হজযাত্রীদের যেভাবে মেহমানদারি করা হতো
হজযাত্রীরা আল্লাহর মেহমান। আল্লাহ তাদের তার সান্যিধ্যে ডেকে পাঠান । পৃথিবীর দূর সব প্রান্ত থেকে সাড়া দিয়ে তারা ছুটে আসেন পবিত্র ভূমিতে। পিতা ইবরাহিম (আ.) ও সর্বশ্রেষ্ঠ মানব মুহাম্মদ (সা.)-এর স্মৃতিভূমিতে। যেখানে কাবা, হাজারে আসওয়াদ, আরাফাত, মিনা ও মুজদালিফা মুমিনের হৃদয়কে উদ্ভাসিত করতে অপেক্ষা করছে ।
মনে অদম্য হিম্মত, প্রাণে আল্লাহ ও পবিত্র ভূমির প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা আর শত কণ্ঠে লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনি তুলে এগিয়ে চলে হজযাত্রীদের কাফেলা। অনুরণিত হয় কোরআনুল কারিমের অমোঘ বাণী, ‘স্মরণ করো, যখন আমি ইবরাহিমকে পবিত্র গৃহের স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, আমার সাথে কাউকে শরিক করবে না। তাওয়াফকারী, সালাতে দণ্ডায়মান এবং রুকু ও সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রেখো আমার ঘর। আর মানুষের কাছে হজের ঘোষণা দাও; তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে, আর পথক্লান্ত শীর্ণ উটের পিঠে, বহু দূর-দূরান্তের গভীর পর্বত সংকুল পথ বেয়ে।’ (সুরা হজ, আয়াত : ২৬-২৭)
পবিত্র হারামাইন শরিফাইন তথা দুই পবিত্র স্থান এর নিরাপত্তা, রক্ষণাবেক্ষণ ও হজযাত্রীদের সর্বোত্তম সেবা প্রদানের জন্য মুখিয়ে থাকতেন মুসলিম শাসক ও আপামর জনগণ। আজ আমরা দেখবো মামলুক যুগে শাসক ও অবস্থাসম্পন্ন মুসলমানেরা কীভাবে হজযাত্রীদের সেবা করেছেন।
আরও পড়ুন : আপনার ওপর হজ ফরজ হয়েছে কিনা বুঝবেন যেভাবে
১২৫০ সাল থেকে ১৫১৭ সাল পর্যন্ত ব্যাপ্ত মামলুক শাসনামল ছিল সাফল্য আর সমৃদ্ধির এক জীবন্ত উপাখ্যান। মোঙ্গল আক্রমণে বাগদাদভিত্তিক আব্বাসি খিলাফাহর পতনের পর মামলুক রাজধানী মিশর হয়ে উঠেছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার আঁতুড়ঘর। এ বংশের সুলতানরা অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা ও রিবাত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। চালু করেছিলেন জনকল্যাণমূলক অনেক প্রকল্প। হাজিদের সেবা ও আপ্যায়নে ছিল তাদের বিশেষ সুনাম।
তাদের সময়ে হাজিদের জন্য থাকত বিনামূল্যে উন্নতমানের পোশাক-পরিচ্ছদ, রুচিসম্মত খাবার, সুপেয় পানীয়, বাহন জন্তু, সুচিকিৎসা, আবাস ও স্নানাগার এর ব্যবস্থা। হাজিদের নিরাপত্তা বিধান করতে মোতায়েন করা হতো আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্স।
মামলুক সুলতান কালাউন (১২৭৯-১২৯০) হাজিদের সেবা প্রদানে এতটাই আন্তরিক ছিলেন যে, মক্কার নতুন শরিফ (শাসক) নিয়োগ দেওয়ার সময় তাকে শপথ করেছিলেন সে যেন হাজিদের নিরাপত্তা ও সেবাদানে বিন্দুমাত্র কসুর না করে। সুলতান জাহির বাইবার্স (১২৫৯-১২৭৭) মক্কার জন্য অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় বহুগুণ বেশি অর্থ বরাদ্দ করতেন যাতে হাজিদের আপ্যায়নে কোন রকম ত্রুটি না হয়। সুলতান আল মুযাফফার ইউসুফ (১২৪৯—১২৯৫) ১২৬০ সালে হজ করেন। হজের পর তিনি ১০ দিন মক্কায় অবস্থান করেন। এসময় তিনি হাজিদের মাঝে প্রচুর দান সাদাকা করেন। ১৫০৫ সালে মামলুক সুলতান ঘুরি (১৫০১-১৫১৬) প্রত্যেক হাজিকে একটি করে পোশাক দেয়ার রাজকীয় আদেশ প্রদান করেন। এক সুলতান আশরাফ শাবানই ( ১৩৬৩-১৩৭৭ ) হাজিদের জন্য কয়েক মিলিয়ন রৌপ্যমুদ্রা ওয়াকফ করেন।
মামলুক সুলতানরা হাজিদের জন্য পুরো যাত্রাপথে অসংখ্য কূপ, যাত্রীছাউনি ও সরাইখানার ব্যবস্থা করেন। মাত্র এক একটি কূপ মেরামত করার জন্যই পাঁচশো রৌপ্যমুদ্রা বরাদ্দ করা হতো। হাজিদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য মক্কা-মদিনায় স্থানীয় বাহিনীর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় বাহিনীও মোতায়েন থাকতো। প্রতিটি হজ কাফেলার সাথে নিরাপত্তা রক্ষী প্রেরণ করা হতো যাতে মরু ডাকাতদের হামলায় হাজিদের কোনরূপ ক্ষতিসাধন না হয়। ঘটনাচক্রে কোনো কাফেলা লুট হলে তাদের যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হতো।
আরও পড়ুন : কাবা শরিফ দেখলে কি হজ ফরজ হয়ে যায়?
সেকালে আকাবা ছিল সিরিয়া, মিশর ও উত্তর আফ্রিকার হাজিদের মিলিত হওয়ার স্থান। এখানে সরকারি উদ্যোগে হাজিদের জন্য বিশাল বাজার স্থাপন করা হয়। এবং সুলভ মূল্যে পণ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হয়। এখানে দুর্বল ও অসুস্থ হাজিদের পৃথক করা হতো এবং তাদের জাহাজে করে জেদ্দা সমুদ্রবন্দরে পাঠিয়ে দেয়া হতো।
হাজিদের স্বাস্থের প্রতি যত্ন রাখতে প্রতিটি হজ কাফেলার সাথে আস্ত একটি ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল থাকতো। পশু চিকিৎসকও থাকতো সরকারিভাবে। হজের মৌসুমে মক্কা-মদিনায় বিশেষ হাসপাতাল স্থাপন করা হতো। সুলতান কানসুহ ঘুরি (১৫০১-১৫১৬) প্রতি বছর হাজিদের জন্য জরুরি ঔষধ ও প্রতিষেধকের বিশেষ বহর পাঠাতেন।
মামলুক যুগের সাধারণ মানুষও পিছিয়ে ছিলেন না এ মহান পুণ্যকর্ম থেকে। অল্প ক’টা উদাহরণ দেয়া যাক, খোন্দ তুগাই নামের একজন সম্ভ্রান্ত মহিলা ১৩২১ সালে পবিত্র হজ আদায় করার সময় পূর্ণ তিন দিন হাজিদের মাঝে জবরযদ মিঠাই ও বরফ যোগে ছাতু বিতরণ করেন। পাশাপাশি হাজিদের মাঝে নগদ ত্রিশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা বিলি করেন।
যাইনুদ্দিন আবদুল বাসিত নামের এক ভদ্রলোক দরিদ্র হাজিদের জন্য ছাউনি স্থাপন করেন যেখানে মিষ্টি পানি, শুকনো ও তাজা রুটি, খাসির টাটকা মাংসের ব্যবস্থা থাকতো। আবুল মাহাসিন ইউসুফ জামালি নামের অপর এক ভদ্রলোক আরাফাতের ময়দানে পানি সরবরাহের জন্য প্রচুর অর্থ ওয়াকফ করেন। এছাড়া জনগণের অংশগ্রহণে দরিদ্র মানুষদের নির্মিত হয় অসংখ্য রিবাত বা বিনামূল্যে থাকার আবাস। রামেশত, কাযবিনি, যানজিলি, দিমাশকিয়্যা ও রবি এমনই কিছু রিবাতের নাম।
এভাবে হজযাত্রীদের সেবায় মামলুক যুগের শাসক-জনতা একাকার হয়ে যেতেন। আল্লাহর মেহমানদের আপ্যায়নকে নিজেদের সম্মান ও গৌরব হিসেবে দেখতেন। এ নিয়ে রীতিমত প্রতিযোগিতা চলতো। ইসলামের সোনালী যুগের সেই ঐতিহ্য হালআমলে অনেকাংশেই ম্লান হয়ে পড়েছে। গৌরবময় সেই ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন হোক।
ইবনু ইয়াসকৃত বাদায়িউয যুহুর, ইবনু আইবাককৃত আদ দুররুল ফাখির, ইবনু তুগরি বারদিকৃত আন নুজুমুয যাহিরা ও কলাকশান্দিকৃত সুবহুল আশা অবলম্বনে
হাবিবুল্লাহ বাহার।। তরুণ আলেম, লেখক ও অনুবাদক; [email protected]