দরিদ্রের প্রতি ভালোবাসা ও সদয় আচরণের ৮ উপকার
দরিদ্র এবং অভাবী ব্যক্তি দুজনেই অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে দুর্বল, তবে তাদের মধ্যে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। দরিদ্র ব্যক্তি সাধারণত সম্পূর্ণরূপে অর্থের অভাব অনুভব করেন, অন্যদিকে অভাবী ব্যক্তি অর্থ বা অন্য কিছুর ক্ষেত্রে আংশিকভাবে অসচ্ছল।
ইসলাম দরিদ্রদের প্রতি ভালোবাসা ও দয়ার উপর জোর দেয়। এটি শুধুমাত্র আর্থিক দিকেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং হৃদয়ের মানবিকতার প্রতিফলন। ইসলামের দৃষ্টিতে দরিদ্রদের প্রতি সদয় হওয়া এক মহৎ গুণ যা মানুষের নৈতিকতা ও সামাজিক সংহতিকে মজবুত করে।
দরিদ্রদের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ সম্মানের কারণ। দরিদ্রদের সাথে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ আচরণ করা এবং তাদের অপমান বা অবজ্ঞা না করা অবশ্যই ব্যক্তির সম্মানকে বাড়িয়ে তোলে। সাহায্য-সহায়তা ও তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করা, তাদেরকে সম্মানজনক উপায়ে প্রদান করা শরিয়তের দৃষ্টিতে কাম্য একটি বিষয়। দরিদ্রদের সাথে যোগাযোগ রাখা, তাদের সাথে সময় কাটানো এবং তাদের অভাব-অনটনে পাশে দাঁড়ানো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়ালাসাল্লামের সুন্নাতও বটে।
দরিদ্রদের প্রতি দয়া প্রদর্শনের উদ্দেশ্য
সর্বশক্তিমান আল্লাহর ইবাদত
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন, এতিম ও অভাবগ্রস্তদের প্রতি সদয় হও। (সূরা আন-নিসা, আয়াত : ৩৬)। দরিদ্রদের সাহায্য করা আল্লাহর আদেশ পালন এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভের একটি পথ। আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, আর আত্মীয়কে তার হক দিয়ে দাও এবং মিসকীন ও মুসাফিরকেও। আর কোনভাবেই অপব্যয় করো না। (সূরা ইসরা, আয়াত : ২৬)
নবীর আদর্শ অনুসরণ
নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দরিদ্রদের ভালোবাসা এবং তাদের প্রতি সদয় হওয়ার জন্য প্রেরণা দিয়েছেন। তিনি দরিদ্র হিসেবে জীবনযাপন করতে এবং মৃত্যু পর্যন্ত তাদের পাশে থাকতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন।
হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, মুআয ইবনু জাবাল (রা.) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, একদিন প্রত্যুষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সাথে ফজরের নামাজ আদায় করতে আসতে বাধাপ্রাপ্ত হন। এমনকি আমরা সূর্য উদিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করলাম। তিনি তাড়াতাড়ি বের হয়ে এলে সালাতের জন্য ইকামাত দেয়া হল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংক্ষেপে সালাত আদায় করলেন। তিনি সালাম ফিরানোর পর উচ্চস্বরে আমাদেরকে ডেকে বললেন, তোমরা যেভাবে সারিবদ্ধ অবস্থায় আছো সেভাবেই থাক। তারপর তিনি আমাদের দিকে ফিরে বসলেন অতঃপর বললেন, সকালে তোমাদের নিকট আসতে আমাকে কিসে বাধাগ্রস্ত করেছে তা এখনই তোমাদেরকে বলছি।
আমি রাত্রে উঠে অজু করলাম এবং সামর্থ্যমত নামায পড়লাম। নামাজের মধ্যে আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। অতঃপর আমি ঘুমিয়ে পড়লাম, এমন সময় আমি আমার বরকতময় প্রভুকে খুব সুন্দর অবস্থায় (স্বপ্নে) দেখতে পেলাম। তিনি বললেন, হে মুহাম্মাদ। আমি বললাম, প্ৰভু! আমি উপস্থিত। তিনি বললেন, উর্ধ্বজগতের অধিবাসীগণ (শীর্ষস্থানীয় ফেরেশতাগণ) কি ব্যাপারে বিতর্ক করছে? আমি বললাম, প্ৰভু! আমি জানি না। আল্লাহ তায়ালা এ কথা তিনবার বললেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি তাকে দেখলাম যে, তিনি তার হাতের তালু আমার দুই কাঁধের মাঝখানে রাখলেন। আমি আমার বক্ষস্থলে তার হাতের আঙ্গুলের শীতলতা অনুভব করলাম। ফলে প্রতিটি জিনিস আমার নিকট আলোকোদ্ভাসিত হয়ে উঠল এবং আমি তা জানতে পারলাম। আল্লাহ তায়ালা বললেন, হে মুহাম্মাদ! আমি বললাম, প্ৰভু! আমি আপনার কাছে উপস্থিত। তিনি বললেন, উর্ধ্বজগতের বাসিন্দাগণ কি ব্যাপারে বিতর্ক করছে? আমি বললাম, কাফফারাত প্রসঙ্গে (তারা বিতর্ক করছে)।
আরও পড়ুন
তিনি বলেন, সেগুলো কি? আমি বললাম, হেঁটে সালাতের জামাতে হাজির হওয়া, নামাজের পর মসজিদে বসে থাকা এবং কষ্টকর অবস্থায়ও ভালোভাবে অজু করা। তিনি বললেন, তারপর কি ব্যাপারে (তারা বিতর্ক করেছে)? আমি বললাম, খাদ্যপ্রার্থীকে আহার্যদান, নম্রতার সাথে কথা বলা এবং রাতে মানুষ যখন ঘুমিয়ে পড়ে সেই সময় সালাত আদায় করা প্রসঙ্গে।
আল্লাহ তায়ালা বললেন, তুমি কিছু চাও, বললাম, ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে ভাল ও কল্যাণকর কাজ সম্পাদনের, মন্দ কাজসমূহ বর্জনের, দরিদ্রজনদের ভালবাসার তাওফীক চাই, তুমি আমায় ক্ষমা কর ও দয়া কর। তুমি যখন কোন গোত্রকে বিপদে ফেলার ইচ্ছা কর তখন তুমি আমাকে বিপদমুক্ত রেখে তোমার কাছে তুলে নিও। আমি প্রার্থনা করি তোমার ভালবাসা, যে তোমায় ভালোবাসে তার ভালোবাসা এবং এমন কাজের ভালবাসা যা তোমার ভালবাসার নিকটবর্তী করে দেয়।’
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, স্বপ্লটি অবশ্যই সত্য। অতএব তা পড়, তারপর তা শিখে নাও। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস : ৩২৩৫)
মহৎ নৈতিকতার প্রকাশ
দরিদ্রদের প্রতি ভালবাসা একটি মানবিক গুণ যা মানুষের নৈতিক মূল্যবোধকে প্রকাশ করে। এটি একধরনের সহানুভূতি, যা অন্যের পাশে দাঁড়ানোর উৎসাহ দেয়।
সামাজিক সংহতিকে শক্তিশালী করা
দরিদ্রদের সাহায্য করা সমাজে ঘৃণা ও বিভক্তি প্রতিরোধ করে এবং পারস্পরিক সম্মান ও সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলে।
নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞ হওয়া
দরিদ্রদের দিকে তাকিয়ে নিজের উপর আল্লাহর নেয়ামত স্মরণ করা এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, আর যখন তোমাদের রব ঘোষণা দিলেন, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেব, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আযাব বড় কঠিন’। (সূরা ইবরাহিম, আয়াত : ৭)
আজাব থেকে মুক্তি
যারা দরিদ্রদের প্রতি সদয় হন না, তাদের জন্য কঠিন শাস্তির কথা কোরআনে উল্লেখ রয়েছে। দরিদ্রদের প্রতি সদয় হওয়া আজাব থেকে মুক্তির কারণ। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, আর মিসকীনকে খাদ্য দানে উৎসাহিত করত না। (সূরা আল-হাক্কাহ, আয়াত : ৩৪)
আরও বর্ণিত হয়েছে, ‘আর আমরা অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান করতাম না’। (সূরা মুদ্দাসসির, আয়াত : ৪৪)
কেয়ামতের দিন আল্লাহর নৈকট্য লাভ
নবীজি সা. হজরত আয়েশা রা.-কে বলেছেন, দরিদ্রদের ভালোবাসো এবং তাদের নিকটবর্তী হও। কারণ এটি কেয়ামতের দিন আল্লাহর নৈকট্য নিশ্চিত করবে। (তিরমিজি)
নেককারদের কাতারে অন্তর্ভুক্ত
দরিদ্র ও অভাবীদের খাওয়ানো জান্নাতবাসীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা খাওয়ায় অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দীকে.. ‘ (আল-ইনসান)। পবিত্র কোরআন বলছে, তারা খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও মিসকীন, ইয়াতীম ও বন্দীকে খাদ্য দান করে। তারা বলে,‘আমরা তো আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তোমাদেরকে খাদ্য দান করি। আমরা তোমাদের থেকে কোন প্রতিদান চাই না এবং কোন শোকরও না। আমরা আমাদের রবের পক্ষ থেকে এক ভয়ংকর ভীতিপ্রদ দিবসের ভয় করি। সুতরাং সেই দিবসের অকল্যাণ থেকে আল্লাহ তাদের রক্ষা করলেন এবং তাদের প্রদান করলেন উজ্জ্বলতা ও উৎফুল্লতা। (সূরা দাহর, আয়াত : ৮-৯-১০-১১)
ইসলামের শিক্ষা হলো দরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের প্রতি ভালোবাসা ও দয়া প্রদর্শন করা এবং তাদের জীবনমান উন্নত করতে কাজ করা। এটি শুধু ধর্মীয় আদেশ নয়, বরং মানবিক সম্পর্ক ও সামাজিক সংহতির মূল ভিত্তি।