যেসব আমলের সওয়াব মৃত্যুর পরও পাওয়া যায়
দুনিয়ার জীবনে মানুষ যা আমল করবে, তার প্রতিদান আখেরাতে পাবে। মৃত্যুর পর মানুষের আর আমলের কোনো ক্ষমতা থাকে না, সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে এমন কিছু আমল রয়েছে, যেগুলো দুনিয়ার জীবনে করলে মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তি কবরে ওইসব আমলের সওয়াব পেতে থাকবেন।
এ বিষয়ে কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘আমিই তো মৃতকে জীবিত করি, আর লিখে রাখি যা তারা অগ্রে (পরকালের জন্য) প্রেরণ করে এবং যা পেছনে (দুনিয়ায়) রেখে যায়। আর প্রতিটি বস্তুকেই আমি সুস্পষ্ট কিতাবে সংরক্ষণ করে রেখেছি।’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত : ১২)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে ৩টি আমল বন্ধ হয় না ১. সদকায়ে জারিয়া, ২. এমন ইলম যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় ও ৩. এমন নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৩১০)
যেসব আমলের সওয়াব মৃত্যুর পরও অব্যাহত থাকবে, সেগুলোকে সদাকায়ে জারিয়া বলা হয়। এখানে এগারটি আমলের উল্লেখ করা হলো-
এক. ইলম শিক্ষা দেওয়া
এমন ইলম শিক্ষা দেওয়া যা মানুষের জন্য উপকারী এবং কল্যাণকর। যে ইলম মানুষকে হেদায়েতের দিকে নিয়ে যায়। মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয় এবং জান্নাতের পথে চলতে নির্দেশ করে। এ ধরনের ইলম শিক্ষা দেওয়ার কারণে মৃত ব্যক্তি কবরে এর সওয়াব পাবেন। কোরআন, হাদিস, তাওহিদ, রেসালাত, আখেরাত, হালাল-হারাম, আকিদা, মাসয়ালা-মাসায়েল শিক্ষা দেওয়া, মানুষের কল্যাণে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞান শিক্ষা দেওয়া এবং দুনিয়া পরিচালনাবিষয়ক বিভিন্ন বিষয় শিক্ষা দেওয়া এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এ বিষয়ে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে মানুষকে কোনো ইলম শিক্ষা দেবে, সে ওই ইলম অনুযায়ী আমলকারীর সমতুল্য প্রতিদান পাবে; অথচ আমলকারীর প্রতিদানে কোনো কমতি হবে না।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৪০)
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে আল্লাহর কিতাব থেকে একটি আয়াত শিক্ষা দেবে, যত তেলাওয়াত হবে তার সওয়াব সে পাবে।’ (সহিহ কুনুজুস সুন্নাহ আননবুবিয়্যা : ০৭)
দুই. নেক সন্তান রেখে যাওয়া
নেক সন্তান বলতে ইমানদার সন্তান রেখে যাওয়া। যারা মা-বাবা বেঁচে থাকা অবস্থায় তাদের যেমন অনুগত ছিল, তাদের মৃত্যুর পরও তারা মা-বাবার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করবে। হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মানুষের মৃত্যুর পর ৪টি আমলের সওয়াব অব্যাহত থাকে ১. যে ইসলামি রাষ্ট্রের সীমান্ত পাহারা দিল তার সওয়াব, ২. ভালো কাজ চালুর ফলে তাকে যারা অনুসরণ করল তার সওয়াব, ৩. যে ব্যক্তি এমন সদকা করল, যা প্রবহমান থাকে তার সওয়াব ও ৪. এমন নেক সন্তান রেখে যাওয়া, যে তার জন্য দোয়া করে।’ (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস : ২২২৪৭)
এ বিষয়ে হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর পর কোনো বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়। তখন সে বলে, হে আমার রব, এ পুরস্কার কোন আমলের বিনিময়ে? (আমি তো এত আমল করিনি) তখন বলা হবে, তোমার সন্তান তোমার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেছে।’ (আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৩৬)
তিন. মসজিদ নির্মাণ
মুসলিম জাতির প্রাণকেন্দ্র হলো মসজিদ। কোরআনে কারিমে মসজিদকে হেদায়েতের কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মসজিদে নামাজ আদায়ের ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে সবার জন্য কোরআন শিক্ষা কার্যক্রম, দ্বীনিবিষয়ক শিক্ষাদান ও কল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। সেজন্য যে ব্যক্তি আল্লাহর ঘর নির্মাণ করবে এবং তাতে যারা নামাজ আদায় করবে তার সওয়াব তিনিও পেতে থাকবেন। হজরত উসমান (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য মসজিদ তৈরি করল, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে অনুরূপ ঘর তৈরি করবেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১২১৮)
এ বিষয়ে হাদিসে আরও বলা হয়েছে, আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রত্যেক বসতি এলাকায় মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন’, তিনি আরও নির্দেশ দিয়েছেন, ‘মসজিদকে যেন পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র রাখা হয়।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৫৫)
চার. অভাবগ্রস্তদের ঘর দেওয়া
একজন মানুষের বসবাসের জন্য ছোট হলেও ঘরবাড়ি অতীব প্রয়োজন। যে ব্যক্তি কোনো মানুষের জন্য ঘর তৈরি করে দেবে তার সওয়াব মৃত্যুর পরও সে কবরে পেতে থাকবে। এ বিষয়ে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুমিন মৃত্যুবরণের পর তার সঙ্গে যে আমলের সওয়াব সম্পৃক্ত থাকবে, তা হলো ইলম শিক্ষা দেওয়া ও কিতাব রচনা করা, নেক সন্তান রেখে যাওয়া, মসজিদ তৈরি করা, অভাবগ্রস্তদের জন্য ঘর তৈরি করে দেওয়া, পানি প্রবাহিত হওয়ার ব্যবস্থা করা এবং তার সম্পদ থেকে সদকা করা।’ (সহিহ ইবনে খুজাইমা, হাদিস : ২৪৯)
পাঁচ. খাওয়ার পানির ব্যবস্থা
পানি মানুষের জীবনের অতীব প্রয়োজনীয়। সেজন্য খাওয়ার পানির ব্যবস্থা করা বিরাট সওয়াবের কাজ। এ বিষয়ে হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এক লোক রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, তার পানির খুব পিপাসা পেল, পথিমধ্যে সে একটি কূপ পেল এবং সেখান থেকে পানি পান করল। অতঃপর দেখতে পেল একটি কুকুর পানির পিপাসায় ময়লা খাচ্ছে, সেখানে সে মোজা দিয়ে পানি ভরে কুকুরকে পানি পান করাল এবং আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করল। এজন্য আল্লাহতায়ালা তাকে মাফ করে দিলেন। সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! প্রাণীকে পানি পান করালেও কি সওয়াব আছে? হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, প্রত্যেক সজীব অন্তরকে পানি পান করানোর জন্য সওয়াব রয়েছে।’ (সহিহ বোখারি, হাদিস : ৬০০৯)
ছয়. প্রবাহিত পানির ব্যবস্থা
ফল-ফসল উৎপাদনের জন্য প্রবাহিত পানির ব্যবস্থা থাকা খুবই জরুরি। সেচব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষিজমি আবাদযোগ্য করা যায় এবং ফসল ভালোভাবে উৎপাদন সম্ভব হয়। আর প্রতিটি জীবনে রয়েছে পানির ব্যবহার। সেজন্য এটি একটি এমন সওয়াবের কাজ, যা ব্যক্তির মৃত্যুর পরও জারি থাকবে। হজরত উসমান (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে পানির ঝরনা খনন করল, তার জন্য জান্নাত রয়েছে।’ (সহিহ বোখারি, হাদিস : ২৭৭৮)
সাত. আল্লাহর পথে দাওয়াত
মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা উত্তম কাজ। এজন্য মানুষকে দ্বীনের পথে আসার জন্য আলোচনা করা, কোরআন-হাদিস শিক্ষার ব্যবস্থা করা, দ্বীনি বইপত্র বিতরণ, কোরআন বিতরণ ইত্যাদি কাজ বেশি বেশি করা। আর এর সওয়াব কেয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে। কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘ওই ব্যক্তির চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে, যে আল্লাহর দিকে ডাকল, নেক আমল করল এবং ঘোষণা করল আমি একজন মুসলমান।’ (সুরা হামিম সাজদা, হাদিস : ৩৩)
আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেওয়ার ফজিলত প্রসঙ্গে নবী করিম (সা.) হজরত আলী (রা.)-কে বলেন, ‘তোমার মাধ্যমে একজনও যদি হেদায়েতপ্রাপ্ত হয়, তবে তা হবে তোমার জন্য লালবর্ণের অতি মূল্যবান উট থেকেও উত্তম।’ (সহিহ বোখারি, হাদিস : ২৯৪২)
হাদিসে আরও বলা হয়েছে, ‘যে মানুষকে হেদায়েতের দিকে আহ্বান করবে, এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ সওয়াব তার আমলনামায় যুক্ত হতে থাকবে। অথচ তাদের সওয়াব থেকে কোনো কমতি হবে না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬৯৮০)
আট. কিতাব রচনা
এমন কিতাব রচনা করা, যার মাধ্যমে কল্যাণ হয়। মানুষ সত্যিকার পথের সন্ধান পায়। কিতাব পড়ে দ্বীনের অনেক প্রচারক তৈরি হবে, ইলম অর্জনের জন্য সহায়ক হবে। যিনি এ ধরনের কিতাব রচনা করবেন, তিনি মৃত্যুর পরও এর সওয়াব পেতে থাকবেন। হাদিসে এসেছে, ‘ভালো কাজের পথ প্রদর্শনকারী এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ সওয়াব পাবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৬৭০)
নয়. কোরআনুল কারিম বিতরণ
মানুষের মধ্যে কোরআন বিতরণ যেমন সওয়াবের কাজ, তেমনি মসজিদ, মাদ্রাসা বা কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য কোরআন ওয়াকফ করাও সওয়াবের কাজ। এসব কোরআন যারা তেলাওয়াত করবে বিতরণকারী সওয়াবের অধিকারী হবে, তবে তেলাওয়াতকারীর সওয়াবের অংশ কমবে না। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মানুষ মৃত্যুবরণের পর কবরে ৭টি আমলের সওয়াব অব্যাহত থাকে। ১. যে ইলম শিক্ষা দিল, ২. যে পানি প্রবাহিত করল, ৩. কূপ খনন করল, ৪. খেজুরগাছ লাগাল (গাছ রোপণ), ৫. মসজিদ তৈরি করল, ৬. কাউকে মুসহাফ (কোরআনের কপি) বিতরণ করল ও ৭. এমন নেক সন্তান রেখে গেল, যে তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করবে।’ (মুসনাদে বাজ্জার, হাদিস : ৭২৮৯)
দশ. গাছ রোপণ
গাছ আমাদের বন্ধু। গাছ যেমন বিভিন্ন ফল-মূল দিয়ে থাকে, তেমনি পরিবেশকে ভালো রাখে। হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলিম যদি কোনো বৃক্ষরোপণ করে, আর তা থেকে কোনো ফল ব্যক্তি খায় তবে সেটি তার জন্য সদকা, কোনো হিংস প্রাণী খেলেও তা তার জন্য সদকা, যদি কেউ চুরি করে খায় তাও তার জন্য সদকা, কোনো পাখিও খায় তাও তার জন্য সেটি সদকা। এমনকি যদি কেউ তা কেটে ফেলে তাও সেটি তার জন্য সদকা।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪০৫০)
এগার. সীমান্ত রক্ষা
ইসলামি রাষ্ট্রের সীমান্ত পাহারা দেওয়া অর্থাৎ মানুষকে নিরাপদ ও শান্তিতে রাখার জন্য শত্রুর হাত থেকে ইসলামি রাষ্ট্র পাহারা দেওয়ার সওয়াব ব্যক্তির মৃত্যুর পরও জারি থাকবে। এ বিষয়ে হাদিসে উল্লেখ আছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলামি রাষ্ট্রের সীমান্ত পাহারা অবস্থায় মারা যায়, তাহলে যে কাজ সে করে যাচ্ছিল মরার পরও তা তার জন্য সওয়াব জারি থাকবে, তার রিজিকও জারি থাকবে, কবরের পরীক্ষা থেকে সে থাকবে নিরাপদ এবং আল্লাহতায়ালা কেয়ামতে তাকে ভয় থেকে মুক্ত অবস্থায় ওঠাবেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৩৪)
অন্য হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মৃত্যুর পর প্রত্যেক মৃতের কর্মের ধারা শেষ করে দেওয়া হয়। তবে যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য ইসলামি রাষ্ট্রের সীমান্ত পাহারা দেয় তার আমল কেয়ামত পর্যন্ত বাড়তে থাকবে এবং কবরের ফেতনা থেকেও সে নিরাপদ থাকবে।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৪৬২৪)