প্রয়োজন অনুসারে আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। এ বিভাগ ওয়াকফ ও হাদিয়াকৃত কিতাবের যাচাই-বাছাইয়ের পর গ্রন্থাগারে রাখার অনুমতি প্রদান করে থাকে। এছাড়াও মসজিদে নববীর গ্রন্থাগারের আরো অনেক বিভাগ ও কার্যক্রম রয়েছে। প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে।
মহিউদ্দীন ফারুকী।। বিশিষ্ট আলেম ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, মারকাযুল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ, বাংলাদেশ।