যেভাবে হিজরত করেছিলেন নবীজি
হিজরত শব্দের আভিধানিক অর্থ ত্যাগ করা, বর্জন করা। আর পরিভাষায় হিজরত বলতে কোনো কারণে নিজের দেশ ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাওয়া। ইসলামের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা হিজরত। বিশ্বের ইতিহাসেও সবচেয়ে তাৎপর্যবহ, সুদূরপ্রসারী ঘটনা।
জোসেফ হেল যথার্থই বলেছেন, Hijrah is the greatest Turning point in the History of Islam অর্থাৎ হিজরত ইসলামের গতিপথ পরিবর্তনকারী মহান ঘটনা। এটি দ্বিন ও মানবতার বৃহত্তম স্বার্থে ত্যাগ, বিসর্জনের এক সাহসী পদক্ষেপ।
মক্কার কাফিররা মুসলমান ও মুসলমানদের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সামাজিকভাবে বয়কট করাসহ সব ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন করে ইসলামের আওয়াজ স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। অঙ্কুরেই ইসলাম নামের বৃক্ষকে উপড়ে ফেলতে চেয়েছিল। হাতে গোনা যে কয়জন সাহাবি ঈমান এনেছিলেন, তাঁরা কেউই কাফিরদের নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে রেহাই পাননি। কোনো কোনো সাহাবি দৈহিকভাবে এমন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন যে ইতিহাসে এর নজির খুঁজে পাওয়া যায় না। কখনো ফুটন্ত গরম পানি ঢেলে দিয়ে, কখনো বা প্রচণ্ড উত্তপ্ত মরুভূমির পাথর-বালিতে টানাহেঁচড়া করে সাহাবিদের তারা অতিষ্ঠ করে তোলে। নির্যাতন-নিপীড়নের মাত্রা দিন দিন চরম থেকে চরমতর হচ্ছিল। দৈহিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন খোদ মহানবী (সা.)। একপর্যায়ে মক্কার কাফিররা এই মহামানবকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। নতুনভাবে ষড়যন্ত্রের জাল বোনে।
জাতীয় সমস্যাবলি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা ও শলাপরামর্শ করার জন্য ‘দারুণ নদওয়া’ নামে মক্কার কাফিরদের একটি জায়গা নির্দিষ্ট ছিল। সেখানে প্রতিটি গোত্রের প্রধান ব্যক্তিরা জমায়েত হতো। শীর্ষস্থানীয় কাফিররা তাদের ‘দারুণ নদওয়া’ বা ‘মন্ত্রণাগৃহে’ ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত কর্মকৌশল ঠিক করতে পরামর্শসভার আয়োজন করে। কেউ কেউ পরামর্শ দিল, মুহাম্মদ (সা.)-কে শৃঙ্খলিত করে কোনো ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখা উচিত।
কিন্তু অন্যরা মতামত দিল যে মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গী-সাথিরা হয়তো আমাদের কাছ থেকে তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে এবং এর ফলে আমাদের পরাজয়ও ঘটতে পারে। তাই ওই পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করা হলো। কেউ কেউ আবার পরামর্শ দিল, তাঁকে নির্বাসিত করা উচিত। কিন্তু তিনি যেখানে যাবেন, সেখানেই তাঁর অনুগামী বাড়তে থাকবে এবং আন্দোলনও যথারীতি সামনে অগ্রসর হবে—এ আশঙ্কায় ওই পরামর্শও নাকচ করা হলো।
অবশেষে আবু জাহেল পরামর্শ দিল, প্রতিটি গোত্র থেকে একজন করে যুবক মনোনীত করা হবে, তারা সবাই একসঙ্গে রাসুল (সা.)-এর ওপর হামলা করবে এবং তাঁকে হত্যা করে ফেলবে। এর ফলে তাঁর রক্তপণ সব গোত্রের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যাবে। আর সবার সঙ্গে একাকী লড়াই করা হাশিমি গোত্রের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হবে না। এ অভিমত সবাই পছন্দ করল এবং শেষ পর্যন্ত এ কাজের জন্য একটি রাতও নির্দিষ্ট করা হলো।
এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ করো, কাফিররা তোমাকে বন্দি বা হত্যা করার জন্য কিংবা নির্বাসিত করার চক্রান্ত করে। তারা চক্রান্ত করে; আল্লাহও কৌশল অবলম্বন করেন। আর আল্লাহ শ্রেষ্ঠতম কৌশলী।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৩০)
কিন্তু তাদের সব পরিকল্পনা আল্লাহ নস্যাৎ করে দেন। রাতেই আল্লাহ তাআলা ওহির মাধ্যমে এই চক্রান্তের কথা তাঁর রাসুলকে জানিয়ে দিলেন। হিজরতের নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজ বাড়িতে আপন চাচাতো ভাই হজরত আলী (রা.)-কে নিজ বিছানায় রেখে আবু বকর (রা.)-কে সঙ্গে নিয়ে মহানবী (সা.) মদিনার পথে রওনা হন।
রওনা হওয়ার মুহূর্তে বাইতুল্লাহর দিকে করুণ দৃষ্টিতে নবীজি বলেন—
মদিনায় সর্বপ্রথম হিজরত করেছেন মুসআব ইবনে উমাইর (রা.)। মহানবী (সা.) সাহাবাদের হিজরতের দুই মাস পর রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার হিজরত করেন। হিজরতের সময় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে আবু বকর (রা.) ও তাঁর গোলাম আমের ইবনে ফুহাইরা ও পথনির্দেশক আবদুল্লাহ ইবনে আরিকত দুয়ালিও ছিলেন। তিনি বায়আতে আকাবার তিন মাস পর ২৭ সফর বৃহস্পতিবার রওনা দেন। তিন দিন গোপন থাকার পর সোমবার প্রথম রবিউল আউয়াল আবার রওনা দেন। সোমবার ১২ রবিউল আউয়ালে তিনি কুবায় পৌঁছেন। ১৪ দিন থাকার পর মসজিদে কুবা প্রতিষ্ঠা করে তিনি মদিনায় দিনদুপুরে পৌঁছেন। (ইবনে কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড ৩, পৃ. ১৮৮)
রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় যাওয়ার পর মক্কার দুর্বল ও অক্ষম ছাড়া সবার ওপর হিজরত করা ফরজ ছিল। এটি তখন ঈমানের শর্ত ছিল। এই হিজরতকে কেন্দ্র করেই হজরত উমর (রা.)-এর আমলে ১৭ হিজরিতে হিজরি সনের কার্যক্রম চালু হয়েছে।