বায়তুল মুকাদ্দাসের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন যে নবীর মা

ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন মসজিদগুলোর একটি ফিলিস্তিনের জেরুজালেমে অবস্থিত মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস। বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবু জর গিফারি রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন—
আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! দুনিয়াতে প্রথম কোন মসজিদটি নির্মিত হয়েছে? তিনি বলেন, মসজিদুল হারাম। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কোনটি? প্রতি উত্তরে তিনি বললেন, তারপর হলো মসজিদুল আকসা। এরপর আমি জানতে চাইলাম যে, উভয়ের মধ্যে ব্যবধান কত বছরের? তিনি বললেন চল্লিশ বছরের ব্যবধান। (সহিহ বুখারি, হাদিস, ৩১১৫)
বায়তুল মুকাদ্দাস কতটা প্রাচীন মসজিদ তা এই হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়। প্রাচীন এই মসজিদের সেবা বা খেদমত করেছেন বনী ইসরাঈলের নবী হজরত ঈসা আ.-এর মা মারইয়াম আ.।
মারইয়াম আ. মায়ের গর্ভে থাকাকালীন তার মা মানত করেছিলেন, যে সন্তান জন্ম নেবে তাকে বায়তুল মোকাদ্দাসের খেদমতে নিয়োজিত করবো। মেয়ে জন্ম নেওয়ার পর তিনি কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েন, তবে আল্লাহ তায়ালা তাকে জানিয়ে দেন, এই মেয়ে অন্য ছেলেদের মতো নয়। বরং তিনি বরকতময়।
হজরত মারইয়াম আ.-এর জন্ম ও বায়তুল মুকাদ্দাসের খেদমতে নিয়োজিত হওয়ার ঘটনাটি এমন—
বায়তুল মুকাদ্দাসের ইমাম ছিলেন হজরত ইমরান। তিনি মারইয়ামের বাবা। জন্মের আগেই তিনি মারা যান। ইমরানের স্ত্রী হান্না গর্ভাবস্থায় মানত করেছিলেন যে, তার গর্ভের সন্তানকে বায়তুল মুকাদ্দাসের সেবার জন্য সব কিছু থেকে স্বাধীন করে উৎসর্গ করবেন।
মারইয়ামের জন্মের পর তার মা তাঁকে নিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসে উপস্থিত হলেন এবং মসজিদে ইবাদতকারীদের বললেন, 'আমি এ শিশু কন্যাকে আল্লাহর নামে উৎসর্গ করেছি। তাই আমি একে নিজের কাছে রাখতে পারি না। আপনারা এর দায়িত্বভার গ্রহণ করুন। বায়তুল মুকাদ্দাসে ইবাদতকারীদের মধ্যে হজরত জাকারিয়া আলাইহিস সালামও ছিলেন।
আরও পড়ুন
বায়তুল মুকাদ্দাসের ইমাম ছিলেন মারইয়ামের পিতা ইমরান। তিনি তার জন্মের আগেই মারা যান। নতুবা তিনিই বায়তুল মুকাদ্দাসের সেবার জন্য তাকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারী ছিলেন। কেননা তিনি ছিলেন একাধারে মসজিদে ইমাম ও এ মেয়ে শিশুর পিতা। এ কারণেই বায়তুল মুকাদ্দাসের সব ইবাদতকারী এ মেয়ে শিশুকে লালন-পালনে আগ্রহী ছিলেন।
হজরত জাকারিয়া আলাইহিস সালাম মারইয়ামকে লালন-পালনে অগ্রাধিকারের কারণ বর্ণনা করে বলেন-
আমার গৃহে এ মেয়ে শিশুর খালা রয়েছে। আর খালা মায়ের মতোই। তাই মায়ের পরে মেয়ে শিশুকে রাখার ব্যাপারে খালার অধিকার বেশি। কিন্তু অন্যরা এ অগ্রাধিকার মেনে নিতে পারছিল না। পরে মারইয়ামের লালন-পালনের দায়িত্বের বিষয়টি মীমাংসায় লটারির আয়োজন করতে হয়। লটারি করার পদ্ধতিটিও ছিল অভিনব। লটারিতে হজরত জাকারিয়া বিজয় লাভ করেন। তিনি মারইয়ামের লালন-পালনের ভার পেলেন।
কোনো বর্ণনায় এসেছে, হজরত জাকারিয়া আলাইহিস সালাম, একজন পরিচারিকা নিযুক্ত করে দুধ পানের ব্যবস্থা করেন। বায়তুল মুকাদ্দাস সংলগ্ন একটি উত্তম কক্ষে মারইয়ামকে রাখা হয়। সেখানেই সে লালিত-পালিত হতে থাকেন। হজরত জাকারিয়া কোথাও গেলে তাকে তালাবদ্ধ করে যেতেন আবার ফিরে এসে তালা খুলে দিতেন।
এ ব্যবস্থাপনায় তাঁকে (মারইয়ামকে) তাঁর পালনকর্তা আল্লাহ তায়ালা উত্তম পন্থায় কবুল করে নিলেন এবং উত্তমভাবে বড় করে তোলেন। (তাফসিরে মারেফুল কুরআন)
কোরআনের বর্ণনায় ঘটনাটি সুস্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
إِذْ قَالَتِ امْرَأَةُ عِمْرَانَ رَبِّ إِنِّي نَذَرْتُ لَكَ مَا فِي بَطْنِي مُحَرَّرًا فَتَقَبَّلْ مِنِّي إِنَّكَ أَنتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ - فَلَمَّا وَضَعَتْهَا قَالَتْ رَبِّ إِنِّي وَضَعْتُهَا أُنثَى وَاللّهُ أَعْلَمُ بِمَا وَضَعَتْ وَلَيْسَ الذَّكَرُ كَالأُنثَى وَإِنِّي سَمَّيْتُهَا مَرْيَمَ وِإِنِّي أُعِيذُهَا بِكَ وَذُرِّيَّتَهَا مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
‘যখন ইমরানের স্ত্রী নিবেদন করলো- হে আমার পালনকর্তা! আমার গর্ভে যা রয়েছে, তা আমি (সব কিছু থেকে) একান্তভাবে মুক্ত করে তোমার জন্য উৎসর্গ করলাম। সুতরাং আমার পক্ষ থেকে তুমি তাকে কবুল করে নাও, নিশ্চয়ই তুমি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞাত।
অতপর যখন সে (ইমরানের স্ত্রী) তাকে (সন্তান) প্রসব করলো, তখন সে বললো, হে আমার পালনকর্তা! আমি কন্যা (সন্তান) প্রসব করেছি। বস্তুত সে কী প্রসব করেছে তা আল্লাহ ভালই জানেন। আর সেই (কাঙ্খিত) ছেলে তো (এ) মেয়ের মতো নয়। আর আমি তার নাম রাখলাম মারইয়াম। আর আমি তাকে ও তার সন্তানদেরকে তোমার আশ্রয়ে সমর্পণ করছি। অভিশপ্ত শয়তানের কবল থেকে।' (সূরা ইমরান, আয়াত : ৩৫-৩৬)