বাইডেনের প্রশাসনে ৮ মুসলিম
শত জল্পনা-কল্পনা ছিল। কিন্তু সবকিছুর অবসান ঘটিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে পথচলা শুরু হয়েছে জো বাইডেনের। তিনি এখন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট। ২০ জানুয়ারি বাইডেন ও তার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিসের অভিষেক হয়েছে।
ক্ষমতায় আসার আগেই জো বাইডেন ঘোষণা দিয়েছিলেন— প্রশাসনে বৈচিত্র্য আনতে বৈষম্য কমাবেন। নির্বাচনে জিতে তিনি সেই কথা রাখার চেষ্টা করেছেন। যোগ্যতার ভিত্তিতে মুসলিম, কৃষ্ণাঙ্গ ও বিভিন্ন জাতিসত্তার সংখ্যালঘুদের প্রশাসনে স্থান দিয়েছেন তিনি।
বাইডেনের মন্ত্রিসভা মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তার ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস অর্ধ কৃষ্ণাঙ্গ ও অর্ধ ভারতীয়। তাকে নির্বাচনের মাধ্যমে বাইডেন ইতিমধ্যে ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রমাণ দিয়েছেন।
টিআরটি ওয়ার্ল্ডের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, নতুন এই মন্ত্রিসভা ইতিহাসের অন্য কোনো মন্ত্রিসভার তুলনায় আমেরিকান জনগণের বেশি প্রতিনিধিত্ব করবে। এর আগে বাইডেন গেল ডিসেম্বরে সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমান পর্যন্ত তিনি ‘নজিরবিহীন মনোনয়ন’ তুলে ধরেছেন।
বাইডেনের প্রশাসনে যেসব মুসলিম নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের নিয়ে আমাদের সংক্ষিপ্ত আয়োজন—
ডিজিটাল টিমের প্রধান আয়েশা শাহ
গেল ২৮ ডিসেম্বর হোয়াইট হাউসের ডিজিটাল স্ট্র্যাটেজি টিমের সদস্যদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। দলটির প্রধান হিসেবে রয়েছেন, ভারতীয় বংশোদ্ভূত আয়েশা শাহ। তার অধীনে কাজ করবে ডিজিটাল স্ট্র্যাটেজি ডিরেক্টর রব ফ্লেহার্টি।
আয়েশার জন্ম কাশ্মীরে। তার রাজনৈতিক উত্থান লুসিয়ানা থেকে। মার্কিন নির্বাচনে তিনি বাইডেন ও কমলা হ্যারিসের ডিজিটাল টিমের গুরুদায়িত্বে ছিলেন। নিয়োগের আগে তিনি স্মিথসোনিয়ার ইনস্টিটিউশনের অ্যাডভান্সমেন্ট স্পেশালিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন। এর আগে জন এফ কেনেডি সেন্টার ফর পারফর্মিং আর্টসের কর্পোরেট ফান্ডে সরকারি ব্যবস্থাপক ছিলেন। পাশাপাশি আয়েশা ‘বুয়’ নামের একটি সংস্থার কৌশলগত যোগাযোগের বিষয়টিও দেখা শোনা করতেন।
হিন্দুস্তান টাইমস জানিয়েছে, নির্বাচন পর্বে তিনি বাইডেন-হ্যারিসের ডিজিটাল স্ট্র্যাটেজি টিমে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। কমলা হ্যারিসের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ আয়েশা শাহ।
আর্থিক পরামর্শক টিমের উপ-পরিচালক সামিরা
হোয়াইট হাউসে জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল বা ‘ন্যাশনাল ইকোনমিক কাউন্সিল’ (এনইসি)-এর উপ-পরিচালক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন কাশ্মীরি বংশোদ্ভূত সামিরা ফাজিলি। করোনাভাইরাসের আঘাতে বিপর্যস্ত মার্কিন অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন বিষয়ক দিকনির্দেশা দেবে এনইসি।
এর আগে সামিরা ফেডেরাল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ আটলান্টার সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক ছিলেন। এছাড়াও বারাক ওবামার সময়কালে হোয়াইট হাউসের আর্থিক নীতিনির্ধারক পরিষদের পরামর্শদাতা হিসেবেও কাজ করেছেন। সেই সময় এনইসি ও ট্রেজারি বিভাগের সিনিয়র অ্যাডভাইজর পদেও কাজ করেছেন ফাজিলি। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারির দাপ্তরিক নীতিনির্ধারক দলে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
তিন সন্তানের জননী ফাজিলি ক্ষুদ্র ঋণ, আবাসন ঋণ এবং গ্রাহক সম্পর্কিত বিষয়ের বিশেষজ্ঞ। তার জন্ম নিউইয়র্কের উইলিয়ামসভিলে। পড়াশোনা করেছেন হার্ভার্ড কলেজ ও ইয়েল ল’স্কুলে। পরবর্তীতে শিক্ষক হিসেবে ইয়েল ল’স্কুলে কর্মজীবন শুরু করেন।
সিনিয়র উপদেষ্টা বাংলাদেশি জায়ান সিদ্দিক
হোয়াইট হাউসের ডেপুটি চিফ অব স্টাফের সিনিয়র উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বাংলাদেশি-আমেরিকান জায়ান সিদ্দিক। বাইডেন প্রশাসনে প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হিসেবে ঊর্ধ্বতন কোনো পদে দায়িত্ব পেলেন জায়ান সিদ্দিক। তিনি বাইডেনের ডোমেস্টিক ও ইকোনমিক টিমেও কাজ করবেন।
জায়ান সিদ্দিক বর্তমানে তিনি বাইডেন-হ্যারিস ট্রানজিশনের ঘরোয়া এবং অর্থনৈতিক দলের প্রধান কর্মী হিসাবে রয়েছেন। তিনি এর আগেও বাইডেন-কমলার সঙ্গে কাজ করেছেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলার ডিবেটের প্রস্তুতি দলের সদস্যও ছিলেন তিনি। তারও আগে বেটো ও’রউর্কের প্রেসিডেনসিয়াল ক্যাম্পেইনের সিনেট ক্যাম্পেইন টিমের সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার হিসেবে কাজ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের ল ক্লার্ক হিসেবেও কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তার।
এছাড়া মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এলেনা কাগান, ডিসি সার্কিটের আপিল আদালতের বিচারক ডেভিড ট্যাটেল ও ডিসট্রিক্ট কোর্ট ফর দ্য সেন্ট্রাল ডিস্ট্রিক্ট অব ক্যালিফোর্নিয়ার বিচারক ডিন প্রেগেরসনের অধীনে ল’ ক্লার্ক হিসেবে কাজ করেছেন জায়ান সিদ্দিক।
এর পাশাপাশি ওরিক হেরিংটন অ্যান্ড সাটক্লিফ এলএলপির একজন অ্যাসোসিয়েট হিসেবে আইন পেশার চর্চাও চালিয়ে গেছেন তিনি।
জানা গেছে, জায়ান সিদ্দিকের জন্ম বাংলাদেশে। ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলায় তার পৈতৃক বাড়ি। তবে বেড়ে ওঠা নিউইয়র্কে। তিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি এবং ইয়েল ল’ স্কুল থেকে স্নাতক করেছেন।
মানবাধিকারবিষয়ক উপরাষ্ট্র সচিব উজরা জিয়া
ভারতীয়-আমেরিকান কূটনীতিক উজরা জিয়া। বাইডেন ঘোষিত পররাষ্ট্র দফতরের মূল মনোনয়ন অনুসারে তাকে নাগরিক সুরক্ষা, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক উপরাষ্ট্র সচিব মনোনীত করা হয়েছে।
উজরা জিয়া সম্প্রতি সিইও এবং পিস বিল্ডিংয়ের জন্য জোটের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি নিকট পূর্ব, দক্ষিণ এশীয়, ইউরোপীয়, মানবাধিকার এবং বহুপক্ষীয় বিষয়ে দুই দশকের বেশি সময় ধরে কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন।
২০১৪ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত প্যারিসের মার্কিন দূতাবাসে চার্জডেফায়ার্স এবং মিশনের ডেপুটি চিফ অফ মিশন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও তিনি দূতাবাসের প্রতিদিনের কাজ, ছয়টি নির্বাচনী পদ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী কাজে নিযুক্ত ৫০টি অফিস এবং এজেন্সি পর্যবেক্ষণ করেছেন। ২০১৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতিমালার বিরোধিতা করে বিদেশি চাকরি ছেড়ে দেন।
উপ-জাতীয় জলবায়ু উপদেষ্টা আলী আ. জায়েদি
পাকিস্তান-বংশোদ্ভূত আমেরিকান মুসলিম আলী জায়েদী। তাকে বাইডেন-হ্যারিসের মন্ত্রিসভায় প্রশাসন হোয়াইট হাউসের উপ-জাতীয় জলবায়ু উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
জায়েদি বর্তমানে নিউইয়র্ক গভর্নরের অ্যান্ড্রু কুওমো ফর এনার্জি অ্যান্ড এন্ভায়রনমেন্ট’র উপসচিব। এছাড়াও রাজ্যের জলবায়ু নীতি ও অর্থ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।
জাতীয় সুরক্ষা কাউন্সিলে সালমান আহমেদ
ওবামা জাতীয় সুরক্ষা কাউন্সিলের কৌশলগত পরিকল্পনার প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী সালমান আহমেদ। তিনি নতুন সরকারের নীতি পরিকল্পনার পরিচালক হিসেবে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে যোগ দিচ্ছেন।
লেগিসলেটিভ অ্যাফেয়ার্সে রিমা ডোডিন
আইনসভা বিষয়ক হোয়াইট হাউস অফিসের লেগিসলেটিভ অ্যাফেয়ার্সের উপ-পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। মার্কিন প্রশাসনে প্রথম আরব-আমেরিকানও তিনি।
নরসিংদীর মেয়ে ফারাহ
বাইডেন প্রশাসনে সর্বশেষ মুসলিম হিসেবে যোগ হয়েছে ফারাহ আহমেদের নাম। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই নারী যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন পল্লী উন্নয়ন সচিবালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হয়েছেন। গত ২১ জানুয়ারি তাকে এ নিয়োগ দেওয়া হয়।
ওয়াইওর একটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ড. মতলুব আহমেদ ও ফেরদৌস আহমেদ দম্পতির মেয়ে ফারাহ। তার দাদার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। নানার বাড়ি নরসিংদীতে।
ফারাহ কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক শেষ করেন। এরপর প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর হন। কনজ্যুমার এডুকেশনের সিনিয়র প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর এবং কনজ্যুমার ফিন্যান্সিয়াল প্রটেকশন ব্যুরো চিফ অপারেটিং অফিসারের সিনিয়র অ্যাডভাইজার হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি।