বদনজর থেকে বাঁচার আমল
মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি নানা রকম হয়ে থাকে। কেউ ভালো নজরে দেখে, আর কেউ হিংসাত্মক দৃষ্টিতে তাকায়। অনেক সময় দেখা যায়, ভালো কোনো জিনিসের প্রতি মানুষের বদনজর লেগে যায়। খারাপ নজর লাগলে— নজরকৃত ব্যক্তি বা জিনিস ক্ষতি ও অনিষ্টের সম্মুখীন হয়।
বদনজরকে কুদৃষ্টি বা অশুভ দৃষ্টিও বলা হয়। বদ নজরের এই প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া নিতান্ত সত্য। ইমাম কুরতুবি (রহ.) লিখেছেন, আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের শীর্ষস্থানীয় আলেমরা এ বিষয়ে একমত যে ‘চোখ লাগা’ এবং এর মাধ্যমে ক্ষতিসাধিত হওয়া প্রমাণিত সত্য।
তাই কারও ক্ষেত্রে বদনজর বা কুদৃষ্টি লেগে গেলে, এই বিশ্বাস রাখতে হবে— এই দৃষ্টিশক্তির মধ্যে এমন ক্ষমতা (খারাপ) মহান আল্লাহই দান করেছেন। তাই মানুষের উচিত আল্লাহর ওপর ভরসা করা, তার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা।
কোরআন-হাদিসে বদনজরের বিষয়
পবিত্র কোরআনেও কয়েক জায়গায় বদ নজরের প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কাফেররা যখন উপদেশবাণী শোনে তখন তারা যেন তাদের দৃষ্টি দ্বারা তোমাকে আছড়ে ফেলবে, আর তারা বলে, এ তো এক পাগল’। (সুরা কলম, আয়াত : ৫১)
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা বদ নজরের প্রভাব থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা কর। কেননা নজরের প্রভাব সত্য।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৫০৮)
আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) এই আয়াতের তাফসিরে বলেছেন, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, আয়াতে ‘তাদের দৃষ্টি দ্বারা তোমাকে আছড়ে ফেলবে’ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘তোমার প্রতি বদ নজর দেবে।’ অর্থাৎ তারা তোমাকে হিংসার প্রতিফলন ঘটিয়ে রোগী বানিয়ে দেবে, যদি আল্লাহর তোমার প্রতি হেফাজত না থাকে। আয়াতটি প্রমাণ বহন করে যে, বদ নজরের কুপ্রভাবের বাস্তবতা রয়েছে, আল্লাহর হুকুমে। (তাফসিরে ইবনে কাসির : ৪/৪১০)
আরও পড়ুন : দাম্পত্য জীবনে মিথ্যা বলা জায়েজ?
বদনজর বিষয়ে এক সাহাবির বিখ্যাত ঘটনা
সাহাবি আবু সহল ইবনে হুনাইফ। বদনজর বিষয়ে তার ঘটনা সুবিখ্যাত। একবার গোসল করার জন্য তিনি কাপড়-চোপড় খোলেন। গৌরবর্ণ, সুঠাম দেহী ও উন্নত গড়নের অঙ্গ-সৌষ্ঠব। হঠাৎ তার ওপর নজর পড়ে— আমের ইবনে রবিআর। আর সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে, ‘আমি আজ পর্যন্ত এমন সুন্দর ও কান্তিময় দেহ কারো দেখিনি।’
এরপর সাহল ইবনে হুনাইফের দেহে ভীষণ জ্বর এসে যায়। মহানবী (সা.) এ সংবাদ পেয়ে আমের ইবনে রবিআকে আদেশ দেন, সে যেন অজু করে অজুর পানি থেকে কিছু অংশ পাত্রে রাখে। তারপর তা যেন সাহল ইবনে হুনাইফের দেহে ঢেলে দেওয়া হয়। আদেশ মোতাবেক কাজ করা হলে সহল ইবনে হুনাইফ রক্ষা পেলেন। তার জ্বর চলে গেল এবং তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যান।
এ ঘটনায় মহানবী (সা.) আমের ইবনে রবিআকে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ নিজের ভাইকে কেন হত্যা করতে চায়? তোমার দৃষ্টিতে যখন তার দেহ সুন্দর প্রতিভাত হয়েছিল, তখন তুমি তার জন্য বরকতের দোয়া করলে না কেন? মনে রেখো, বদনজর লেগে যাওয়া সত্য।’ (মুআত্তা ইমাম মালেক, হাদিস : ১৭১৪)
আরও পড়ুন : বিধবার জন্য আখিরাতে যে পুরস্কার রয়েছে
মানুষের ভালো কিছু দেখলে যে দোয়া পড়বেন
এ হাদিস থেকে জানা যায়, কারও সৌন্দর্য, ধন-সম্পদ বা কোনো প্রকার উন্নতি কিংবা বিস্ময়কর কিছু দেখলে— তার জন্য কল্যাণের দোয়া করা উচিত। শুধু এতটুকুও দোয়া করা যায় যে— ‘বারাকাল্লাহু ফিহি’। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা এতে বরকত দান করুন।
আবার বিভিন্ন কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, ‘মাশাআল্লাহ, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ বলা উচিত। এতে কুদৃষ্টির প্রভাব বিনষ্ট হয়ে যায়। আর ওই ব্যক্তি বা জিনিস কুদৃষ্টির প্রতিক্রিয়া দেখে মুক্ত থাকে।
এছাড়াও এই হাদিস থেকে জানা যায়, কেউ বদনজরে আক্রান্ত হলে যার চোখ লাগে, তার হাত-পা ও মুখমণ্ডল ধৌত করা পানি রোগীর দেহে ঢেলে দিলে অনিষ্ট বিদূরিত হয়ে যায়।
বদনজর থেকে রক্ষা পেতে যে আমল করবেন
কেউ বদ নজরে আক্রান্ত হলে তার জন্য উপশমও বর্ণিত হয়েছে হাদিসে। এমন কিছু আমল হচ্ছে—
আবু সাঈদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) একবার কোনো রোগে আক্রান্ত হলেন। তখন ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) নবীজি (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, হে মুহাম্মদ! আপনি কি অসুস্থতা বোধ করছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন জিবরাইল (আ.) বললেন—
আরবি :
بِاسْمِ اللهِ أَرْقِيكَ، مِنْ كُلِّ شَيْءٍ يُؤْذِيكَ، مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ أَوْ عَيْنِ حَاسِدٍ، اللهُ يَشْفِيكَ بِاسْمِ اللهِ أَرْقِيكَ.
উচ্চারণ : বিসমিল্লাহি আরকিকা, মিন কুল্লি শাইয়িন ইয়ু’যিকা, ওয়া মিন কুল্লি আইনিন ও ওয়া হাসিদিন আল্লাহু ইয়াশফিকা, বিসমিল্লাহি আরকিকা।
অর্থ : আল্লাহর নামে আপনাকে ফুঁ দিচ্ছি; যেসব জিনিস আপনাকে কষ্ট দেয়, সেসব প্রাণের অনিষ্ট কিংবা হিংসুকের বদ নজর থেকে আল্লাহ আপনাকে শিফা দিন; আল্লাহর নামে আপনাকে ফুঁ দিচ্ছি। (মুসলিম, হাদিস : ৫৫১২)
সুতরাং দোয়াটি পড়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বারবার ফুঁ দিলে ইনশাল্লাহ, ধীরে ধীরে বদ নজর কেটে যাবে।
আরও পড়ুন : যেসব খাবার পছন্দ করতেন বিশ্বনবী
এছাড়াও সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস তিনবার আক্রান্ত ব্যক্তিকে পড়ে ফুঁ দেওয়া। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সুরা ফালাক ও নাস অবতীর্ণ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নিজ ভাষায়) জিন ও বদ নজর থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। পরিশেষে যখন সুরা দুটি অবতীর্ণ হলো, তখন ওই সুরা দুটি দ্বারা আশ্রয় প্রার্থনা করতে লাগলেন এবং অন্যান্য সব পরিহার করলেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২০৫৮)
ছোট বাচ্চাদের বদনজর মুক্তির জন্য দোয়া পড়া
বদনজর থেকে বাঁচাতে নবীজি (সা.) ছোটদের কোলে নিয়ে বিভিন্ন দোয়া পড়ে ফুঁ দিতেন। হাদিসের গ্রন্থগুলোতে এমন অনেক বর্ণিত হয়েছে। এখানে একটি দোয়া উদ্ধৃত করা হচ্ছে। হজরত হাসান ও হুসাইনকে (রা.) নবীজি (সা.) এই বাক্যগুলো দিয়ে ফুঁ দিতেন—
আরবি :
أُعِيذُكُمَا بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لامَّةٍ
উচ্চারণ : উইজুকুমা বিকালিমাতিল্লাহিত তাম্মাতি মিন কুল্লি শাইতানিন ওয়া হাম্মাতিন ওয়া মিন কুল্লি আইনিন লাম্মাতিন।
অর্থ : আমি তোমাদের উভয়কে আল্লাহর কালামের আশ্রয়ে রাখতে চাই সবধরনের শয়তান হতে, কষ্টদায়ক বস্তু হতে এবং সব ধরনের বদ নজর হতে। (বুখারি, হাদিস : ৩৩৭১)
পরিশেষে লক্ষণীয় যে, বদনজরের বিষয়টি সত্য। যে কারও ওপর বদনজর লাগতে পারে। তাই সতর্ক থাকার পাশাপাশি সবসময় আমলের মধ্যে থাকা উত্তম। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর দোয়া-দরুদ পড়া। এছাড়াও সুরা ফালাক ও নাসের মাধ্যমে মানুষ ও জিনের যাবতীয় অনিষ্টতা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা।
আল্লাহ সবাইকে বদনজর থেকে হেফাজত রাখুন, আমিন।