বাংলাদেশের বিশ্বজয়ী ১৫ হাফেজ
২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করতে অবদান রেখেছেন এক নারীসহ ১৫ জন কোরআনের হাফেজ। সৌদি আরব, মিশন, তুরস্ক, ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আয়োজিত আন্তর্জাতিক কোরআন ও কেরাত প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছেন এই হাফেজরা।
ঘটনা বহুল ২০২৪ সালে পবিত্র কোরআনকে ধারণ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে নতুনভাবে পরিচিত করতে অবদান রেখেছেন তারা। বিজয়ী এই হাফেজদের তালিকায় রয়েছেন রাজধানীর মারকাযু ফয়জিল কুরআন আল ইসলামী দুই হাফেজ, হাফেজ মুয়াজ মাহমুদ ও হাফেজ আনাস মাহফুজ।
এছাড়াও বিজয়ী হয়েছেন রাজধানীর মারকাজুত তাহফিজ ইন্টারন্যাশনালের শিক্ষার্থী হাফেজ বশির আহমাদ ও হাফেজ আনাস বিন আতিক।
আরও বিজয়ী হয়েছেন তাহফিজুল কুরআন ওয়াসসুন্নাহর দুই শিক্ষাথী হাফেজ মুশফিকুর রহমান ও হাফেজ হুজাইফা।
তাহফিজুল কুরআন ওয়াসসুন্নাহর আরও বেশ কিছু শিক্ষার্থী ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত বিভিন্ন কোরআন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছেন। এই তালিকায় হাফেজ সাদিকুর রহমান, হাফেজ জাকারিয়া, হাফেজ আকমাল আহমাদের নাম রয়েছে।
এই প্রতিষ্ঠানটি থেকে মিশরে কিরাত প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছেন হাফেজ তানভির আহমাদ, আবুধাবীতে হদর তিলাওয়াতে বিজয়ী হয়েছেন হাফেজ আম্মার বিন মাসুম।
এই তিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে কোরআন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী আরও দুইজন হাফেজ হলেন হাফেজ আবু রায়হান ও হাফেজ মাহমুদুল হাসান। কিরাত প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছেন কারি আবু জর গিফারী। তরুণ হাফেজদের বাইরেও এ বছর কোরআন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছেন নারী হাফেজ হুমাইরা মাসউদ।
আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন এমন তিনটি মাদরাসার সঙ্গে কথা বলে ২০২৪ সালের বিশ্বজয়ী হাফেজদের পরিচিতি তুলে ধরা হলো—
হাফেজ মুশফিকুর রহমান
২০২৪ সালের শুরুতে আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতার মঞ্চে বাংলাদেশের হয়ে সাফল্যের প্রথম সুসংবাদ বয়ে আনেন ক্ষুদে হাফেজ মুশফিকুর রহমান। তিনি কাতারে অনুষ্ঠিত তিজান আন নূর আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন ফেব্রুয়ারিতে।
মুশফিকুর রহমান রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর শায়েখ কারি নাজমুল হাসান প্রতিষ্ঠিত তাহফিজুল কুরআন ওয়াসসুন্নাহ মাদরাসার শিক্ষার্থী।
এ প্রতিযোগিতায় সারা বিশ্ব থেকে প্রায় লক্ষাধিক হাফেজ ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করে। তাদের মধ্যে ১৬ জন হাফেজ সশরীরে কাতারে মূল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের হাফেজ মুশফিকুর রহমান প্রথম স্থান অর্জন করে।
আরও পড়ুন
হাফেজ বশির
মাত্র পাঁচ মাসে হিফজ শেষ করেছিলেন বিস্ময়কর মেধার অধিকারী হাফেজ বশির আহমাদ। মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন বিশ্ব দরবারেও। ইরানের রাজধানী তেহরানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় ১১০ দেশের প্রতিযোগিদের মধ্যে বশির প্রথম হয়েছিলেন।
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন তিনি। তিনি ঢাকার মারকাজুত তাহফিজ ইন্টারন্যাশনাল মাদরাসার শিক্ষার্থী।
ইরানের এই প্রতিযোগিতার মাত্র ১০ দিন আগে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হয়েছিলেন বশির। ২০২২ সালে হুফফাজুল কোরআন ফাউন্ডেশনের প্রতিযোগিতায় বশির প্রথম স্থান অর্জন করেছিলেন।
আরও পড়ুন
হাফেজ হুজায়ফা
ফেব্রুয়ারিতে এক মাসেই বাংলাদেশের দুই হাফেজ আন্তার্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ার পর মার্চেও আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতার মঞ্চে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছিলেন ১০ বছর বয়সী ক্ষুদে হাফেজ হুজাইফা। তানজানিয়ায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন তিনি।
হুজাইফা যাত্রাবাড়ীর তাহফিজুল কুরআন ওয়াস সুন্নাহ মাদরাসার ছাত্র।
৩১ মার্চ তানজানিয়ার দারুস সালামে ‘তানজানিয়া ইন্টারন্যাশনাল হলি কোরআন অ্যাওয়ার্ড ২০২৪’-এর প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। এতে প্রথম স্থান লাভের গৌরব অর্জন করেন তিনি।
হাফেজ আবু রায়হান
ফেব্রুয়ারি ও মার্চ দুই মাসেই আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশি হাফেজরা বিজয়ী হওয়ার পর এপিল মাসেও সেনেগালে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় ৩০ টি দেশকে পেছনে ফেলে প্রথম হয়েছিলেন বাংলাদেশের হাফেজ কারি আবু রায়হান।
এর আগে ২০১৮ সালে কাতারে তিজান আন নূর আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করেছিলেন তিনি। এছাড়াও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন হাফেজ কারি আবু রায়হান।
হাফেজ মুয়াজ ও আনাস বিন আতিক
সৌদি আরবের কিং আবদুল আজিজ আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কোরআন প্রতিযোগিতাগুলোর একটি। এই আয়োজনের ৪৪ তম আসরে বাংলাদেশের দুটি ভিন্ন ভিন্ন মাদরাসার দুইজন বিজয়ী হয়েছিলেন। বিজয়ী হাফেজরা হলেন, হাফেজ আনাছ বিন আতিক ও হাফেজ মুয়াজ মাহমুদ।
১২৩ টি দেশের ১৭৪ জন প্রতিযোগীর মধ্যে পৃথক দুটি গ্রুপে প্রথম স্থান অর্জন করেছিলেন তারা। আগস্ট মাসে তারা দেশের জন্য এই সুনাম বয়ে আনেন।
এই প্রতিযোগিতার ৩য় গ্রুপে ১ম স্থান অর্জন করা হাফেজ আনাছ বিন আতিক রাজধানীর মারকাজুত তাহফিজের ছাত্র। একই প্রতিযোগিতার ৪র্থ গ্রুপে ১ম স্থান অর্জন করা হাফেজ মুয়াজ মাহমুদ রাজধানীর মারকাযু ফয়জিল কোরআন আল ইসলামি ঢাকার কিতাব বিভাগের ছাত্র।
আবারও হাফেজ মুয়াজ মাহমুদ
২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় বিশ্ব দরবারে দেশের নাম উজ্জ্বল করা হাফেজদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হাফেজ মুয়াজ মাহমুদ। একই বছর দুইবার কোরআন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন তিনি।
আগস্টের পরে অক্টোবরে তুরস্কে অনুষ্ঠিত নবম আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করেছিলেন হাফেজ মুয়াজ মাহমুদ। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের হাত থেকে মুয়াজ মাহমুদ সম্মাননা ক্রেস্ট ও পুরস্কার গ্রহণ করেন। ২০১৬ সালের ৮ বছর পর ২০২৪ সালেও তুরস্কের এই প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে বাংলাদেশ।
এই আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লড়াইয়ে প্রথমে দেশে বাছাইপর্বে অংশ গ্রহণ করেন মুয়াজ মাহমুদ। সেখানে শতাধিক মেধাবী হাফেজদের পেছনে ফেলে প্রথম স্থান অর্জন করে তুরস্ক আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতার জন্য বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি নির্বাচিত হন মুয়াজ মাহমুদ।
হাফেজ আনাস মাহফুজ
আগস্ট ও অক্টোবরের পর নভেম্বরেও মারকাযু ফয়জিল কুরআন আল ইসলামীর শিক্ষার্থী হাফেজ আনাস মাহফুজ আন্তজার্তিক কোরআন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন। কুয়েতে অনুষ্ঠিত ১৩ তম আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম হন তিনি। ৮ থেকে ১২ বছরের ছিগারুল হুফফাজ (শিশু হাফেজদের গ্রুপ) গ্রুপে প্রথম স্থান অর্জন করেন তিনি।
কোরআন প্রতিযোগিতা ছাড়াও একই প্রতিযোগিতার কিরাত ক্যাটাগরিতে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন প্রতিষ্ঠানটির উদীয়মান ক্বারী আবু জর গিফারী। বিশ্বের ৭৪টি দেশের প্রতিযোগিদের সঙ্গে লড়াই করে বাংলাদেশের জন্য এই গৌরব বয়ে আনেন তারা। তারা দুজনই মিরপুরের মারকাযু ফয়জিল কুরআন আল ইসলামীর শিক্ষার্থী।
নারী হাফেজ হুমাইরা মাসউদ
পুরুষদের মতো কোরআন প্রতিযোগিতায় বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন হুমাইরা মাসউদ নামের এক তরুণী।
প্রাচীন সভ্যতার দেশ মিশরের নতুন রাজধানী ‘প্রশাসনিক কায়রো’তে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় অনারবদের জন্য নির্ধারিত গ্রুপে পঞ্চম স্থান অর্জন করেন তিনি।
হুমাইরা মাসউদ নারায়ণগঞ্জের উম্মে আইমান (রা.) আন্তর্জাতিক বালিকা মাদ্রাসা থেকে হেফজ, জামিয়া ইব্রাহিমিয়া আমিনিয়া মহিলা মাদ্রাসা থেকে দাওরা হাদীস উত্তীর্ণ হয়ে মিশরের বিখ্যাত আজহার ইনস্টিটিউটে সানুবি (উচ্চ মাধ্যমিক) অধ্যয়নরত।
হাফেজ মাহমুদুল হাসান
তুরস্কে অনুষ্ঠিত ইউরোপ ভিত্তিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন হাফেজ মাহমুদুল হাসান। তিনি তুরস্কের ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত। ২০২৪ সালের ১১ ডিসেম্বর তিনি প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন। এর আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে একই প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অর্জন করেছিলেন তিনি।
ইউরোপের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ও বলকান অঞ্চলের হাফেজদের নিয়ে থ্রেসের মুক্তা খ্যাত প্রাচীন বাইজেন্টাইনের রোমান শহর তেকির্দাতে প্রতি বছর আয়োজন করা হয় এই কোরআন প্রতিযোগিতার ।
ইউরোপের দেশ বুলগেরিয়া আলবেনিয়া ম্যাসেডোনিয়া গ্রীস ও তুরস্কের হাফেজ ছাত্র ছাত্রীরা এতে অংশগ্রহণ করে থাকে।
ভার্চুয়াল কোরআন প্রতিযোগিতা
২০২৪ সালে সরাসরি আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার পাশাপাশি ভার্চুয়ালি অংশ নিয়েছেন অনেকেই। এতে বিজয়ী হাফেজদের তালিকায় রয়েছেন হাফেজ সাদিকুর রহমান, হাফেজ জাকারিয়া, হাফেজ আকমাল আহমাদ। তারা সবাই তাহফিজুল কুরআন ওয়াসসুন্নাহর শিক্ষার্থী।
হাফেজ সাদিকুর রহমান তানজানিয়ায়, হাফেজ জাকারিয়া ইন্দোনেশিয়ায় ও হাফেজ আকমাল আহমাদ ইরানে আয়োজিত ভার্চুয়াল প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন।
কিরাত প্রতিযোগিতা
কারি আবু জর গিফারী
২০২৪ সালে আন্তার্জাতিক হেফজ প্রতিযোগিতার পাশাপাশি কিরাত প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছে বাংলাদেশের তিন হাফেজ। এই তালিকায় আছেন কারি আবু জর গিফারী।
তুরস্কে আয়োজিত কেরাত প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অর্জন করেন কারি আবু জর গিফারী। বিশ্বের ৭৪টি দেশের প্রতিযোগিদের সঙ্গে লড়াই করে বাংলাদেশের জন্য এই গৌরব বয়ে আনেন।
হাফেজ তানভির আহমাদ ও হাফেজ আম্মার বিন মাসুম
কিরাত প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছেন আরও দুজন। দুজনই রাজধানীর তাহফিজুল কুরআন ওয়াসসুন্নাহর শিক্ষার্থী। এই প্রতিষ্ঠানটি থেকে মিশরে কিরাত প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছেন হাফেজ তানভির আহমাদ, আবুধাবীতে হদর তিলাওয়াতে বিজয়ী হয়েছেন হাফেজ আম্মার বিন মাসুম।