কোরআন লিখে আলোড়ন তৈরি করলেন ১৯ বছরের তরুণী
ফাতিমা সাহাবা। উনিশ বছর বয়সী এক লাজুক তরুণী। মাত্র ১৪ মাসের মধ্যে কোরআনের একটি কপি তৈরি করেছেন। এতে তিনি সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমে কোরআন লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে ফাতিমা মোট ৬০৪টি পাতা খরচ করেন। তার এই কীর্তিতে আপনজনেরা যারপরনাই খুশি। শুধু আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবই না, অপরিচিতজন ও দূরের মানুষজনও তার এই সাফল্যের কথা শুনে অভিনন্দন জানিয়েছে।
কোরআনলিপি নিয়ে ফাতিমার আদ্যোপান্ত কথকতা
আন্তর্জাতিক এক সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ফাতিমা এই প্রসঙ্গে বলেন, ক্যালিগ্রাফি ব্যবহার করে আমার প্রিয় কোরআনের কপি তৈরি করতে আমার অনেক শখ ছিল।
গত বছর কোরআনের একটি পারা আমি লিপিবদ্ধ করেছিলাম। আমার বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধবদের দেখাই। সেটি দেখে তারা খুবই খুশি হয়েছিল। আমি তাদের বলেছিলাম ক্যালিগ্রাফি ব্যবহার করে আমি পুরো কোরআনলিপি করতে চাই।
মনে আকণ্ঠ ইচ্ছে ও প্রত্যাশা থাকলেও খানিকটা ভাবনা চেপে বসেছিল। ফাতিমা সেই বিষয়ে বলেন, ‘আমার পরিবার আমাকে খুব উৎসাহ দিয়ে গেছে সব সময়। তবে এটাও বলেছিল যে, দীর্ঘ সূত্রের এই কাজ অতটা সহজ হবে না।’
শুরুর দিনগুলো যেমন ছিল
কোরআন শরিফ এবং পবিত্র কোরআনের আয়াতগুলো তাকে বরাবরই মুগ্ধ করতো। তাই সেরা ক্যালিগ্রাফ লিপি দিয়ে ফাতিমা কোরআন নকল করতে মনোবাসনা পোষণ করতেন।
ফাতিমা বলেন, প্রথম দিকে একটা বা দুইটি আয়াত দেখে দেখে লিখতাম। আর আমার মা-বাবা খুব প্রশংসা করতেন। আয়াতগুলো ফ্রেমে বাঁধিয়ে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখতাম।
কিছুদিন পর দেখা গেল যে, আমার পরিচিতজনেরা সেসব ফ্রেম কিনে নিচ্ছেন। এতে করে আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে। আমিও যে কিছু একটা করতে পারি, কিছু একটা আমার জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আমি এটা বিশ্বাস করতে শুরু করি। আর পাশাপাশি আমি মনের আনন্দে তাদের জন্য আরও বেশি করে আঁকতে শুরু করি।
লিপিবিদ্যা ও ক্যালিগ্রাফির প্রতি জোঁক
ফাতিমা তখন ক্লাস নাইনে। ওই সময়ে লিপিবিদ্যা বা ক্যালিগ্রাফির দিকে মনোযোগী হয়ে ওঠেন। তখন থেকে প্রায় প্রতি দিনই ভালবাসার টানে তিনি ক্যালিগ্রাফিতে হাত পাকা করতে থাকেন।
দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে ফাতিমা বলেন, স্কুল থেকে বাসায় ফিরে একটু রেস্ট নিয়েই আঁকাআঁকির কাজ শুরু করতাম। কাজ করতে ভীষণ ভালো লাগত।
ফাতিমার বেড়ে ওঠা ও অন্যান্য
ফাতিমার জন্ম দক্ষিণ ভারতে। কেরালা রাজ্যের কান্নুর জেলায়। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকা এবং ক্যালিগ্রাফির প্রতি ছিল তার বিশেষ ঝোঁক। প্রায়ই তিনি ছবি এঁকে মা-বাবাকে দেখাতেন। তারাও তাকে উৎসাহ দিতেন। তাছাড়া ঘরোয়াভাবে ব্যাডমিন্টন খেলতে পছন্দ করেন ফাতিমা।
ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়ার সময় ফাতিমা সাহাবা তার পরিবারের সাথে ওমানে থাকতেন। ছোট, ছোট ভাই আর মা-বাবা নিয়েই তার পরিবার।
এক সময়ে তার পরিবার ভারতে ফিরে আসে। কান্নুর জেলার কোডাপারমবা শহরে তাদের বাস। এখন কান্নুরের কলেজেই তিনি ইন্টিরিয়ার ডিজাইন পড়ছেন।
যেভাবে শুরু করেন কোরআনে লেখার কাজ
কোরআনের ক্যালিগ্রাফির কাজে হাত দেয়ার আগে ফাতিমা সাহাবার বাবা একজন মওলানার সাথে কথা বলেন। তিনি জানতে চান, ফাতিমা কোরআন নকল করতে পারেন কিনা? এনিয়ে কোনো ধর্মীয় বিধিনিষেধ আছে কিনা? পরে মাওলানার কাছ থেকে উত্তর পেয়ে ফাতিমাকে অনুমতি দেওয়া হয়।
এই প্রসঙ্গে ফাতিমা বলেন, আমি বাবাকে বললাম আমাকে কালো বল পয়েন্ট কলম আর ছবি আঁকার কাগজ কিনে দিতে। কাছের একটি দোকান থেকে বাবা সব জোগাড় করলেন।
প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে আমি একটু বিশ্রাম নিতাম। তারপর মাগরিবের নামাজ পড়ে আমি কোরআন নকলের কাজে হাত দিতাম।
গত বছর অগাস্ট মাসে আমি ক্যালিগ্রাফির কাজ শুরু করি। আর গেল সেপ্টেম্বরে আমি কোরআনলিপির কাজটুকু শেষ করি।
আমার ছোট বোন ও ভাই রয়েছে। আমি ভাবতাম ক্যালিগ্রাফ তৈরি করার সময় তারা হয়তো আমাকে জ্বালাতন করবে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম- তারা জ্বালাতন তো করেই না; বরং নানাভাবে আমাকে সাহায্য সহযোগিতা করে।
বড় কাজ যেভাবে সহজ করেছেন
ফাতিমা জানতেন কাজটি অনেক বড়। তাই তিনি যেনতেনভাবে শেষ করতে চাননি। তিনি বলেন, আমার ভয় ছিল যে আমি হয়তো কোরআন নকলের কাজে কোনো একটা ভুল করে ফেলব। ছবি আঁকার সময় আমার মা তাই আমার পাশে বসে থাকতেন, এবং কোথাও কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখলে সেটা ধরিয়ে দিতেন।
কোনো ধরনের ভুল না হওয়ার জন্য ফাতিমা প্রথমে পেন্সিল দিয়ে ক্যালিগ্রাফের নকশা তৈরি করতেন। তিনি বলেন, যখন আমি সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হতাম যে কোথাও কোনো ভুল নেই। তারপর আমি কলম দিয়ে নকশাগুলোকে পাকা করতাম। আমার শুধু মনে হতো এত বড় এবং কঠিন একটা কাজ কি আমি শেষ করতে পারবো? আমার নিজের ক্ষমতা নিয়েও মাঝে মধ্যে সন্দেহ তৈরি হতো।
কিন্তু দেখা গেল প্রতিদিন কাজটা করতে গিয়ে আমি বেশ আনন্দই পাচ্ছি। ঘণ্টা পর ঘণ্টা সময় যে কীভাবে কেটে যেত তা টেরই পেতাম না। শুরুর দিকে কাজগুলো ভালোই ছিল। কিন্তু পরের দিকে কাজ আরও করতে করতে হাতের কাজ আরও সুন্দর ও ভালো হতে থাকে।
অন্যদিকে কোরআনলিপির ব্যাপারটি প্রথমদিকে আমি শুধু আমার মা-বাবা আর কাছের মানুষদেরই বলেছি। কাজ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত অন্য কাউকে একথা জানাতে চাইনি।
মেয়ের কীর্তি নিয়ে গর্বিত বাবা-মা
ফাতিমার বাবা-মা মেয়েকে নিয়ে খুবই গর্ব অনুভব করেন। মেয়ের এই সাফল্যে তাদের খুব গর্ব হয়। মা নাদিয় রউফ বলেন, আল্লাহর রহমতে ফাতিমা তার সব কাজ শেষ করতে পেরেছে। আমরা সবাই খুবই গর্বিত তার জন্য। সে খুবই পরিশ্রমী একটি মেয়ে। সে প্রতিটি কাজ খুব মন ও আন্তরিকতা দিয়ে করে।
ফাতিমার বাবা আব্দুর রউফ বলেন, আল্লাহর কাছে হাজার শোকর যে, এরকম একটি মিষ্টি আর ধর্মভীরু একটি মেয়ে তিনি আমাদের দিয়েছেন।
ফাতিমার স্বপ্ন এখন যেমন
ফাতিমা সাহাবা বলছেন, আঁকতে আর সুন্দর করে বাসা সাজাতে তার খুবই ভালো লাগে। আর আমি ক্যালিগ্রাফির শিক্ষক হতে চাই।
ফাতিমা এখন তার শিক্ষা আর ক্যালিগ্রাফিতেই বেশি সময় ব্যয় করেন। পাশাপাশি বান্ধবীদেরও সময় দেন। তাদের সাথে নানা রকম মজা করেন। তিনি বলেন, এমনিতে আমি একটু লাজুক ধরনের। কিন্তু এখন আমাকে নিয়ে যেসব কথাবার্তা হয়- তা আমার ভালোই লাগে। মনে হয় আমার পরিশ্রমের মূল্যটা হাতে হাতে পাচ্ছি। আমার সম্পর্কে মানুষ ভালো ভালো কথা বললে- কার ভালো না লাগে বলুন?