মাদক প্রসঙ্গে ইসলামের নির্দেশনা ও বিধান
মাদকের ভয়াবহতার কোনো শেষ নেই। বিশ্বে অগণিত জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, টেকনিশিয়ান ও অনুরূপ সফল মানুষের জীবন ও পরিবার ধ্বংস হয়েছে মদের কারণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের ৭৬ মিলিয়ন মানুষ মদপানের কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন কঠিন রোগে ভুগছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে, বিশ্বের সব রোগ-ব্যাধির ৩.৫ শতাংশ মদপানজনিত।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মাদকাসক্তি আধুনিক সভ্যতার ভয়ংকরতম ব্যাধিগুলোর অন্যতম। মাদকদ্রব্যের কারণে অপচয়ও হয় বৃহৎ। মদপান ও মাতলামির কারণে প্রতিবছর শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ১৮৫ বিলিয়ন ডলার নষ্ট হয়।
ইসলামে মাদক সেবন নিষিদ্ধ। ইসলামে অন্য যেসব নিষিদ্ধ বা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত বিষয় রয়েছে, সেগুলো থেকে ব্যক্তি চাইলেই সহজে বিরত থাকতে পারে। অর্থাৎ, ইচ্ছা করলে এসব অপরাধ থেকে সরে থাকা যায়। কিন্তু মাদক গ্রহণ এমন এক অপরাধ, যা নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না; বরং মাদকসেবী নিজেই মাদক বা নেশার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। চাইলেই সেখান থেকে বেরিয়ে আসা যায় না। অর্থাৎ, সে নেশাকে ছাড়তে চাইলেও নেশা তাকে সহজে ছাড়ে না বা ছাড়তে চায় না।
ইসলাম আল্লাহর ভয়ের পাশাপাশি আইনের মাধ্যমে এ ভয়ংকর ব্যাধি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করেছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদি, ভাগ্যনির্ধারক তীরগুলো নাপাক। এগুলো শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত : ৯০)
মাদকদ্রব্যের শরয়ি বিধান
হানাফি মাজহাব মতে, মাদকদ্রব্যকে বিধানগতভাবে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে—
এক. খেজুর, আঙুর ও কিশমিশের তৈরি মদ ও নেশাদ্রব্য। দুই. এগুলো ছাড়া অন্য উৎপাদিত বা যেকোনো জিনিস থেকে তৈরি করা নেশাদ্রব্য।
প্রথম প্রকারের মাদকদ্রব্যের বিধান হলো— কম হোক বা বেশি হোক, নেশাগ্রস্ত হোক বা না হোক তা সেবন করা হারাম। আর কোনো ব্যক্তির তা সেবন করার বিষয়টি শরয়ি সাক্ষী দ্বারা প্রমাণিত হলে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা তার ওপর শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত ‘হদ’ দণ্ড প্রয়োগ করবেন। দ্বিতীয় প্রকারের মাদকদ্রব্যের বিধান হলো, সেগুলোও কমবেশি গ্রহণ করা নাজায়েজ, চাই তা নেশাগ্রস্ত করুক বা না-ই করুক। তবে এসব মাদকদ্রব্য নেশাগ্রস্ত হওয়ার মতো পরিমাণ সেবন করলে শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত দণ্ড প্রয়োগ করা হবে। এর কম গ্রহণ করলে নির্ধারিত দণ্ড প্রয়োগ হবে না। এ ক্ষেত্রে দণ্ড প্রয়োগ না হলেও বিচারক সার্বিক বিবেচনায় ‘তাজির’ তথা সাধারণ অনির্ধারিত শাস্তি দিতে পারবেন। (রাদ্দুল মুহতার : ৪/৩৮)
নেশাগ্রস্ত হওয়ার আলামত হলো, নেশাগ্রস্ত ব্যক্তির বেশির ভাগ কথা বিকৃত ও আজেবাজে প্রলাপ হয়ে যাওয়া।
মাদকদ্রব্য গ্রহণে ইসলামে যে শাস্তি
খেজুর, আঙুর ও কিশমিশের তৈরি মদ স্বেচ্ছায় গ্রহণকারী ব্যক্তি নেশাগ্রস্ত হোক বা না হোক, তাকে ৮০ বার বেত্রাঘাত করা হবে। এ ছাড়া অন্যান্য উৎপাদিত জিনিস বা যেকোনো জিনিস থেকে তৈরি করা নেশাদ্রব্য নেশাগ্রস্ত হওয়ার মতো পরিমাণ গ্রহণকারী ব্যক্তিকেও ৮০ বার বেত্রাঘাত করা হবে।
আনাস ইবনে মালিক (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.) মাদক সেবনের অপরাধে খেজুরের ডাল ও জুতা দিয়ে আঘাত করেন। আর আবু বকর (রা.) ৪০টি বেত্রাঘাত করেন। অতঃপর ওমর (রা.) যখন খলিফা হন, তিনি লোকদের ডেকে বলেন, অনেক লোক পানির উৎসগুলোতে ও গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। কাজেই এখন আপনারা মাদক গ্রহণের ‘হদ’ প্রসঙ্গে কী বলেন? তখন আবদুর রাহমান ইবনু আউফ (রা.) বলেন, আমরা হদের আওতায় লঘু শাস্তি দেওয়ার মত দিচ্ছি। সুতরাং তিনি এর শাস্তি হিসেবে ৮০টি বেত্রাঘাত নির্ধারণ করেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৪৭৯)
বেত্রাঘাতের ক্ষেত্রে মাথা ও চেহারা এবং সংবেদনশীল জায়গায় আঘাত করা যাবে না এবং শরীরের একই জায়গায় ৮০টি বেত দেবে না, বরং বিভিন্ন জায়গায় দেবে।
নেশাগ্রস্ত অবস্থায় শাস্তি প্রয়োগ করা যাবে না। বরং স্বাভাবিক হওয়ার পর শাস্তি প্রয়োগ করতে হবে।
মাদক নিয়ন্ত্রণে দণ্ড জারির বিধান ও শর্ত
দুইজন সৎ ও নিষ্ঠাবান পুরুষ সাক্ষী যদি কারো বিরুদ্ধে আদালতে মাদকদ্রব্য গ্রহণের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়, তখন বিচারক প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদ করবেন যে কখন ও কোথায় মাদক গ্রহণ করেছে, ইচ্ছাকৃত নাকি উপায়হীন চাপে পড়ে ইত্যাদি। নিশ্চিত হওয়ার পর অভিযুক্ত ব্যক্তির ওপর শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত দণ্ড প্রয়োগ করা হবে। মাদক গ্রহণকারী ব্যক্তি সুস্থ মস্তিষ্ক অবস্থায় নিজে মাদক গ্রহণ স্বীকার করার দ্বারাও তার ওপর দণ্ড প্রয়োগ করা হবে। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া : ২/১৫৯)
সাক্ষীর নির্ধারিত সংখ্যা ও শর্ত পূরণ না হলে ‘হদ’ তথা শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত দণ্ড প্রয়োগ করা হবে না। তবে যদি নির্ভরযোগ্য অন্য কোনো মাধ্যমে মাদকদ্রব্য সেবনের প্রবল ধারণা হয়, সে ক্ষেত্রে ‘তাজির’ তথা সাধারণ অনির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগ করা হবে। (ফাতাওয়ায়ে উসমানি : ৩/৫৩৯)
অভিযুক্ত ব্যক্তি সাবালক, জ্ঞানসম্পন্ন ও মুসলিম হওয়া আবশ্যক। শিশু, বোবা, পাগল ও অমুসলিমের ওপর উল্লিখিত ইসলামী দণ্ড প্রয়োগ হবে না।
অমুসলিমের জন্য মাদক গ্রহণ ও ব্যবসা নিষিদ্ধ না হলেও তাদের জন্য এর ব্যাপক প্রচার-প্রসার ও জনসম্মুখে পান করার অনুমতি নেই। তাই তাদের মাদক সেবন সীমা লঙ্ঘন করলে ‘তাজির’ তথা সাধারণ অনির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগ করা যাবে। (আত-তাশরিউল জিনাঈ : ২/৫০০)
কাউকে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে, তবে মাদকদ্রব্য গ্রহণের সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তাহলে তার ওপর ‘হদ’ তথা শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত দণ্ড প্রয়োগ করা হবে না। বরং এ ক্ষেত্রেও ‘তাজির’ তথা সাধারণ অনির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগ করা হবে। (রদ্দুল মুহতার : ৪/৩৯)
মাদকদ্রব্যের কারবারি প্রসঙ্গে ইসলাম
মুসলিমদের জন্য মদ, হেরোইন ও অন্যান্য মাদকদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় করা হারাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মদপান, তা ক্রয়-বিক্রয় ও এর বিনিময় হারাম করেছেন।’ (মুসনাদে আবি হানিফা, হাসকাফির বর্ণনা, হাদিস : ৩৫)
তবে যার কাছে বা ঘরে অথবা দোকানে মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়, কিন্তু মদপান প্রমাণিত হয়নি, তার ওপর ‘হদ’ তথা শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত দণ্ড প্রয়োগ করা হবে না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ‘তাজির’ তথা সাধারণ অনির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগ করা হবে। মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান সার্বিক বিবেচনায় এদের ওপর কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তিও প্রয়োগ করতে পারেন। (খুলাসাতুল ফাতাওয়া : ৩/৩৯, রদ্দুল মুহতার : ৪/৩৯)
মাদক গ্রহণে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি
একটি হাদিসে চতুর্থবার মদপানে লিপ্ত হলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান বর্ণিত হয়েছে। এ বিষয়ে আলেমদের অভিমত হলো, এ হাদিসের বিধান রহিত হয়ে গেছে। হাদিসটি হলো, মুয়াবিয়া (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মদপান করে, তাকে চাবুকপেটা করো। যদি সে চতুর্থবার মদপানে লিপ্ত হয়, তাহলে তাকে মেরে ফেলো।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৪৮২, তিরমিজি, হাদিস : ১৪৪৪)
ইমাম তিরমিজি (রহ.) হাদিসটির ব্যাখ্যায় বলেন, আমি ইমাম বুখারি (রহ.)-কে এ কথা বলতে শুনেছি, তিনি আরও বলেছেন— আগে মদপানকারীর মৃত্যুদণ্ডের বিধান ছিল, পরে তা বাতিল করা হয়েছে। অনেক ইসলামী আইনবিদ মনে করেন, যদিও ‘হদ’-এর ক্ষেত্রে বিধানটি রহিত, তবে মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান সার্বিক বিবেচনায় ভালো মনে করলে মাদকদ্রব্য নির্মূলে ‘তাজির’ হিসেবে এরূপ ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিতে পারবেন। এ বিবেচনায় জনসাধারণের কল্যাণে দেশ থেকে মাদকদ্রব্য নির্মূলের উদ্দেশ্যে মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকের ব্যাপক প্রসারকারীকে রাষ্ট্রপ্রধান মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিতে পারবেন। (আল আরফুশ শাজি : ৩/১৩৬, আত-তাশরিউল জিনাঈ : ১/৬৮৮)
তবে এখানে অবশ্যই স্মর্তব্য যে এ আদেশ যেন দেশ ও জনসাধারণের কল্যাণেই হয়ে থাকে, অযথা নিজস্ব স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য না হয়। পাশাপাশি নির্দোষ ও নিরীহ জনগণ যেন জুলুমের শিকার না হয়।
-মুফতি মাহমুদ হাসান লেখাটি ঈষৎ পরিবর্তিত ও সময়ের আবেদনে প্রকাশিত